৫৮ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৬ এপ্রিল, ২০২১ / ২ বৈশাখ, ১৪২৮
বিজেমূলের জমানা শেষ বীজপুরে
সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী সুকান্ত রক্ষিতের পাশে নাগরিকরা
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মানুষকে ভোট দিতে না দেওয়ার জমানা শেষ এখন বীজপুরে। মানুষ প্রতিরোধের জন্য তৈরি। মিছিল থেকে পথসভা সর্বত্র বামপন্থীদের পাশে থাকার জোরালো বার্তা যেভাবে মানুষ দিচ্ছেন তাতে একটা কথা পরিষ্কার, বিজেমূলের ঠাঁই নেই এবার এই কেন্দ্রে। মিছিল মিটিং পদযাত্রা এবং প্রচার পরিক্রমায় সংযুক্ত মোর্চার তরুণ সিপিআই(এম) প্রার্থী আইনজীবী সুকান্ত রক্ষিতের সমর্থনে যখন উত্তাল কাঁচরাপাড়া-হালিশহর তখন দলত্যাগী বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়কে নিয়ে হাসিঠাট্টা চরমে উঠেছে বীজপুরে। তিনি এখন জোড়া ফুল থেকে পদ্মফুলে। কি নিয়ে হাসিঠাট্টা? স্টেশন সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে জনাকয়েক তরুণের কথা থেকে উঠে এলো সেসব। দলবদলের কারণ হিসেবে এলাকায় মাইক ফুঁকে শুভ্রাংশু কিছুদিন আগে বলেছিলেন, বিজেপি’র সঙ্গে তাঁর একটা চুক্তি হয়েছে। বিজেপি যদি কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপে নতুন রেলের কারখানা তৈরি করাবে কথা দেয় তাহলেই তিনি বিজেপি-তে যাবেন! নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা নাকি তাতেই সায় দিয়েছেন! কিন্তু কোথায় কি? শুভ্রাংশুর মিথ্যাচার ধরা পড়ে গেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কাঁচরাপাড়ার রেলওয়ে কারখানায় এই অর্থবর্ষে মাত্র ১০০০ টাকা বাজেটে বরাদ্দ করায়। ওই যুবকদের সহাস্য জিজ্ঞাসা, বাজেটে এই নামমাত্র বরাদ্দের পরও শুভ্রাংশু কেন এখনও বিজেপি-তে? কেন এই মিথ্যাচার বারবার আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে? শুভ্রাংশু রায়ের বাবা মুকুল রায় যখন বিজেপি-তে গিয়েছিলেন তখন কেন এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন নি? তিনি কেন স্বীকার করছেন না সারদা-নারদায় সিবিআই’র থেকে বাঁচতেই গিয়েছিলেন!
আসল কথা হলো মিথ্যাচার ছাড়া আর কোনো পথ নেই শুভ্রাংশু বা তৃণমূল প্রার্থী সুবোধ অধিকারীর সামনে। কারণ উন্নয়নের কথা বলে ক্ষমতায় আসা এবং থাকার পর নতুন কিছুই আর বলার নেই তাঁদের। চাপানউতোর যতই চলুক ওদের মধ্যে, মোদ্দা কথা হলো, উন্নয়নই হয়নি। না, একেবারে হয়নি বললে ভুল হবে। শাসকদলের নেতা বিধায়কদের ব্যক্তি উন্নয়ন ছাড়া আর কিছু হয় নি বীজপুরে।
২০১১ সালে তৃণমূল জমানার শুরু থেকেই রাজ্য জুড়ে শুরু হয় তীব্র সন্ত্রাস। অন্য অনেক জায়গার মতো বীজপুরে যা ভয়াবহ মাত্রায় নিয়ে যান মুকুল রায়। বহু সিপিআই(এম) পার্টি অফিস, গণসংগঠনের কার্যালয় ভাঙা হয়, দখল করা হয়, লুট হয়। আক্রান্ত হন বহু বামপন্থী নেতা-কর্মী। প্রচারে মানুষকে এসব মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বামপন্থী ছাত্র-যুব আন্দোলনের নেতা বাম প্রার্থী সুকান্ত রক্ষিত। সচেতন কাঁচরাপাড়া হালিশহরের মানুষ সেসব মনেও রেখেছেন। তাই বলছেন, নিজের ভোট নিজে দিতে চাই। কারণ, ওই সময় এখানে বামপন্থীরা রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলেও রাস্তায় থেকেছেন মানুষের দাবি দাওয়া নিয়ে।
জমানার শুরুতে মানুষের মধ্যে সামাজিক বিভাজন আনার চেষ্টা করেছে তৃণমূল, এলাকার ক্লাবগুলি একতরফা হুমকি দিয়ে দখল করে। আটকে দেওয়া হয়েছিল নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যেমন, ২০১১ সালে ২৫ বৈশাখ প্রবাহ মাঠে চালু রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল তৃণমূল গুন্ডারা। বাংলা এবং বাঙালির যে সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানুষের মধ্যে ঐক্যের ভাবনা স্থাপন করে সেই পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী বা নজরুলজয়ন্তী - সমস্ত অনুষ্ঠানে বাধা দিতে শুরু করে তৃণমূল। তৃণমূলের এই ভূমিকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় হালিশহর কাঁচরাপাড়ার মানুষের মধ্যে।
এর পাশাপাশি ততদিনে কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপে নতুন রেলের কারখানা তৈরির মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতির ফানুস ফেটে গেছে। শিলান্যাসই সার। নেতাদের উৎসাহে চুরি হয়েছে কোটি কোটি টাকার স্ক্র্যাপ। জনগণ দ্রুত উপলব্ধি করেন মানুষের সঙ্গে তৃণমূল এতদিন প্রতারণা করেছে। এরপর আরও বারদু’য়েক শিলান্যাস হয় ওই একই কারখানায় - মুকুল রায় আর দীনেশ ত্রিবেদীর রেল মন্ত্রিত্বের জমানায়। সম্ভবত এই অভিনব কায়দায় যুবকদের কাজের অধিকার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নাম করে ছিনিমিনি আর প্রতারণার এহেন উদাহরণ ভারতে আর মিলবে না। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চালাচ্ছে এই বিজেমূলীরা।
হালিশহরের বিভিন্ন ওয়ার্ড পরিক্রমা করার সময় মানুষের অভিনন্দন আর সহমর্মিতায় আপ্লুত সুকান্ত মানুষকে তাই প্রেক্ষিত বুঝিয়ে বলছিলেন - আবার বামেদের পাশে এসে দাঁড়ান আপনারা, আমরা শান্তি সম্প্রীতি ফেরাব, সরকারের সমস্ত শূন্যপদে নিয়োগ হবে বেকার যুবদের। ওয়াকিবহাল ছাত্র-যুব, মহিলা সহ সর্বস্তরের মানুষ সুকান্তকে সাড়া দিচ্ছেন ইতিবাচক ভঙ্গিতে। বলা বাহুল্য এই ছবি এখন গোটা বীজপুর জুড়েই দেখা যাচ্ছে, শুধু হালিশহরে নয়।
কিন্তু যারা তখন গলার জোরে উন্নয়নের কথা বলেছিল তারাই দশ বছর পর পদ্ম শিবিরে গিয়ে বলছে কোনো উন্নয়ন হয়নি। মানুষ জানেন সবই। সুকান্তর কথায়, মানুষের কাছে ওই মুখগুলোর তাই কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। ওরা বিকল্প দেখতে পেয়েছে আমাদের মধ্যে। মানুষ আরও দেখেছেন, যে মানুষগুলো বামপন্থীদের পতাকা নিয়ে রাস্তায় ছিল আজও সেইখানেই তারা গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের পাশেই আছে।
লকডাউনের সময় গোটা রাজ্যের মতোই এখানেও বামপন্থীরা মানুষের পাশে থেকেছে। সেকথা মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। রক্তের কার্ড থেকে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া - সবকাজেই মানুষ ডাকলেই সাড়া পেয়েছেন। সারাদিন তৃণমূলের কাছে ঘুরলেও দিনের শেষে রক্তের কার্ডটা সাধারণ মানুষ আমাদের কাছেই চায় - বলছেন সুকান্ত রক্ষিত। তারা বলেন, তোমরা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না।
নিকাশি নিয়ে বীজপুরে মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। বিধানসভা এবং পুরসভায় তৃণমূলের আমলে হালিশহরে পুকুরের পর পুকুর ভরাট হয়েছে। জোর করে সাধারণ মানুষকে জমি নামমাত্র মূল্যে বেচতে বাধ্য করা হয়েছে। বদলে ফেলা হয়েছে জমির কাগজপত্র। বিধানসভা এলাকা জুড়ে পার্টিকর্মী থেকে সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সরকারের বিভিন্ন জমি সংক্রান্ত দপ্তরের সঙ্গে যোগসাজশ করে বা উৎকোচ দিয়ে বদলে ফেলা হয়েছে জমির চরিত্র। একাজে যুক্ত থাকার দায়ে অপরাধ জগতের সঙ্গে একাধিক কাউন্সিলরের যোগ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে লেখা হয়েছে ধারাবাহিক প্রতিবেদন। রাতারাতি পুকুর ভরাট হয়ে বাস্তুতে পরিণত হয়েছে সেসময়। আর এত বেশি সংখ্যায় পুকুর ভরাট হওয়ার ফলে আজকের হালিশহরে নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এখন অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তায় জল জমে যায়। হালিশহর জুড়ে এরকম প্রচুর অভিযোগ মানুষের মধ্যে। পেশায় আইনজীবী সুকান্ত বলছেন, সংযুক্ত মোর্চার সরকার এলে প্রতিটি অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্ত করে সত্য খুঁজে বার করা হবে, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে।
একথা সবাই এখন জানেন যে, বীজপুর এলাকার একাধিক চটকল তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক এবং সাংসদ অর্জন সিং ও তাঁর পেটোয়া দালালের ইচ্ছা অনুযায়ী বন্ধ হয়েছে এবং খুলেছে শ্রমিক স্বার্থের পরোয়া না করেই। রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ চটকল হুকুম চাঁদ জুট মিল এবং নৈহাটি জুটমিলে চলছে ঠিকাদাররাজ। শ্রমিকরা সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকেন কারণ কর্মরত শ্রমিকরা কাল কাজ পাবেন কিনা জানেন না। নেই ন্যায্য মজুরি। চটকল শ্রমিকদের বেতনের অর্ধেক আত্মসাৎ করে শাসকদলের দালাল এবং কন্ট্রাক্টররা। তোলাবাজির জেরে চূড়ান্ত শোষণের শিকার তাঁরা। অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বুঝেছেন প্রাপ্য বুঝে নিতে হলে বামপন্থীদের সঙ্গে থাকতে হবে, কারণ তাঁরাই শ্রমিকের মজুরির দাবিতে রাস্তায় থাকেন। এই ভাবনা থেকেই বিগত দিনের শিল্প ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন শ্রমিকরা মালিক-সাংসদ-বিধায়কের বিরুদ্ধে গিয়ে। শ্রমিক মহল্লাগুলিতে সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থীকে সমর্থনের নিশ্চয়তা তাই সোচ্চারে বলছিলেন খেটে খাওয়া মানুষেরা।
হাজিনগর ২০১৯ সালের একটা বড়ো অংশ জুড়ে খবরের শিরোনামে ছিল। রামনবমীর একটি উস্কানিমূলক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাজিনগরে যে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটে তা বাংলার মানুষের অভিজ্ঞতার অতীত ছিল। অথচ মূলত মিল শ্রমিকদের বসতি এই হাজিনগর। যেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষী এবং ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থেকেছেন আজীবন। সে সময় তৃণমূল, এখন যিনি পদ্ম শিবিরের সাংসদ - তাঁর ভূমিকা, বাচনভঙ্গি এবং কাজকর্ম সম্পর্কে মানুষের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ বামপন্থী নেতৃত্বকে বলছেন, আমরা শান্তিতে দু’টো রুটি খেতে চাই। সরাসরি বলছেন, সাম্প্রদায়িক হানাহানির পরিস্থিতি উস্কে দিয়েছিলেন অর্জুন সিং-রা। তাঁরা সুকান্তকে বলেছেন ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় যখন জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সেসময় একটা টোকা পর্যন্ত এখানকার মানুষের গায়ে লাগেনি। এ কেমন সরকার এলো এখানে? এদের সরাতে হবে। বামপন্থীদের পাশে পেয়ে হাজিনগর সংলগ্ন এলাকাজুড়ে এখন মানুষের চোখে মুখে আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার ছবি। তারা বলেছেন আগেও যেমন শান্তিতে থাকতাম, বামপন্থীরা ফিরলেই আমরা তেমন শান্তিতে থাকতে পারবো - তাই আপনারা আসুন, আমরা আপনাদের পাশে আছি।