৫৮ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৬ এপ্রিল, ২০২১ / ২ বৈশাখ, ১৪২৮
মুর্শিদাবাদ
বাম মোর্চার সমর্থনে প্রচার এগিয়ে চলেছে
মহম্মদ সামসুজ্জোহা
ভগবানগোলা বিধানসভা কেন্দ্রটা আগাগোড়া বামেদের প্রাধান্য বলা যেতে পারে। এই কেন্দ্রে প্রথম দিকে সোসালিস্ট পার্টির প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিলেন, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে নির্দল প্রার্থী জেতেন। তার পর থেকে টানা বামেরা জিতে আসছে। মাঝে একবার মাত্র কংগ্রেস জিতেছিল। তারও আগে একবার মুসলিম লিগ। গত চারটি বিধানসভায় বাম প্রার্থীরা এই কেন্দ্র থেকে জিতে আসছেন। সোসালিস্ট পার্টির প্রার্থী তৃণমূলে চলে গেলে ২০১৬ সালে আসনটি সিপিআই(এম) পুনরুদ্ধার করে। দলীয় প্রার্থী মহাসিন আলি গত বিধানসভায় লক্ষাধিক ভোটে জয়লাভ করেন।
জেলায় সিপিআই(এম)-এর চারজন প্রার্থী জিতলেও দল ছেড়ে তৃণমূলে চলে যায় নবগ্রাম এবং জলঙ্গী বিধানসভার বিধায়করা। ডোমকলের আনিসুর রহমান এবং ভগবানগোলার মহাসিন আলি পার্টিকেই আঁকড়ে থাকেন। ভগবানগোলা কেন্দ্রে পার্টি এবারে এলাকার যুবনেতা কামাল হোসেনকে প্রার্থী করেছে। কংগ্রেস, আইএসএফ এবং বামপন্থীদের প্রচার কর্মসূচি নিয়মিত চলছে। অনেক আগেই দেওয়াল লেখার কাজ শেষ হয়েছে। পথসভা, রোড শো, গ্রাম বৈঠকগুলি যৌথভাবেই চলছে। ভগবানগোলা বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী বহিরাগত - কলকাতার বাসিন্দা। এ কারণে যারা প্রার্থী হবার প্রত্যাশী ছিলেন তারা হতাশ হয়ে অন্তর্কলহে লিপ্ত। তবুও বহিরাগত প্রার্থী টাকার জোরে ফ্লেক্স হোর্ডিং এইসব দিক দিয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও সামগ্রিকভাবে মোর্চার যৌথকর্মসূচি অনেক এগিয়ে আছে। এখন দেখার মানুষ কী রায় দেয় ইভিএমে ২৬ এপ্রিল, আর সেটা জানা যাবে ২ মে ২০২১ তারিখ।
সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী কামাল হোসেনের সমর্থনে জনসভা। স্থান ভগবানগোলা ভুরা বাবুর বাগান। ১২ এপ্রিল সকাল ১০ টায় নির্বাচনী জনসভা হয়। বক্তা সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। নীলোৎপল বসু বলেন, নির্বাচনে এ রাজ্যে হিংসা হচ্ছে, বলি হচ্ছে, রক্তাক্ত নির্বাচন হচ্ছে, অথচ গণতন্ত্রে হিংসার কোনো জায়গা নেই। হিংসা এখানে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্পোরেটদের দ্বারা পরিচালিত তৃণমূল, বিজেপি। লকডাউনে ১৫ কোটি লোক কাজ হারিয়েছে। আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি। রাজ্য সরকার কোনো দায়িত্ব নেয়নি। চাকরির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গেলে পিটিয়ে মেরে দিচ্ছে। কর্মসংস্থানের কথা, মানুষের জীবন-জীবিকার কথা বলছে না। সব জিনিসের দাম বেড়ে চলেছে। সারের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়িয়েছে। ভোট চলাকালীন ওষুধের দাম ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। জলের দামে কর্পোরেটদের হাতে সবকিছু তুলে দিচ্ছে। ঘুরপথে সেই টাকা বিজেপি’র হাতে চলে আসছে। ৩৪ বছরের বাম জমানায় একজনও বিজেপি’র এমপি, এমএলএ ছিল না। তৃণমূল বিজেপি-কে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে। তৃণমূলের গোটা দলটাই বিজেপি হয়ে গেল। আর ওরা বলছে নাকি বিজেপি-কে ঠেকাবে। সব কিছু বেসরকারি হয়ে যাচ্ছে। এতে গরিব মানুষের ক্ষতি হবে। সংযুক্ত মোর্চাই একমাত্র বিকল্প। তাই সংযুক্ত মোর্চাকে শক্তিশালী করতে হবে।
অধীর চৌধুরী বলেন, মুর্শিদাবাদের মানুষকে মুখ্যমন্ত্রী ধাপ্পা দিয়েছে, ভুল বুঝিয়েছে। এই জেলার মানুষের অনেক প্রশ্ন আছে। বিজেপি-র সাথে জোট বেঁধেছিল কে? তার উত্তর মুখ্যমন্ত্রীকে দিতে হবে। তিনি বলেছিলেন, বিজেপি আমার কাছে অচ্ছুত নয়। আরএসএস দেশভক্ত। গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমান খুন হন। তখন মমতা কয়লামন্ত্রী ছিলেন, কোনো প্রতিবাদ করেননি। মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় এসে বাম, কংগ্রেসকে দুর্বল করে বিজেপি’র উত্থান ঘটিয়েছেন। যত বেশি বাম কংগ্রেস দুর্বল হবে, তত বেশি বিজেপি-র বৃদ্ধি ঘটবে। ধর্মনিরপেক্ষতা বাম-কংগ্রেস-সংযুক্ত মোর্চার মূল লক্ষ্য। মমতা ব্যানার্জি বাম-কংগ্রেস নেতাদের নামে অজস্র মিথ্যা কেস সাজিয়েছে। ইমাম ভাতা, মোয়াজ্জেম ভাতা দিয়ে মুসলমানদের হিন্দুদের কাছে শত্রু বানিয়েছে। মুসলিমরা এই ভাতা তাঁর কাছে চায়নি। আর এটা ওয়াকফ বোর্ডের টাকা। মাছের তেলে মাছ ভেজে বাজিমাত করতে গিয়ে বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত করেছে মমতা ব্যানার্জি।
পুরোহিত ভাতা দিচ্ছে রাজকোশ থেকে। দুর্গাপুজোকে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছে। বাম-কংগ্রেস মানুষের রাজনীতি করে। ধর্মের রাজনীতি করে না। বাংলায় মুসলমানদের চরম ক্ষতি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রচার করেছে অধীর চৌধুরী বিজেপি হয়ে গেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেস-বামেদের মনোনয়ন দিতে দেয়নি অথচ বিজেপি-কে কোনো বাধাই দেয়নি।
বিজেপি এবং তৃণমূল একই ফুল। দিদির সেনাপতি নন্দীগ্রামে দিদিকে খতম করতে গেছে। তৃণমূল বিজেপি কেউই মানুষের জীবনযন্ত্রণার কথা বলে না। নির্বাচনের মধ্যে রাজ্যে ১৩জন মানুষ মারা গেলেন। সর্বপ্রথম নির্বাচন কমিশনে আমরা অভিযোগ দায়ের করেছি। মুর্শিদাবাদে হিন্দু মুসলমান একসাথে বড়ো হয়েছি, উৎসব পালন করেছি। অমিত শা আর মোদী আলাদা কিছু নয়। বেকারের হার পশ্চিমবাংলায় সবচেয়ে বেশি। আমরা রুটি চাই, রুজি চাই, শিল্প চাই, শান্তিতে বসবাস করতে চাই, নিরাপত্তা চাই। ভিক্ষা চাই না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে চাই।
লালগোলা বিধানসভা কেন্দ্রে ৬ বারের জেতা প্রার্থী আবু হেনা এবারেও প্রার্থী হয়েছেন। এই কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস জমানায় আব্দুস সাত্তার কৃষিমন্ত্রী হয়েছিলেন। সে সময় তিনি এলাকার বহু মানুষকে দলমত নির্বিশেষে চাকরি দিয়েছিলেন। বাম আমলে তিনি বিরোধী দলনেতা ছিলেন। সেই অবস্থাতেই মারা যান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য করে বাম সরকার। তারপর ১৯৯১ সাল থেকে টানা ৬ বার তাঁর ছেলে আবু হেনা জিতে আসছেন। গত ২০১৬ সালে বামেরা তাঁকে জিতিয়েছিলেন। ২০২১ সালেও লালগোলার বামদলগুলি যৌথভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। সিপিআই(এম), আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক এবং কংগ্রেস মিলে ব্লক কমিটি, অঞ্চল কমিটি এবং বুথ কমিটি গঠন করে নির্বাচনের কাজ চলছে। দেওয়াল লিখন অনেক আগেই হয়ে গেছে। এখন পথসভা, রোড শো, গ্রাম বৈঠক এবং বাড়ি বাড়ি প্রচার চলছে। ওয়াকিবহাল সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে, এবারেও মোর্চার সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী আবু হেনা জিতবেন। আবার তৃণমূলের প্রার্থী বহিরাগত। এই বিধানসভা এলাকার যারা তৃণমূল নেতা-কর্মী প্রার্থী হবার আশা করেছিলেন, তা না হতে পেরে বহিরাগত প্রার্থীর হয়ে গা ঘামিয়ে কাজ করছেন না। সিপিআই(এম)’র জেলা নেতা তুষার দে, বদরুদ্দোজা খান এরা নিয়মিত এলাকায় আসছেন। স্থানীয় নেতা জোহাক আলি, কামরুজ্জামানরা নিবিড় প্রচারে আছেন। প্রার্থীকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচার চালাচ্ছেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের গোলাম বিশ্বাসও নিয়মিতভাবে মোর্চা প্রার্থীর হয়ে কাজ করছেন।
১০ এপ্রিল ডোমকলে সংযুক্ত মোর্চার সভা হয়। প্রধান বক্তা ছিলেন অধীর চৌধুরী। এখানে মোর্চার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের সমর্থনে সভায় তৃণমূলের অপকর্মের কথা তুলে ধরা হয়। ডোমকল পৌরসভায় তৃণমূল কীভাবে লেঠেল বাহিনী দিয়ে ভোট লুঠ করেছে তা আলোচনায় উঠে আসে।
এখানে প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়াও জলঙ্গী কেন্দ্রের মোর্চার প্রার্থী সাইফুল ইসলাম মোল্লা, রানিনগর কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী ফিরোজা বেগম সহ স্থানীয় সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। তাছাড়াও এদিন মুর্শিদাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রের সংযুক্ত মোর্চার সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী নিয়াজুদ্দিন সেখকে নিয়ে একটা রোড শো করেন অধীর চৌধুরী। তিনি বলেন ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে সন্ত্রাস করে মমতা জিতেছিলেন। বিরোধীশূন্য করার জন্য ২০ হাজার আসনে প্রার্থী দিতে দেওয়া হয়নি। সন্ত্রাসে শতাধিক মানুষ নিহত হন! এবার মমতার বিদায় নেবার পালা।