E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

দার্জিলিঙে বাগিচা শ্রমিক ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সম্মেলন

বাগিচা শিল্প ও শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় আন্দোলনের ডাক


সম্মেলন উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বাগিচা শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষদের ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্য,পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে সারা ভারত বাগিচা শ্রমিক ফেডারেশন (এআইপিডব্লিউএফ)। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ফেডারেশনের দশম সম্মেলন থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। এই সম্মেলন থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, বাগিচা শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য জমি দখলের সরকারি ও করপোরেট সংস্থাগুলির নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে আগামীদিনে বাগিচা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আরও জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গত ১ ও ২ ডিসেম্বর দার্জিলিঙের জিমখানা ক্লাবে এই সম্মেলন হয়েছে।

দু’দিন ব্যাপী এই সম্মেলন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে - আগামী ৫ এপ্রিল দিল্লিতে বাগিচা শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড়ো বাগিচা শ্রমিকদের সমাবেশ সংগঠিত করা হবে।

লাল পতাকার দৃপ্ত মিছিলের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় এই সম্মেলনের। ১ ডিসেম্বর শৈলশহর দার্জিলিঙের হেরিটেজ রেল স্টেশনের সামনে থেকে সকাল দশটা নাগাদ নানা ভাষাভাষী সহস্রাধিক বাগিচা শ্রমিকের এক বর্ণাঢ্য মিছিল শহরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে জিমখানা ক্লাবের সামনে এসে শেষ হয়। ঐতিহ্যবাহী সাজে মহিলারা মিছিলে অংশ নেন এবং তাঁরা মিছিলের পথে পথে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাথে তামাঙ নৃত্য পরিবেশন করেন। বিভিন্ন এলাকার মানুষ ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা পাহাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিলকে অভ্যর্থনা জানান। গোটা দেশের প্রতিনিধিদের সাথে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিক প্রতিনিধিরাও যোগ দিয়েছিলেন মিছিলে। এছাড়াও অংশ নিয়েছিলেন পার্বত্য অঞ্চলের সমস্ত আঞ্চলিক ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, একসময় যারা লাল ঝান্ডার বিরোধিতা করেছিল, এমন অনেকেই এদিন নিজেদের জীবিকার তাগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিলেন লালা ঝান্ডার মিছিলে।

প্রসঙ্গত, ৫০ বছর আগে, ১৯৭২ সালে, আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের পরিবেশে কমরেড রতন লাল ব্রাহ্মণ, কমরেড আনন্দ পাঠক, কমরেড এসপি লেপচা প্রমুখের নেতৃত্বে এই দার্জিলিং শহরেই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সাক্ষী রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাগিচা শ্রমিকদের এই নিজস্ব সংগঠন। প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এখানেই।

সম্মেলন শুরুর আগে শ্রমিকদের মিছিল।

ঐক্য ও সংগ্রামের গৌরবময় ৫০ বছরে শ্রমজীবীদের অধিকার অর্জনে, নতুন উদ্যমে প্রত্যয়ী শপথ নিতে সেদিন হাজারো বাগিচা শ্রমিক দার্জিলিং রেল স্টেশন থেকে রক্ত পতাকা নিয়ে উদ্দীপ্ত স্লোগান মুখরিত মিছিলে শহর পরিক্রমা করে সম্মেলন স্থলে উপস্থিত হন। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন সিআইটিইউ'র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, সভাপতি কে হেমলতা, যুগ্ম সম্পাদক এ আর সিন্ধু, সারা ভারত কিষান সভার কোষাধ্যক্ষ কৃষ্ণ প্রসাদ, এআইপিডব্লিউএফ'র সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল আলম, সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু সহ শ্রমিক নেতা সমন পাঠক, কে বি ওয়াতার, গৌতম ঘোষ, সুদীপ দত্ত প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন শ্রমিক সংঘের লক্ষ্মণ প্রধান, দার্জিলিং তরাই ডুয়ার্স চিয়াকামান মজদুর ইউনিয়নের সুনীল রাই, হামরো পার্টির শ্রমিক সংগঠনের ডিকে গুরুঙের মতো অনেকেই। এদিন জমির পাট্টার দাবি, ন্যূনতম মজুরির দাবি সহ মজদুরদের জীবন ও জীবিকা সহ বিভিন্ন দাবিতে উত্তাল হয় শহর দার্জিলিং।

মিছিল শেষে সমবেত শ্রমজীবী মানুষদের সামনে তপন সেন বলেন,সারা দেশের বাগিচা শ্রমিকদের লড়াই আন্দোলনের বহু পুরনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই দার্জিলিং। সংগঠনের প্রথম সম্মেলন এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিগত ৫০ বছরে অনেক লড়াই আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ইতিহাস গড়ে উঠেছে। সারা দেশের প্রতিটি প্রান্তে সংগ্রাম জারি রয়েছে। তিনি বলেন, বাগিচা শ্রমিকরা শুধু নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করছেন না। তাঁরা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষদের উন্নয়ন এবং অধিকার ও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই করে চলেছেন।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বিগত কয়েক দশক ধরে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি লাল ঝান্ডার মিছিল অথবা সিপিআই(এম)’র যে কোনও প্রকাশ্য কর্মসূচি সংগঠিত করতে সর্বাত্মক বাধা তৈরি করেছে। ফলে কিছু নির্বাচনী কর্মসূচি ছাড়া রক্ত পতাকার সংগঠিত কাজকর্ম করা সম্ভব হয়নি।

১ ডিসেম্বর মিছিল শেষে সংগঠনের রক্ত পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়।

এআইপিডব্লিউএফ’র দশম সম্মেলন উদ্বোধন করেন সিআইটিইউ’র সর্ব ভারতীয় সভানেত্রী কে হেমলতা। তিনি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, দেশি-বিদেশি মালিকদের স্বার্থে কাজ করে চলেছে কেন্দ্রের সরকার। করপোরেট-একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিচালিত এই সরকার শ্রম আইন পরিবর্তন করে শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত অধিকার প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গেও সন্ত্রাস কায়েম করে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনকে ভাঙার চেষ্টা চলছে। শ্রমিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কোনো ফারাক নেই। তিনি বলেন, উদারনীতিতে আক্রান্ত সমস্ত ক্ষেত্র। রুজি-রোজগারে টান ধরেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারিকরণের চেষ্টা চলছে। চা শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আজও মিলছেনা। অথচ কাজের বোঝা বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।

প্রতিনিধি সম্মেলনের আগে সম্মেলন মঞ্চে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তপন সেন, কৃষ্ণ প্রসাদ। সম্মেলনে আগত সবাইকে স্বাগত জানান জিয়াউল আলম। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন হামরো পার্টির অজয় এডওয়ার্ড, গোর্খা লিগের লক্ষ্মণ প্রধান, সিপিআরএম’র সুনীল রাই, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সুরজ সুব্বা সহ আরো অনেকে।

কেরালা, তামিলনাডু, অসম, ত্রিপুরা, কর্ণাটক সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৩০ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন সংগঠনের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল আলম। কে হেমলতা, সি কে উন্নিকৃষ্ণন, সুখমইত ওঁরাও এবং দীনেশ নায়েককে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী সম্মেলনের কাজ পরিচালনা করে।

সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে তপন সেন বলেন, দেশের চা, রবার, কফি নিয়ে সমগ্র বাগিচা শিল্পের সাথে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ। সারা দেশেই এই বাগিচা শিল্পের জমিগুলো দখলের মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এই জমি দখলের অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতে হবে। বাগিচা শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা সোসাইটিগুলির ছেলেমেয়েদের শিক্ষা,উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান, রাস্তাঘাট সহ পরিকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বাগিচা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের জমির অধিকার, ন্যূনতম মজুরি এবং অন্যান্য অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।

সম্মেলনে সারা ভারত কিষান সভার কোষাধ্যক্ষ কৃষ্ণ প্রসাদ সাম্প্রতিককালের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনার পাশাপাশি কৃষক-শ্রমিক যৌথ আন্দোলনের ওপর জোর দেন।

ঐক্য ও সংগ্রামের ৫০ বছরে এআইপিডব্লিউএফ তার দশম সম্মেলন আগামীদিনে দেশজুড়ে লড়াই-আন্দোলনের নতুন দিশা দেখাবে - এই প্রত্যয় নিয়ে সম্মেলন মঞ্চ থেকে সংগঠনের নতুন কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। সম্মেলন থেকে ৪৬ জনের নতুন সর্বভারতীয় কমিটি এবং ১৭ জনের কার্যকরী কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে সি কে উন্নিকৃষ্ণন, সাধারণ সম্পাদক পদে জিয়াউল আলম এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন অসিত দত্ত।

এআইপিডব্লিউএফ’র অন্যতম নেতা ও সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি সমন পাঠক এই সম্মেলনের তাৎপর্য ব্যখ্যা করে বলেন, ২০০৬ সালের ২২ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আক্রমণ ও বাধাদানের জন্য পার্টির জেলা সম্মেলন জিমখানা ক্লাব থেকে সরিয়ে শিলিগুড়ি শহরে আয়োজন করতে হয়েছিল। অথচ, আজকের দিনে সেই জিমখানা ক্লাবেই দার্জিলিং শহরে সমাজের নানান অংশের মানুষের সার্বিক সহযোগিতায় সারা ভারত বাগিচা শ্রমিক সংগঠনের দশম সম্মেলন সফলতার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলো। পরিস্থিতির এই গুণগত পরিবর্তন আগামীদিনে পাহাড়ে লাল ঝান্ডার সংগঠন প্রসারে নিশ্চিতভাবেই সহায়ক হবে।

এআইপিডব্লিউএফ’র সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল আলম সম্মেলন শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে সংগঠনের ৫০ বছরের দীর্ঘ পথচলার তাৎপর্য বাখ্যা করেন। তিনি বলেন, সারা দেশে বাগিচা শিল্প হিসেবে চা, কফি, রবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই সমস্ত শিল্পে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমজীবী মজদুর, কর্মচারী, অফিসার, ম্যানেজার প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ এই বাগিচা শিল্পের সাথে যুক্ত থেকে দিন গুজরান করছেন। এই শিল্পের শ্রমিকরা বহু পরিশ্রম করে উৎপাদনের কাজ চালিয়ে গেলেও মুনাফা লুটছে মালিকপক্ষ। অন্যদিকে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বাগিচা শ্রমিকেরা। তিনি এ রাজ্যের চা শিল্পের সংকটের কথা তুলে ধরে বলেন, চা বলয় জুড়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে। চা বাগানগুলিতে পানীয় জল, ওষুধপত্র সহ ন্যূনতম পরিষেবা মিলছে না। বাগিচা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আজও কার্যকর করতে পারছেনা সরকার। ফলে বাগিচা শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারেরই দীর্ঘ বঞ্চনার শিকার বাগিচা শ্রমিকরা। লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাগিচা শ্রমিকদের অধিকার ও দাবি আদায় করতে হবে।