৫৮ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৬ এপ্রিল, ২০২১ / ২ বৈশাখ, ১৪২৮
পশ্চিম বর্ধমান জেলা
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প রক্ষা, রুগ্ন শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও কর্মসংস্থানের দাবিতে সংযুক্ত মোর্চার প্রচার সাফল্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে
পাণ্ডবেশ্বর কেন্দ্রে প্রচারে সিপিআই(এম) প্রার্থী সুভাষ বাউড়ি।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বাঁচানো এবং রুগ্ণ শিল্পের পুনরুজ্জীবন, কর্মসংস্থান এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বার্তাই মূর্ত হচ্ছে পশ্চিম বর্ধমান জেলায় সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে। কোলিয়ারি থেকে শিল্পাঞ্চল এবং চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত প্রান্তিক এলাকার মানুষ - সবার সমস্যা-যন্ত্রণা এবং জীবন-সংগ্রামের কথা প্রচারে তুলে ধরছেন মোর্চার কর্মীরা। যা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ, বেকার যুবক, মহিলা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ - সবার জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যাচ্ছে। ফলে জেলাজুড়েই সংযুক্ত মোর্চার প্রচার ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। সেইসঙ্গে সংযুক্ত মোর্চার সাফল্যের সম্ভাবনায় বিকল্প কর্মসূচি রূপায়ণের পথও রচিত হচ্ছে।
এই জেলায় ৯টি বিধানসভা আসনের মধ্যে সিপিআই(এম) ৫টি, কংগ্রেস ৩টি এবং আইএসএফ ১টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই আসনগুলির মধ্যে দুর্গাপুর পূর্ব, রানিগঞ্জ এবং জামুড়িয়া কেন্দ্রে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও জয়ী হয়েছিল সিপিআই(এম)। এবারে এই তিনটি আসনে জয়কে সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি অন্যান্য কেন্দ্রেও সাফল্য অর্জনের জন্য নির্বাচনী লড়াই চালাচ্ছে সংযুক্ত মোর্চা।
এ রাজ্যের মানুষ, বিশেষকরে এই জেলার মানুষের অভিজ্ঞতায় রয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতির মধ্যদিয়ে কয়লাখনি সহ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে সরকার-ঘনিষ্ঠ বড়ো বড়ো পুঁজিপতি ও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার বন্দোবস্ত হয়েছে। এই সরকারের নীতির ফলে ইতিমধ্যে জেলার ২২টি কয়লাখনি বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে এমএএমসি’র মতো কারখানা। বন্ধ বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, সার কারখানা। অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টকে বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রের সরকার। এছাড়া দুর্গাপুর প্রজেক্ট লিমিটেড (ডিপিএল) এবং দুর্গাপুরের জিই পাওয়ার ইন্ডিয়া লিমিটেড সঙ্কটের মুখে। দুর্গাপুরের ইস্পাত শিল্প আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে না।
বিগত দশ বছরে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার শিল্পাঞ্চলকে রক্ষা করতে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। উলটে তৃণমূলের দলবাজি ও তোলাবাজিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। নরেন্দ্র মোদী সরকার যখন চাইছে শিল্পাঞ্চলকে ধ্বংস করতে, তখন তৃণমূল কংগ্রেস কার্যত নীরব অবস্থা নিয়ে মোদীকে সাহায্য করেছে।
জেলার কয়লাখনি অঞ্চলে ভূমি ধসের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষেরা তীব্র সঙ্কটের কবলে পড়ছেন। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি অবহেলিতই থেকে গেছে।
আসানসোল দক্ষিণ কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী প্রশান্ত ঘোষের প্রচার মিছিল।
মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য শিল্পের মতো কয়লা শিল্পেও সমস্যা ও সঙ্কট তীব্র হয়েছে। কয়লাখনি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ আইনে মোদী সরকার আসার আগে পর্যন্ত কয়লা বিক্রির অধিকার কেবলমাত্র কোল ইন্ডিয়ারই ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার লোকসভায় অর্ডিন্যান্স এনে এবং রাজ্যসভায় আইন করে কোল মাইন্স (স্পেশাল প্রভিশনস) অ্যাক্ট ২০১৫ লাগু করে। এই আইনের ফলে যে কোনো প্রাইভেট সংস্থাকে কয়লা উত্তোলন করে বিক্রি করা ও মূল্য নির্ধারণ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের বিরূপ প্রভাব পড়বে কোল ইন্ডিয়ার উপর। এরফলে কোল ইন্ডিয়ার উৎপাদিত কয়লার মূল্য প্রাইভেট খনির তুলনায় বেশি হবে। কারণ সিআইএল-ইসিএল-কে মজদুরদের বেতন বাবদ খরচ করতে হয় ৬৫ শতাংশ। যেখানে প্রাইভেট খনিতে মজদুরদের বেতন বাবদ খরচ হয় মাত্র ১৬ থেকে ২০ শতাংশ। ফলে ব্যক্তি মালিকানাধীন খনিতে উৎপাদন খরচ অনেক কম হবে। তার ফলে কোল ইন্ডিয়ার কয়লা বিক্রি অনেক কম হবে। যা কয়লা শিল্পে ধ্বংসের পথকেই প্রশস্ত করবে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, তৃণমূলের সাংসদরা এই বাণিজ্যিক উৎপাদন (কমার্শিয়াল মাইনিং) আইনটিকে পাশ করাতে মোদী সরকারকে সাহায্য করতে সংসদে এই আইনটির পক্ষেই ভোট দেয়।
আসলে তৃণমূল কংগ্রেস কয়লা খনি বেসরকারি হাতে দিতেই আগ্রহী। তাতে বেআইনি কয়লা পাচারে তাদের সুবিধা হবে। ইতিমধ্যেই কয়লা পাচার কাণ্ডে আলোড়িত হয়েছে গোটা রাজ্য। তাতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ নেতাদের নাম। কেবল কয়লা পাচারই নয়, বন্ধ কারখানার লোহা, বালি পাচারে তৃণমূলী মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। বালি মাফিয়াদের দাপটে জেলার অন্যতম প্রাণস্পন্দন দামোদর ও অজয় নদী বিপন্ন। ফলে রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, কাজোড়া, অণ্ডাল, উখড়া, পাণ্ডবেশ্বর, লাউদোহা প্রভৃতি এলাকার মানুষ পানীয় জলের তীব্র সঙ্কটে ভুগছেন। সেচের জলের অভাবে চাষ-আবাদে বিঘ্ন ঘটছে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জামুড়িয়াতে ভিডিওকন সংস্থার কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল তা করতে দেয়নি। এছাড়া বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই তৈরি হয়েছিল অণ্ডাল বিমানবন্দর। কিন্তু কোনোরকম পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ভাবনা ও বাস্তবতা বিচার না করেই এই বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকমানে পরিণত করার ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। আসলে এটি ছিল নিছক একটি ভাঁওতা। আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর করার দু’টি প্রাথমিক ন্যূনতম শর্ত হলো, এজন্য কমপক্ষে দেড় হাজার একর জমি প্রয়োজন। অথচ এই বিমানবন্দর গড়ে উঠেছে মাত্র ৬৫০ একর জমির উপর। এখানে ডিভিসি’র তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকায় জমি বৃদ্ধি সম্ভব নয়। এছাড়া আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দরে রানওয়ের জন্য দৈর্ঘ্য কম করে ৩২ হাজার মিটার হওয়া প্রয়োজন, অথচ রয়েছে মাত্র ২৭৫০ মিটার। এই সমস্ত কারণে এখানে কোনোভাবেই আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। অথচ ভোটের আশায় এই মিথ্যাচারই চালিয়েছে তৃণমূল সরকার।
বর্তমান রাজ্য সরকারের হঠকারি সিদ্ধান্তে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ ও কুলটি পৌরসভাকে আসানসোল কর্পোরেশনের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এরফলে এই বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষকে ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জেলার এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়েই নির্বাচনী প্রচার অভিযানে শামিল হয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। জেলার মানুষের জীবন-সংশ্লিষ্ট এই বিষয়গুলি সর্বাগ্রে প্রচারে উঠে আসায় সংযুক্ত মোর্চার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রচারে।
রানিগঞ্জ কেন্দ্রে এলাকা পরিক্রমায় সিপিআই(এম) প্রার্থী হেমন্ত প্রভাকর।
রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতো এই জেলায়ও সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করেছিল শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। পঞ্চায়েত, পৌর নির্বাচনে ভোট লুট করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে ওরা। চলেছে ব্যাপক দুর্নীতি, লুটের রাজত্ব। মানুষ আজ এসবের জবাব চাইছেন। তাই এক সময়ের সন্ত্রাস কবলিত এলাকাগুলিতে আজ লাল পতাকার মিছিল-সমাবেশ নতুন পরিস্থিতির জানান দিচ্ছে।
রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতো এই জেলাতেও করোনা অতিমারীর সময়ে অপরিকল্পিত লকডাউনের জেরে বিপন্ন হয়েছেন অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। তাঁদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা ইত্যাদি নানাভাবে সাহায্য করেছেন সিপিআই(এম)-সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মীরা। আসনসোলের মাইশিলা, জামুড়িয়ার নিঘা, চনচনি (দামোদর, অজয়), সাগরভাঙা এবং রানিগঞ্জ কোলিয়ারির বাঁশড়াতে কমিউনিটি কিচেনের মাধ্যমে অসহায় মানুষদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে।
এছাড়া অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা ঝাড়খণ্ড থেকে ডুবুরডিহি চেকপোস্টে আটকে ছিলেন এবং জামুড়িয়া ও পাণ্ডবেশ্বরে আটকে পড়া মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের খাওয়ানো এবং তাঁদের বাড়ি ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন বামপন্থীরা। একইভাবে রানিগঞ্জে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার শ্রমিকদের এবং দুর্গাপুরে আটকে পড়া মুর্শিদাবাদ ও ঝাড়খণ্ডের পরিযায়ী শ্রমিকদেরও সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন সিপিআই(এম) সহ বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠনের কর্মীরা। এই বিপন্ন সময়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ও শাসকদল কারও সাহায্যই মেলেনি। এসব প্রত্যক্ষ করেছেন জেলার মানুষ।
সংযুক্ত মোর্চার কর্মীরা জেলার প্রতিটি কেন্দ্রে এলাকা পরিক্রমায়, বাড়ি বাড়ি প্রচারে, পথসভায়, জনসভায় শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি যেমন তুলে ধরছেন, তেমনি তাঁদের প্রচারে প্রাধান্য পাচ্ছে রানিগঞ্জ-জামুড়িয়াকে নিয়ে আলাদা মহকুমা স্থাপন, উন্নত পরিকাঠামোযুক্ত জেলা হাসপাতাল গড়া, চুরুলিয়ার নজরুল আকাদেমির পরিকাঠামো উন্নয়ন, পানীয় জলের সঙ্কট মেটানো, জেলাজুড়ে কয়লা ও বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সহ জেলায় শান্তি সুস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে সংযুক্ত মোর্চার প্রচার জেলার সমস্ত অংশের মানুষেরই যেন বক্তব্য হয়ে উঠছে। তাই মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জেলায় সংযুক্ত মোর্চার সাফল্যেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।