E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৬ এপ্রিল, ২০২১ / ২ বৈশাখ, ১৪২৮

পরিবেশ আলোচনা

চিকিৎসা বিজ্ঞানকে পঙ্গু করেছে মোদী সরকার

তপন মিশ্র


নামে ‘আয়ুষ্মান ভারত’, কাজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে মোদী সরকার। ২০২১ সালের নির্মলা সীতারমনের বাজেট বক্তৃতা যদি শুনে থাকেন বা পড়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে দেখে থাকবেন যে, এবারে এদেশে চিকিৎসা গবেষণার জন্য সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ ২,৬৬৩ কোটি টাকা। গত বাজেটে এই পরিমাণ ছিল ৪,০৬২ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো, চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় এই মহামারীর সময়েও প্রায় ৩৪.৪ শতাংশ কম অর্থ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকার মনে করছে যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য দেশের সরকারের দায়িত্ব কমছে। করোনা ভ্যাক্সিন গবেষণায় মোদীজির যে তৎপরতা দেখছেন তা লোকদেখানো বৈ কিছুই নয়। বেসরকারি সংস্থাকে সামনে রেখে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি গবেষণা সংস্থাগুলিকে অকেজো করে রেখেছে মোদী সরকার। কোভিড টিকা সংক্রান্ত গবেষণায়, কোভ্যাকসিন হোক বা কোভিশিল্ড, যে সংস্থাগুলি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে সেগুলি হলো বেসরকারি সংস্থা। এদেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সকল ক্ষেত্রেই অন্য বিকাশশীল দেশের তুলনায় আনুপাতিকভাবে অনেক কম তহবিল বরাদ্দ হয়ে থাকে। এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ছাড়া কোনো জাতি অগ্রসর হয় না। আসলে, অনেক দেশ বৈজ্ঞানিক প্রতিভা আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। আমাদের দেশের মেধা তার শিকার হয়।

আমাদের দেশে আইসিএমআর (Indian Council of Medical Research বা ICMR)-ই সরকারি বিজ্ঞান গবেষণার মূল কারিগর। এই গবেষণা সংস্থার দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধি ঘটার পরিবর্তে ধারাবাহিকভাবে অবনতি ঘটেছে। করোনাকালে যখন অন্যান্য দেশ চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে তখন আমাদের দেশে আইসিএমআর-এর জন্য বরাদ্দ কমেছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তখনকার চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে পরিকাঠামো ছিল তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গবেষণার চাহিদা এবং সরকার যে অর্থ বরাদ্দ করেছে সেদিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, এই ব্যবস্থাকে কতটা দুর্বল করার পরিকল্পনা নিয়েছে মোদী সরকার।

ইকোনমিক টাইমসের ‘ET Health world’-এর তথ্য বলছে যে, ২০১৪-১৫ সালে আইসিএমআর-এর চাহিদা ছিল ২৫৮১.৫ কোটি টাকা কিন্তু বাজেট বরাদ্দ হয় মাত্র ৭২৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৩.৫ ভাগের এক ভাগ। এই চাহিদা কেবল তৎকালীন ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। গবেষণার গলা টিপে মারার জন্য সরকার যেন উঠে পড়ে লেগেছে। পরের বছর চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও বরাদ্দ ছিল আরও কম অর্থাৎ ৭১৩.১৭ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ সালে চাহিদার মাত্র ৫০ শতাংশ অর্থ সরকার বরাদ্দ করে। ১২তম প্লান রিপোর্টে বলা হয় যে, এই ব্যয় হ্রাস দেশের স্বাস্থ্য গবেষণা এবং রোগের বোঝার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অবস্থার উন্নতির জন্য তারা সুপারিশ করেন যে, উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নীতি নির্ধারকদের স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা এবং এর জন্য এমন গবেষণার ভিত্তির প্রয়োজন যা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করবে।

ফলে বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ আমাদের দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রথমত, বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজগুলিতে সে সরকারি বা বেসরকারি হোক, উভয়ক্ষেত্রেই অভাব রয়েছে ন্যূনতম গবেষণা পরিকাঠামো এবং সুবিধার। দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত প্রশিক্ষিত গবেষকদের অভাব দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধঃপতনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এমনটা নয় যে, ভারতীয়দের মধ্যে গবেষণার মেধার অভাব রয়েছে। ইয়োরোপ এবং আমেরিকায় অগুণতি খ্যাতনামা ভারতীয় গবেষক কাজ করছেন। এদের আকৃষ্ট করার মতো সরকারি ব্যবস্থা এদেশে তৈরিই করা হচ্ছেনা। তৃতীয়ত, আধুনিক গবেষণা পদ্ধতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষিত করাও একটি বড়ো চাহিদা, যা পূরণ করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো হেলদোল নেই। চতুর্থত, আধুনিক গবেষণার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিভিন্ন ধারার বিজ্ঞান (multidisciplinary science)-কে একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা এবং সমন্বিত গবেষণা উৎসাহিত করা।

গবেষকদের সংখ্যার বিচারে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হলো আমাদের দেশ। অপ্রতুল গবেষণা তহবিল, পরিকাঠামোর অভাব, তথ্য জোগাড়ের সমস্যা এবং গবেষণার উপকরণ সংগ্রহের নানান বাধা আমাদের পিছনে হাটতে বাধ্য করেছে। এখানেই সরকারের অনেক কিছু করার রয়েছে। ইউপিএ সরকারের আমলে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য গবেষণার বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়। এখানে আইসিএমআর কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগের বিষয়টিও আলোচিত হয়। কমিটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে হেপাটাইটিস, কালাজ্বর, ফিলারিয়াসিস ইত্যাদির মতো রোগ নির্মূলের জন্য গবেষণা প্রকল্প গ্রহণের কথা বলে। কিন্তু সেই সুপারিশ এখন ঠান্ডা ঘরে।

নতুন নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মোদী সরকারের কোনো জুড়ি পাওয়া ভার। পর পর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বন, পরিবেশ সব ক্ষেত্রেই একদিকে হিন্দুত্বের আদর্শ, অন্যদিকে কর্পোরেট তোষণের নতুন নীতি প্রণয়ন করছে এই সরকার। যেমন ১৯১৭ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি এদেশে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে জীবনদায়ী ঔষধ কম খরচে পৌছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বিগত বছরগুলিতে জীবনদায়ী ওষুধের দাম সরকারি উদ্যোগে বেড়েই চলেছে। একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে হেপারিন ইনজেকশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির আবেদনে সাড়া দিয়ে গত ডিসেম্বরেই সরকার ইনজেকশনের দাম ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি রক্ত তরল রাখতে সাহায্য করে। কয়েকদিন আগে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্য দরকারি ক্লোরোকুইন, কুষ্ঠর জন্য ডাপ্সন, বিসিজি’র টিকা ইত্যাদির দাম বাড়ানো হয়েছে। এই ওষুধগুলি জরুরি এবং জীবনদায়ী ওষুধ হিসাবে পরিচিত। এগুলির দাম সরকারের National Pharmaceutical Pricing Authority (NPPA) নির্ধারণ করার কথা। এনপিপিএ বলছে যে, এই ওষুধ তৈরির উপাদান (active pharmaceutical ingredients বা APIs) চীন দেশ থেকে আসে। তাহলে এই আত্মনির্ভর দেশে গবেষণার মধ্য দিয়ে এপিআই তৈরির গবেষণা করা যাচ্ছে না কেন? এখান থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, দ্বিচারিতা ফাসিস্টদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য।