৫৮ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৬ এপ্রিল, ২০২১ / ২ বৈশাখ, ১৪২৮
জামুড়িয়া কেন্দ্রে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও উন্নয়নের লক্ষ্যপূরণে চলছে সংযুক্ত মোর্চার প্রত্যয়ী অভিযাত্রা
সন্দীপ দে
জামুরিয়া কেন্দ্রে ঐশী ঘোষের সমর্থনে সুবিশাল মিছিল।
জামুড়িয়া কেন্দ্রে বামপন্থীদের সাফল্যের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে এবারেও অম্লান রাখতে চলেছেন ঐশী ঘোষ। তিনিই এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফি-বৃদ্ধির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আরএসএস-বিজেপি’র দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছিল তাকে। তবুও আন্দোলনের প্রবাহে এতটুকু থমকে না গিয়ে তাঁর প্রতিস্পর্ধী ভূমিকা ছাত্র আন্দোলনের একজন লড়াকু নেত্রী হিসেবে সারা দেশে তাকে পরিচিতি এনে দিয়েছে। দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেধাবিনী ছাত্রী আজ অবতীর্ণ হয়েছেন নির্বাচনী লড়াইয়ের মতো গণ-আন্দোলনের এক বৃহৎ তরঙ্গে। এতদিন শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দাবি আদায় এবং শিক্ষান্তে চাকরির দাবির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের পরিসরে সর্বস্তরের মানুষের স্বার্থে নিয়ত থাকার লড়াইয়ে ব্রতী হওয়ার ক্ষেত্রে তাকে নিঃসন্দেহে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। সেইসঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, এই কেন্দ্রের মানুষ, বিশেষকরে মহিলারা ঐশীকে তাঁদের ঘরের মেয়ের মতোই শুভেচ্ছায়-ভালোবাসায় আপন করে নিচ্ছেন। ঐশীর এলাকা পরিক্রমার সময়ে সর্বত্র ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে, তাকে মালা পরিয়ে, একরকম জোর করে মিষ্টিমুখ করিয়ে মহিলারা তাঁদের ভালোবাসা ও সমর্থন সব উজাড় করে দিচ্ছেন।
সকলের এই অফুরান ভালোবাসা আর সমর্থনের সঞ্চয় নিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ঐশী বিভিন্ন এলাকা পরিক্রমায় গিয়ে বলছেন, গত ১০ বছরে তৃণমূলের অপশাসন, পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় ভোটলুট, দুর্নীতি আর কাটমানির কারবারে উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে আছে। অন্যদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নীতির ফলে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে মা-বোনদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে। আর শিক্ষাক্ষত্রে ক্রমাগত ফি বৃদ্ধির ফলে বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কাজেই এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে স্থির হবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কেমন হবে। কাজেই আপনাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বিজেপি’র সাত বছর এবং তৃণমূলের ১০ বছরের রাজত্বে যে যন্ত্রণায় কেটেছে তার অবসান হবে কিনা।
মমতা ব্যানার্জির ‘উন্নয়ন’ আর নরেন্দ্র মোদির ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’ গড়ার বাগাড়ম্বরকে নস্যাৎ করে ঐশীর স্পষ্ট বক্তব্য, ডবল ইঞ্জিনের সরকারের পরিণতি টের পাচ্ছেন ত্রিপুরা ও উত্তরপ্রদেশের মানুষ। ওসব রাজ্যে বিজেপি-আরএসএস’র অত্যাচারে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আর এ রাজ্যে উন্নয়ন কেমন হয়েছে তা জামুড়িয়া কেন্দ্রের মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন। এখানে ভিডিওকন ও রেশমি সিমেন্ট কারখানা করার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এই মমতা ব্যানার্জির দল সেসব হতে দেয়নি। এছাড়াও এদের রাজত্বে কোলিয়ারি সহ আরও কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। কাজেই আগামীদিনে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে এবং রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সংযুক্ত মোর্চার প্রতি আপনাদের সমর্থন একান্তভাবেই জরুরি।
প্রচারে ভোটারদের সান্নিধ্যে ঐশী ঘোষ।
ঐশীর এই ঋজু উচ্চারণ সমস্ত অংশের মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করছে। তাই তাঁর এলাকা পরিক্রমায়-মিছিলে বিপুল অংশের মানুষের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ বিশেষভাবে সাড়া জাগাচ্ছে।
আসানসোল কর্পোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ড এবং ১০টি পঞ্চায়েত রয়েছে জামুড়িয়া কেন্দ্রের মধ্যে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতির ফলে সম্ভাবনাময় এই শিল্পাঞ্চল আজ ধুঁকছে। এই অঞ্চলে অনেকগুলি কয়লাখনি আজ বন্ধ হয়ে আছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ৬টি সিমেন্ট কারখানা, ১৪টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা, বিস্কুট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। সেগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে আছে। এগুলি খোলার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি রাজ্য সরকারের।
বামফ্রন্ট সরকার জামুড়িয়াতে ভিডিওকন কারখানার করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। এজন্য জমির বন্দোবস্ত হয়েছিল। এই কারখানা গড়ে উঠলে প্রায় প্রাথমিকভাবে ৩৫০০ লোকের চাকরির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আজও তার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি তৃণমূল সরকার। একইভাবে রেশমি সিমেন্ট কারখানা গড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। এজন্য জমি অধিগ্রহণ করে সীমানা প্রাচীর দেওয়া সম্পন্ন হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এখানে দেড় হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এছাড়া মদনতোড় চরণপুর এলাকায় অভিজিৎ স্টিল ফ্যাক্টরি এবং ইকরা অঞ্চলে দুটি ব্যাটারি কারখানার শিলান্যাস হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে এই সমস্ত প্রকল্পের সম্ভাবনা বানচাল করে দিয়েছে।
এই সরকারের আমলে নতুন শিল্প গড়ে ওঠাতো দূরের কথা, শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদতে অজয় নদী থেকে বেআইনিভাবে বালি তুলে পাচার হচ্ছে। একইভাবে কয়লা পাচার করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি চলছে। এই টাকার ভাগ যাচ্ছে শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের পকেটে। রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও পঞ্চায়েতে দুর্নীতি সীমা ছাড়িয়েছে। শাসক দলের বেপরোয়া লুটের ফলে প্রকৃত অভাবী মানুষেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ইন্দিরা আবাস যোজনায় ঘর পাইয়ে দেবার অছিলায় কাটমানি নিচ্ছে তৃণমূলের স্থানীয় মাতব্বররা। এরা এতটাই অমানবিক যে, যেসব অঞ্চলে সিপিআই(এম)’র প্রভাব বেশি সেখানে নিজেদের ইচ্ছেমতো বিপিএল তালিকাভুক্তদের এপিএল তালিকায় চালান করেছে।
এখানে কোলিয়ারি অঞ্চলে একটি জ্বলন্ত সমস্যা হলো ধস নামা। খনি কর্তৃপক্ষের অবৈজ্ঞানিকভাবে কয়লা তোলার ফলে কেন্দা, শ্রীপুর, হরিহার বৈজুদ্দিপুর, বাসকমুলিয়া, মিঠাপুর প্রভৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ ধসের কেবলে পড়ছেন। এই বিপন্ন মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য আবাসন নির্মাণে বামফ্রন্ট সরকার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু আজও সেই কাজ শেষ হয়নি। ফলে চরম দুর্ভোগের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে বিপন্ন মানুষদের।
এই অবস্থার মধ্যেও বিগত সময়ে সিপিআই(এম) বিধায়ক জাহানারা খানের এলাকা উন্নয়ন তহবিলের টাকায় সাধারণ মানুষের স্বার্থে নানাবিধ উন্নয়নের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম জিবানাবেড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ, রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন কবরস্থানের প্রাচীর নির্মাণ ইত্যাদি। বিদায়ী বাম বিধায়ক সব সময়ই ছিলেন মানুষের পাশে। দেখা গেছে আসানসোল কর্পোরেশনের নির্বাচন না হওয়ায় কাউন্সিলরকে না পেয়ে শত শত মানুষ সিপিআই(এম) অফিসে এসে সার্টিফিকেট নিয়ে গেছেন জাহানারা খানের কাছ থেকে। এমনকি পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূলী বিধায়কের দেখা না পেয়ে অনেক মানুষ এসে এই বাম বিধায়কের কাছ থেকেই সার্টিফিকেট নিয়ে গেছেন।
এই কেন্দ্রের মানুষের অভিজ্ঞতায় রয়েছে ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা কীভাবে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করেছিল। বিশেষ করে শ্যামল্যা ও কেন্দা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়, বালানপুর, কাঁটাগড়িয়া, শ্রীপুরে শাসকদলের লাগামহীন দৌরাত্ম্য চলেছে। ওদের সন্ত্রাসে ২০১১ সালে খাসকেন্দাতে খুন হন যুবকর্মী ভীমরাজ তেওয়ারি এবং ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে ভোট দিতে গিয়ে পার্টি কর্মী হাসমত সাগাকে খুন হতে হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য পার্টি কর্মী-সমর্থকের বাড়িঘর ও পার্টি অফিস ভাঙচুর, আড়াইশোর বেশি পার্টি কর্মী-সমর্থকের নামে দু’হাজারেরও বেশি মিথ্যা মামলা দায়ের করা, পার্টি কর্মীদের মারধর, রক্তাক্ত করার ঘটনা ঘটেছে। তবু্ও পার্টির কার্যকলাপ স্তব্ধ হয়নি। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই সন্ত্রাসকে প্রতিহত করেই লাল পতাকার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
জামুড়িয়া কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের দাবিকেই সর্বাগ্রে তুলে ধরার পাশাপাশি জামুড়িয়ায় একটি দমকল কেন্দ্র নির্মাণের দাবিও উঠেছে। এজন্য বিদায়ী বাম বিধায়ক জাহানারা খান অসংখ্যবার সরকারকে চিঠি দিলেও এব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়াও তিনি চুরুলিয়া থেকে কলকাতা বাস সার্ভিস দাবি জানিয়েছিলেন। এব্যাপারে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর হয়নি। বিগত সময়ে জামুড়িয়ায় একটি কলেজ স্থাপন, শ্রীপুর এলাকায় উর্দু স্কুল এবং নিংঘাত এলাকায় হিন্দি স্কুলের দাবি জানানো সত্ত্বেও কোনো কিছুরই উদ্যোগ নেয়নি তৃণমূল সরকার। তাই রাজ্যের উন্নয়ন, এলাকার উন্নয়নের জন্য সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীদের জয়ী করার বার্তা ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে।
আগামীদিনে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশে উন্নয়নের কর্মকাণ্ডকে অব্যাহত রেখে সর্বস্তরের মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়াই প্রধানতম লক্ষ্য। জামুড়িয়া কেন্দ্রে এখন সেই লক্ষ্যপূরণের জন্যই চলছে নির্বাচনী লড়াইয়ের পথে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী ঐশী ঘোষের প্রত্যয়ী অভিযাত্রা।