E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ২৮ ভাদ্র, ১৪৩০

জি২০: মোদির প্রচার ছাড়া কিছুই মেলেনি

প্রসূন ভট্টাচার্য


ভারতের মাটি ছেড়ে ভিয়েতনামে নেমেই মুখ খুলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন। ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে পশ্চিমি দুনিয়ার ক্ষোভকে তিনি প্রকাশ করে দিয়েছেন। দিল্লিতে জি২০ সামিটে যোগ দিয়েছিলেন বাইডেন, বৈঠক শেষের কিছু আগেই তিনি হ্যানয়ে চলে যান। দিল্লিতে থাকাকালীনই বাইডেন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। কী কথা হয়েছিল দু’জনের মধ্যে? স্বাভাবিক রীতি হলো বৈঠকের পরে রাষ্ট্রপ্রধানদের সাংবাদিক বৈঠক করা। কিন্তু সামিটের আয়োজক ভারত সরকার দুই রাষ্ট্রপ্রধানের কারোর কোনো সাংবাদিক বৈঠকের ব্যবস্থা করেনি। তাতেও ধামাচাপা দেওয়া গেল না আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের মর্যাদাহানির বিষয়টি। কারণ, ভিয়েতনামে নেমেই মোদির সঙ্গে তাঁর বৈঠক প্রসঙ্গে হ্যানয়ে সাংবাদিকদের সামনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘গত ৮ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আলোচনায় আমি মানবাধিকারকে সম্মান দেখানোর গুরুত্বের বিষয়টি তুলে ধরেছি। একটি শক্তিশালী দেশ গঠনের কাজে নাগরিক সমাজ এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাও উত্থাপন করেছি।’’

মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠের কথা শুনতে হয়েছে, এটা ভারতের পক্ষে লজ্জার। কিন্তু এই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতেই দেশকে টেনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। জি২০ সামিটের ঝকঝকে আয়োজন আর চকচকে মোড়কে এই সত্যিকে লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

জি২০’র সদস্য দেশগুলিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সামিট আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গতবার ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জি২০ সামিট। এবার আয়োজক দেশের দায়িত্ব পেয়েছিল ভারত, ৯-১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি২০ সামিট, যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিওর্জিয়া মেলোনি সহ রাষ্ট্রপ্রধানরা। তবে প্রতিনিধি পাঠালেও রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিঙ আসেননি। রাষ্ট্রপ্রধানরা ছাড়াও রাষ্ট্রসঙ্ঘ, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শীর্ষকর্তারাও হাজির হয়েছিলেন। জি২০’র অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ, মোট অর্থনৈতিক উৎপাদন সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে তারা। ফলে বিশ্বের মানুষ অনেকাংশেই নির্ভর করে থাকে জি২০ সামিটের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সংক্রান্ত ঘোষণাগুলির ওপরে। জি২০ সামিটে অংশগ্রহণকারী সদস্য দেশগুলির সবার সম্মতি ছাড়া ঘোষণাপত্র তৈরি করা যায় না, প্রতিটি সদস্য দেশেরই ভেটো দেওয়ার অধিকার থাকে। আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে সহমতের অভাবে এবং রাষ্ট্রগুলির শাসকদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার বদলে বিশ্বপুঁজির প্রতি বেশি দায়বদ্ধতার কারণে বিশ্ববাসীর আকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে যায়। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার জনগণের প্রতিনিধিত্বের বদলে জি২০ সামিট কার্যত শাসকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকেই সীমিত থেকে যায় এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এই কারণে সাধারণত এই ধরনের সামিট যখন যে দেশে যে শহরে অনুষ্ঠিত হয় তখনই সেই দেশের শ্রমজীবী মানুষের, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগঠনগুলি এবং মানবাধিকার, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদির দাবিতে সোচ্চার সংগঠনগুলি সহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন নানা পালটা আলোচনার আয়োজন করে থাকে, এমনকী গণতান্ত্রিকভাবে বিক্ষোভও প্রদর্শন করে থাকে জনগণের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার জন্য। ভারতের মাটিতে এই ধরনের কণ্ঠস্বর এই মূহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মোদি সরকার জি২০ সামিটকে ব্যবহার করেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে মোদির ইমেজ বিল্ডিংয়ের কাজে। এই কারণে দিল্লি সহ সারা দেশে মোদির ছবি সহ কেবল বিজ্ঞাপনী প্রচারেই একশো কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। এছাড়া দিল্লিকে সাজাতে, বিদেশি ও দেশি প্রচার মাধ্যমে ঝকঝকে চকচকে আয়োজনকে দেখাতে মোট খরচ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সামিট আয়োজনে কখনো এত খরচ করেনি। আগামী বছরের নির্বাচনে ফায়দা তোলার জন্য মোদির ইমেজ বিল্ডিংই মূল উদ্দেশ্য হওয়ায় জনগণের কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখতেও সচেষ্ট ছিল ভারত সরকার। এর জন্য বিদেশি অতিথিদের সামনে ইন্ডিয়া নামের বদলে ভারত নাম ব্যবহার ছাড়াও কয়েকদিন ধরে দিল্লিকে কার্যত অবরুদ্ধ নগরীতে পরিণত করা হয়েছিল নিরাপত্তার নামে। দিল্লির মেট্রো এবং অটো সহ গণপরিবহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দারিদ্র্যের বাস্তবতাকে আড়াল করতে বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছে। যে সামিটে বিশ্বের জনগণের স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা, তাকে কি এভাবেই শাসকেরা ব্যবহার করে!

জি২০ সামিটের সপ্তাহ তিনেক আগে দিল্লিতেই হরকিষেণ সিং সুরজিৎ ভবনে ‘উই২০ পিপলস সামিট’-এর আয়োজন করেছিল গণআন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। পাঁচশো প্রতিনিধি তিনদিন ধরে আলোচনায় ভারত সহ সারা বিশ্বের জনগণের এই মূহূর্তের চাহিদার কথা তুলে ধরতে একত্রিত হয়েছিলেন। পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা করে উন্নয়নের পথ নির্ধারণ, কৃষি ও খাদ্যের সুরক্ষা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শিশুদের অধিকার, বাক্ স্বাধীনতা ও ডিজিটাল দুনিয়ায় তথ্যের অধিকার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির অধিকার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে রাষ্ট্রগুলির শাসকদের নীতি নির্ধারণে যাতে গুরুত্ব পায় সেই দাবিই তাঁরা তুলে ধরেছেন একটি সর্বসম্মত ঘোষণাপত্রে। বিশ্বব্যাঙ্ক কিংবা আইএমএফ-র মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির নিদানে বিশ্ববাসীর সমস্যা মিটবে না, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এবং দেশে দেশে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে ফ্যাসিবাদীরা শক্তিশালী হবে বলেও তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। উন্নত দেশগুলির দিকে উল্লম্ব দৃষ্টিতে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার বদলে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে আনুভূমিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধি, বিরোধ হ্রাসের দাবি করেছেন। বৃহৎ করপোরেট কোম্পানিগুলির মুনাফার লক্ষ্যে বড়ো বড়ো প্রকল্পে সরকারি খরচের বদলে জনগণের শিক্ষা স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দাবি করেছেন। জল, জঙ্গল, জমি তো বটেই, সরকারি উৎপাদন ও পরিষেবা পরিকাঠামোকেও মুনাফাখোর বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ারও বিরোধিতা করেছেন।

বৃহৎ পুঁজি এবং মোদি সরকার জনগণের এই কণ্ঠস্বরকে বিপজ্জনক বলে মনে করেছে। এতটাই বিপজ্জনক ঠাউরেছে যে, একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ভবনের ভিতরে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের আলোচনা সভাকে বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করেছে। এই কারণেই ‘উই২০’র সভা চলাকালীন দিল্লি পুলিশ সুরজিৎ ভবনে হানা দেয় এবং সভা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা দৃঢ়ভাবে সভা চালিয়ে যান এবং মানুষের দাবিগুলি উত্থাপনের কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন।

শুধু উই২০’র কণ্ঠস্বরই নয়, জি২০’র অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিরই সাংবাদিক প্রতিনিধিদের নিয়ে অনলাইনে ‘এম২০ মিডিয়া ফ্রিডম সামিট’ অনুষ্ঠিত হয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর। ভারত সহ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইংল্যান্ড, তুরস্ক, ফ্রান্স, ব্রাজিল এবং আরব দেশগুলির বহু সম্পাদক ও সাংবাদিক এই সামিটে অংশ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ক্রম ক্ষয়িষ্ণু স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং জি২০’র রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং জনগণের স্বার্থে সাংবাদিকতা না থাকলে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয় বলেই তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন। জি২০ সামিটগুলিতে বারবার যে টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হয় গণতন্ত্র এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া তা সম্ভব নয়, শাসকের স্তাবকতায় নিমজ্জিত সংবাদমাধ্যম উন্নয়ন ঘটাতে পারে না, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে স্বাধীন সাংবাদিকতার ভূমিকা ইত্যাদিতে জোর দিয়েছেন তাঁরা। বৃহৎ পুঁজির খপ্পরে থাকা মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির হাতে যে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত নয় সেকথাও বলেছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা যে মানবাধিকার রক্ষার শর্ত সেকথাও বলেছেন তাঁরা। ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার প্রাক্তন এডিটর ইন চিফ এন. রাম তো বলেই দিয়েছেন, ভারতে সর্বাধিক ফেসবুক, ট্যুইটার (এখন এক্স), ইন্সটাগ্রাম ব্যবহারকারী। কিন্তু ভারতই বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ডিসইনফর্মড (তথ্যহীন) সমাজ। সাংবাদিকদের এখানে সন্ত্রাসবাদী বলে জেলে পোরা হচ্ছে।

কিন্তু এসব শুনছে কে? জি২০ সামিট নিয়ে যে প্রচার সংবাদমাধ্যমে হয়েছে তার ১ শতাংশও কি জনগণের স্বার্থবাহী এইসব দাবিগুলি প্রচারিত হয়েছে? হয়নি। সেই কারণেই বাইডেনকে ভারত ছেড়ে ভিয়েতনামে পা দিয়ে ভারতে প্রেস ফ্রিডম এবং মানবাধিকার নিয়ে উদ্‌বেগ প্রকাশ করতে হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে দিল্লির জি২০ সামিট তাহলে বিশ্ববাসীকে দিল কী? কেবল আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি২০’তে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা ছাড়া কোনো উৎসাহব্যঞ্জক ঘোষণা খুঁজে পাচ্ছেন না ওয়াকিবহাল মহল। এবারের জি২০ সামিট ইউক্রেন-রাশিয়ার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামানোর পথেও অগ্রসর হতে পারেনি, বিশ্বব্যপী অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কমানোর পথে অগ্রসর হওয়ারও ঘোষণা করতে পারেনি। কেবল মন্দায় আশঙ্কিত বিশ্ব পুঁজিকে আশ্বাস দেওয়ার মতো কিছু ঘোষণা করতে পেরেছে। যেমন? যেমন ভারত- মধ্য প্রাচ্য- ইয়োরোপের নতুন অর্থনৈতিক করিডর। এই করিডরে ভারত থেকে সমুদ্রপথ ও রেলপথে ইয়োরোপে পণ্য চলাচল করবে। ভারত, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ও ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনার ফসল এই নতুন করিডরকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ‘পালটা’ হিসাবে দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। প্রতিবেশী দেশগুলির থেকে পশ্চিমের সঙ্গে বাণিজ্যে বেশি জোর দিচ্ছে ভারত সরকার। আর এই করিডরে লাভবান হতে চলেছে ভারতের আদানি গোষ্ঠী। তাদের স্বার্থ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এই করিডরে। আদানি গোষ্ঠী এই করিডোরের মধ্যবর্তী বন্দরগুলি ইতিমধ্যেই কিনে নিয়েছে অথবা কেনার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।

বিশ্ববাসীর স্বার্থে নয়, শাসকদের স্বার্থেই আলোচনা হয়েছে জি২০ সামিটে।