৫৮ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৬ এপ্রিল, ২০২১ / ২ বৈশাখ, ১৪২৮
‘আর নয় কাটমানি
নৈহাটিতে এবার ইন্দ্রাণী’
বাহুবলীদের প্রত্যাখ্যান করে বাম প্রার্থীর জয় চাইছেন মানুষ
নৈহাটি কেন্দ্রে প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী ইন্দ্রাণী কুণ্ডু মুখার্জি।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নৈহাটির সাধারণ মানুষ এখন শান্তি চান। শান্তিতে থাকতে চান। বঙ্কিমচন্দ্র এবং সমরেশ বসুর সাহিত্য-সংস্কৃতির গর্বের উত্তরাধিকার বহন করেন তাঁরা। তাই বোমা বন্দুক তোলাবাজি-কাটমানি আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, আজকের প্রজন্ম যাতে সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিবাচক ঐতিহ্য বহন করে এগোতে পারে সেটাই চান নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষ। আর ঈশ্বরী পাটনির মতো তাঁরাও চান সন্তান যেন ‘দুধে ভাতে’ থাকে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপিআই(এম)র ইন্দ্রাণী কুণ্ডু মুখার্জিকে প্রচার পরিক্রমায় সামনে পেয়ে এসব কথাই বলছেন নৈহাটির মানুষ।
বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের ভেতর নৈহাটি বিধানসভা। এই লোকসভা ক্ষেত্রের কতগুলি সাধারণ দিক আছে যা সবক’টি বিধানসভা এলাকাতে চোখে পড়বেই। যেমন অসংগঠিত শ্রমিক অধ্যুষিত মিশ্র ভাষাভাষী বসতি এলাকা। এখানকার সাংসদ অর্জুন সিং। মানুষের ‘সার্টিফিকেট’, অর্জুন গণতন্ত্র নয় বাহুবলীতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাই গুলি, খুন, পাল্টা খুনের গোলকধাঁধায় মাথা কুটে মরছে এখানকার প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।
নৈহাটির বাসিন্দাদের বড়ো অংশ জুটমিল সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। এই জুটমিলগুলির খোলা-বন্ধ, ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ, কাটমানি সবটাই নিয়ন্ত্রণ করেন শাসকদলের নেতারা এবং সাংসদ অর্জুন সিং-এর ‘স্নেহধন্য’ সাকরেদরা। এই মাফিয়ারাজ কায়েম রাখতে গিয়ে প্রকাশ্যে ঘটে সংঘর্ষ, যার বলি হন সাধারণ মানুষ। অন্য অনেকের মতো নৈহাটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের গৃহবধূ মাধুরী দাস ইন্দ্রাণীর সামনেই জোর গলায় বলছিলেন, বিগত ৩৪ বছরের বাম জমানায় এ জিনিস ছিল না। তাঁকে সমর্থন করলেন পাশাপাশি থাকা অন্য বাসিন্দারাও।
ছাপোষা দিন আনা দিন খাওয়া এইসব সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন তোলাবাজির শিকার হচ্ছেন। মজুরিতে যারা ভাগ বসান সেই বাহুবলী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন শ্রমিকরা। তাঁরা মুখ খুললে জোটে মার এবং গলাধাক্কা। ইন্দ্রাণী বলছিলেন, সাধারণ মানুষেরও দেওয়ালে পিঠ ঠেকেগেছে। তাই মানুষ মরিয়া হয়ে পরিত্রাণ চাইছেন। পাল্টা লড়াইয়ে নামতে চাইছেন। তাঁদের কাছে আমরাই এখন শান্তির লক্ষ্যে লড়াইয়ের বিকল্প।
কেন শুধু শান্তির কথাতেই জোর দিচ্ছেন এখানকার মানুষ? কেন রুটি রুজির নিশ্চয়তা তাঁদের দ্বিতীয় চাহিদা? আসলে গত এক দশকে তাঁরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছেন, দেখেছেন সাতে পাঁচে না থাকা নিরীহ ফুচকা বিক্রেতা থেকে বাহুবলীর মৃত্যু। দেখেছেন লাশের রাজনীতি, দেখেছেন হিংসার পরিমণ্ডল, দেখেছেন মিথ্যার প্ররোচনা। এই নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত আর চান না এখানকার মানুষ। ছাপোষা মানুষ আগে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি চাইছেন। তাই ইন্দ্রাণীর মিছিলে ভিড় বাড়ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। আর বদলে যাচ্ছে ভোট লুটের চেনা ছকে বাজিমাতের বাহুবলীতন্ত্র।
বিগত ১০ বছরে বারাকপুর লোকসভার অন্যান্য কুখ্যাত ট্রেডমার্কের মতোই এখানেও সুষ্ঠু এবং অবাধ ভোট গ্রহণ হয়নি কোনো স্তরেই। জিনিসের দাম বাড়া থেকে এনআরসি-বিজেপি-তৃণমূলের নীতির অনিশ্চয়তার কানাগলিতে আর ঢুকতে রাজি নন এখানকার পাড়া মহল্লার মানুষ। কেন্দ্র-রাজ্যের শাসকদলের প্রতিশ্রুতির মিথ্যাচারের অতি চালাকি ধরা পড়ে গেছে। তাই সংযুক্ত মোর্চার চাকরিতে নিয়োগ আর বিদ্যুতের ভরতুকি সহ অন্যান্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাম জমানার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভিজ্ঞতা মনে রেখে নৈহাটির মানুষ প্রত্যাখ্যান করছেন বিজেমূলকে। যার নিট ফল ইন্দ্রাণীর মিছিলে, জনসভায় এবং প্রচার পরিক্রমার দখল নিচ্ছেন ভয় ভাঙা মানুষ। তাই সংযুক্ত মোর্চার এই প্রার্থীর মিছিলে অনর্গল স্রোতের মতো স্লোগান উঠছে ‘নিজের ভোট নিজে দিন, ভোট লুট রুখে দিন’।
ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, বিজেমূলের বিড়ম্বনা বাড়ছে নানা মাত্রায়। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন তুলছে নৈহাটি, ভোটের সময় যাঁরা এখন ‘ভোট পাখি’ হয়ে দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁরা কোথায় ছিলেন লকডাউনের দিনগুলিতে? না তাঁরা কেউ ছিলেন না। প্রবল অনিশ্চয়তায় ভরা সেই বেরোজগার দিনগুলিতে মানুষের পাশে বিজেমূলের কাউকে পাওয়া যায়নি, শুধুমাত্র বামপন্থীরাই ছিলেন। প্রায় কুড়ি হাজার মানুষকে সে সময় নিয়মিত চাল-ডাল-শুকনো খাবার থেকে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে। না তখন কেউ ‘৫ টাকার ভাত প্রকল্প’ নিয়ে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেননি। ছোটোদের জন্য বই খাতা, পরিবারগুলির জন্য সুলভে শ্রমজীবী সবজি বাজার, মহিলাদের জন্য শাড়ি জামা কাপড়ের সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন সমস্তটাই বিভিন্ন গণসংগঠন পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন মহিলা সমিতির পক্ষে ইন্দ্রাণী কুণ্ডু মুখার্জি।
নতুন প্রজন্মের চাকরির প্রশ্নে মুখ লুকোচ্ছে বিজেমূল। অধুনা বিজেপি, প্রাক্তন তৃণমূলী সাংসদ অর্জুন সখা দীনেশ ত্রিবেদী রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এখানে কিছুদিন আগেও বন্ধ কল-কারখানা খোলার চাবি তাঁর কাছে আছে বলে দাবি করে ভোট ভিক্ষা করেছিলেন। আর রেলমন্ত্রী থাকাকালীন তিনিও মমতা ব্যানার্জির পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাঁচরাপাড়ায় রেলওয়ে ওয়ার্কশপে নয়া-কারখানার কথা বলেছিলেন মুকুল রায়ের মতো। সেসব হয়নি। আর তাই তাঁদের ফাঁপানো কর্মসংস্থানের নটে গাছ মুড়িয়ে গেছে। ইন্দ্রাণী কুণ্ডু বলছিলেন, নৈহাটিতে প্রস্তাবিত শিল্পতালুক হয়নি। সেক্টর ফাইভ’র মুমূর্ষু দশার জেরে নৈহাটি থেকে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত যে বাস বাম আমলে নিয়মিত চলত, তা বন্ধ হয়ে গেছে। নৈহাটির নিজস্ব সমস্যা পর্যাপ্ত পানীয় জল না পাওয়া, তার কোনো সমাধান হয়নি গত এক দশকে। নারী নির্যাতনের বহু ঘটনা এখানে ঘটে, যা নিয়ে অভিযোগ করলেও পুলিশ গুরুত্ব দেয় না। তৃণমূল বিধায়ক আর তাঁর অনুগামীদের কথায় চলে প্রশাসন। আর এই ব্যর্থতাকে ঢাকা দিতে তৃণমূল বিজেপি’র বাইনারি এতো বেশি ব্যবহার করে ফেলেছে মূলধারার সংবাদ মাধ্যম যে, মানুষের কাছে তা গুরুত্ব হারিয়েছে। কারণ মানুষ বুঝেছেন দু’টো আলাদা নামে আদতে একটাই পার্টি রয়েছে। তাই ফুলের বোঝা বইবার মতো ভুল এখানকার মানুষ আর করতে চাইছেন না। আর নতুন প্রজন্ম? বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে বেরনো প্রার্থীকে ঘিরে ধরে ছাত্র-যুবদের সেলফি তুলতে চাওয়ার আবদারের কোলাজ প্রয়াত শ্রমিক নেতা রঞ্জিত কুণ্ডুর কন্যা ইন্দ্রাণীর এগিয়ে থাকার প্রত্যয়কেই সোচ্চার করছে। নৈহাটি জুড়ে সাধারণ মানুষের স্লোগান তাই ‘আর নয় কাটমানি, নৈহাটিতে এবার ইন্দ্রাণী’।