৬০ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
সংবিধান দিবস পালনের ছুতোয় সংবিধানকেই নস্যাৎ করছে আরএসএস এবং তার দলবল
শ্রুতিনাথ প্রহরাজ
হিন্দুরাষ্ট্র ও হিন্দুত্বের দর্শন প্রচার ও প্রসারে মরিয়া বিজেপি তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ নয়া শিক্ষানীতিকে হাতিয়ার করে সুকৌশলে এগোনোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব বাড়িয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের বিশেষত উচ্চশিক্ষায় দখলদারি সুনিশ্চিত করছে। আইআইটি, আইআইএম, আইআইএসসি, আইসিএইচআর সহ সমস্ত কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান, ইতিহাস গবেষণা ও অন্যান্য আধুনিক মানের উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এখন নিয়ন্ত্রণ করছে আরএসএস। তাদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কাজে লাগাচ্ছে এইসব শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে। ইউজিসি-কে কাজে লাগিয়ে একের পর এক হিন্দুত্ববাদী ফরমান জারি করা হচ্ছে এবং এই কাজ ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউজিসি-র মাথায় বসানো হয়েছে একসময়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলনের ওপর দমন পীড়ন নামিয়ে আনা কুখ্যাত প্রাক্তন উপাচার্য জগদীশ কুমারকে।
সম্প্রতি ইউজিসি এমনই এক ফরমান জারি করে ৪৫টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৪৫টি ডিমড বিশ্ববিদ্যালয়কে গত ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবস পালনের নির্দেশ দেয়। একইসাথে পক্ষকাল ব্যাপী ‘ভারতবর্ষ গণতন্ত্রের পীঠস্থান’ শীর্ষক নানা বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করার কথা বলে। এ বিষয়ে ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পর্ষদের (আইসিএইচআর) তৈরি করা একটি নোট গাইডলাইন হিসেবে সাথে দেওয়া হয়। রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই নোট সরাসরি না পাঠিয়ে তা দেওয়া হয় বিজেপি নিযুক্ত রাজ্যপালদের হাতে। বলা হয় তারা যে বিদ্যালয়গুলির আচার্য, সেখানে যাতে এই নির্দেশ পালন করা হয় তা দেখবার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নস্যাৎ করে রাজ্যগুলিকে এড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করার এও এক কৌশল যা বিজেপি আগাগোড়া করে চলেছে।
ইউজিসি-র এই ফরমান নিয়ে শিক্ষা মহলে বিস্তর বিতর্ক শুরু হয়েছে। আপাত নিরীহ ‘সংবিধান দিবস’ পালন করা নিয়ে কোনো বিতর্ক না থাকলেও তার অনুষঙ্গ হিসেবে যে আলোচনার বিষয়গুলি জোড়া হয়েছে তা যে হিন্দুত্বের দর্শন প্রচার ও প্রসার করবার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। আরএসএস, যারা সৃষ্টিলগ্ন থেকে ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী এবং মনুস্মৃতিকে ভারতীয় সংবিধান হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষপাতী, তারা যখন সংবিধান দিবস পালনে উদ্যোগী হয়, তখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক এই কর্মসূচির আড়ালে তাদের আসল উদ্দেশ্য কি? গত আট বছরে বিজেপি সরকার সংবিধানকে এতটুকু মান্যতা দেয়নি। ভারতীয় সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ - ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক ন্যায় চরম বিপন্ন হয়েছে এই সময়ে। সেই সরকার ও তার পেছনে থাকা আরএসএস যখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে হঠাৎ করে সংবিধান দিবস পালনের নেশায় মেতে ওঠে, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সংবিধানকে মান্যতা দেওয়া নয়, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে সংবিধানের মর্মবস্তুকে নস্যাৎ করাই ওদের লক্ষ্য। তাই সতর্ক হওয়া জরুরি।
পক্ষকালের আলোচনার জন্য ইউজিসি ১৫টি বিষয় নির্দিষ্ট করেছে যার মধ্যে আছে - আদর্শ রাজার ধারণা, ভারতের লোকতন্ত্র, খাপ পঞ্চায়েত ও তার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, শ্রুতি স্মৃতি মহাকাব্য সহ প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লেখিত গণতন্ত্রের নীতিসমূহ, প্রাচীন ভারতের রাজকীয় গণতন্ত্র, সম্রাট অশোকের আবিষ্কারের সময় কলিঙ্গর গণ রাজ্য, অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত গণতন্ত্রের ধারণা ও ঐতিহ্য ইত্যাদি। আইসিএইচআর-এর নোটে বলা হয়েছে ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে নাকি বেদের যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ সাল থেকে। দাবি করা হয়েছে প্রাচীন যুগের শাসন ব্যবস্থায় রাজতন্ত্র নয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গড়ে উঠেছিল।
বোঝাই যাচ্ছে পরিকল্পিত উপায়ে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থিত করবার জন্য সুকৌশলে প্রাচীন ভারতের বর্ণভেদ প্রথাকে আড়াল করা হয়েছে যা ঘৃণ্য অপরাধের শামিল। যে সংস্কৃত সাহিত্যে গণতন্ত্রের উল্লেখ আছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেই সাহিত্যগুলিতেই বর্ণভেদ প্রথার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। মনুসংহিতায় (১.৩১) উল্লেখ আছে, ‘‘ত্রিভুবনের সকলের মঙ্গলার্থে মুখ, বাহু, ঊরু ও পাদ থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি হলো’’। ভগবত গীতা ও একাধিক ধর্ম সূত্রে (বৌধায়ন, আপস্তম্ব, বশিষ্ঠ ইত্যাদি) এই চতুর্বর্ণের উল্লেখ আছে। মনুসংহিতায় (১.৯৯) এও বলা আছে, ‘‘জন্ম মাত্রই ব্রাহ্মণ সবার উপরে থাকে অর্থাৎ সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়।’’ বৈদিক যুগে সভা-সমিতি-গোষ্ঠী ইত্যাদির উল্লেখ করে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে ওই নোটে। অথচ ঋগ্বেদেও চতুর্বর্ণের কথা উল্লেখ আছে যা সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যেহেতু বর্ণভেদ প্রথা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী তাই সত্যকে আড়াল করা হয়েছে। মনুবাদী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সংবিধান দিবস পালনের ছুতোয় হিন্দুত্বের প্রচারের লক্ষ্যে এই নোট তৈরি করেছে। একই সাথে অপমান করেছে আদিবাসী, দলিত সহ সমাজের সর্বস্তরের নিম্নবর্গের মানুষকে।
কে না জানে, এই বর্ণভেদ প্রথাই সমাজের উচ্চ নিচ ভেদাভেদ কাঠামো গড়ে ওঠা এবং উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা নিম্নবর্ণের মানুষদের শোষণ নিপীড়নের প্রধান কারণ, যা যুগ যুগ ধরে বহমান। অথচ, আলোচ্য নোটটিতে সমাজের এই বিভাজনের কারণ হিসেবে বিদেশি শত্রু যারা এদেশে বিভিন্ন সময়ে এসেছে তাদেরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। গণতন্ত্রের অর্থই হলো সব মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হওয়া । নোটটিতে প্রাচীন ভারতের যে অংশের উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে কোথাও এই নিশ্চয়তা ছিলনা। ছিল বিভেদ বৈষম্য যার উল্লেখ নোটে ইচ্ছাকৃতভাবে নেই। রাজতন্ত্রের গরিমা বর্ণনা করা হয়েছে গণতন্ত্রের কাঠামোকে সামনে রেখে। দাবি করা হয়েছে খাপ পঞ্চায়েতই হলো আদর্শ পঞ্চায়েত যা নাকি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে গড়ে উঠেছিল।
খাপ পঞ্চায়েত হলো সমাজের বর্ণ শ্রেষ্ঠ ও সম্পদশালী মুষ্টিমেয় ব্যক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সরকারি স্বীকৃত ব্যবস্থা, যেখানে বেশিরভাগ মানুষের নির্দেশ মানাটাই নিয়ম, ব্যতিক্রম হলে শাস্তি অনিবার্য। গণতান্ত্রিক রীতি মেনে সেখানে মত প্রকাশের সুযোগ খুবই সীমিত। প্রাচীন ভারতে এই ব্যবস্থা ছিল, আজও উত্তর ভারতের একাধিক রাজ্যে এই খাপ পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব বিদ্যমান। একমাত্র মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে উঠতে পারলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার এই কাজ করতে পেরেছিল যা তৃণমূল কংগ্রেসের সৌজন্যে বাস্তুঘুঘুদের বাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেপি- আরএসএস মানুষের সিদ্ধান্তে গড়ে ওঠা পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার বিরোধী, তাই খাপ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে আধিপত্যবাদকেই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
বৈদিক যুগে গণতন্ত্র ছিল কিনা তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক হতে পারে। বেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে হরপ্পার নগর সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনের বৈদিক যুগের শাসনব্যবস্থাকে জোর করে মেলানোর চেষ্টা হয়েছে। তবে বৈদিক যুগে যে শাসনব্যবস্থার উল্লেখ আমরা পাই সেখানে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত কোনো ব্যক্তি শাসনভার পরিচালনা করছেন এমন কথা বলা নেই। এমনকী বেদ-পরবর্তী সময়ে পুরাণের মহাকাব্যগুলিতেও বিশেষ করে রামায়ণ বা মহাভারতে যে রঘুবংশ বা পাণ্ডব-কৌরবদের আমরা পাই তারা সকলেই রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি। বংশপরম্পরায় তারা রাজত্ব চালিয়েছেন। এদের কেউই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। তাই রাজতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা খোঁজা নিরর্থক। সেই ব্যবস্থায় মানুষের মত প্রকাশের অধিকার বা রাজতন্ত্রের সমালোচনা করবার অধিকার দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ছিল না বললেই চলে। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজা হতেন স্বয়ং ঈশ্বরের স্বঘোষিত প্রতিনিধি। তাই রাজার সমালোচনা মানে খোদ ঈশ্বরের কোপে পড়া - এই ধারণাই চালু ছিল রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য। যেহেতু ঈশ্বরের মহিমা প্রচারের জন্য কোনো প্রামাণ্য নথির প্রয়োজন পড়েনা তাই অতীতের সেই কৌশল মেনে আধুনিক ভারতে বিজেপি-আরএসএস-ও একই পথের পথিক। হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়পড়তা ধর্মভীরু মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে হাতিয়ার করে তারা শুধু প্রচার করে তাই নয়, রাষ্ট্রক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আক্রমণ সংগঠিত করে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা, গুজরাটে দাঙ্গা, মীরাট সহ অন্যত্র সংখ্যালঘুদের উপর বর্বর আক্রমণ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
গণতন্ত্রের আভিধানিক অর্থ হলো মানুষের শাসন যা প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বৈষম্য শোষণ নিপীড়ন নিরসনের পথ তৈরি হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গই হলো ক্ষুধা দারিদ্র্য বৈষম্যের অবসান। আরএসএস গণতন্ত্রের এই ব্যাখ্যা মানে না তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সিদ্ধান্ত ছাড়াই গড়ে ওঠা খাপ পঞ্চায়েতকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে। রাজতন্ত্রের তথাকথিত মানবিক মুখকে সামনে এনে সামন্ত যুগের শোষণ, অত্যাচার, কুসংস্কারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আজও শিক্ষণীয় এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তবে তা তৎকালীন সমাজের গণতান্ত্রিক বিধি বন্দোবস্তের প্রামাণ্য দলিল - এটা মানা সম্ভব নয়। অথচ নোটে সেই কথাই বলা আছে। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে এই কাজ করা হয়েছে সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যা হলো আরএসএস-এর হিন্দুত্বের প্রচার ও হিন্দুরাষ্ট্র গঠন। ভারতীয় সংবিধান হিন্দুরাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রও বহুত্ববাদের কথা বলে। সংবিধান দিবস পালনের জন্য তৈরি নোট সেই সংবিধানের মর্মবস্তুকেই অস্বীকার করেছে।
সংবিধান দিবস পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এবং রাজ্যপালদের ইউজিসি যে চিঠি দিয়েছে সেখানে সংবিধানের প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করেছে অথচ আলোচনার বিষয় সীমিত করবার জন্য আইসিএইচআর-এর নোটকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে কেন? সংবিধানের মর্মবস্তু বা সংবিধানের প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনার জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কি যোগ্য ব্যক্তির অভাব পড়েছে? নিশ্চয়ই তা নয়। তবু এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিছু অপ্রিয় অথচ নির্মম সত্যকে আড়াল করবার জন্য। সেই সত্য হলো, সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার হলেও তা সম্ভব হয়নি। চিন্তার, অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা, এবং সমতাবিধানের যে কথা বলা হয়েছে সংবিধানে, তা আজও অধরা শুধু তাই নয়, সাংবিধানিক এই অধিকার পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত সাধারণ মানুষ। বিজেপি সরকারের সৌজন্যে মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিতে ব্রিটিশ যুগের দানবীয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন নতুন নকশায় চালু হয়েছে। আজ সারা দেশে মত প্রকাশের বা অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার আক্রান্ত। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুন হতে হয়েছে নরেন্দ্র দাভোলকর, কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশ, স্ট্যান স্বামী সহ অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষকে। বিনা অপরাধে জেল খাটতে হয়েছে বা হচ্ছে ডাক্তার কাফিল খান, ওমর খালিদ, তিস্তা শীতলবাদ প্রমুখকে। সংবিধানের সমানাধিকার আজও অধরা, তাই সর্বোচ্চ আদালতকে নির্দেশ দিতে হয় ‘‘কোনো মানুষ যাতে না খেয়ে না থাকে সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে’’। যে সময়ে এই সংবিধান নিয়ে আলোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ঠিক সেই সময়ে সঙ্ঘ পরিবার ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নির্দেশে মধ্যপ্রদেশের একটি আইন কলেজের সংখ্যালঘু শিক্ষকদের সাসপেন্ড করে মামলা করে হয়রান করা হয়েছে। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা ছাত্র-ছাত্রীদের ‘কালেক্টিভ ভায়োলেন্স অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম’ বইটি পড়িয়েছেন, যেখানে আরএসএস-বজরং দল-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-দুর্গা বাহিনী প্রভৃতি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির নানা সময়ের কুকীর্তির উল্লেখ আছে সংগঠিত অপরাধ হিসেবে।
সংবিধান দিবস পালনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত এই প্রসঙ্গগুলি আসতই, অন্তত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে। আমরা সবাই বিশ্বাস করি, সংবিধানকে বাঁচানো ও সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করবার জন্যই সংবিধানের মর্মবস্তু চর্চার পরিসরকে বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে আগামীদিনের সমাজ গড়ার কারিগরদের কাছে তা বেশি বেশি করে বলা দরকার। কিন্তু সংবিধানচর্চার নামে হিন্দুত্ববাদের প্রচার করা সংবিধানকেই অসম্মান করে। বিজেপি-আরএসএস তাই চায়, আর সেই কারণেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে এই ফরমান জারি করেছে। সংবিধান দিবস পালনের নামে সংবিধানকে নস্যাৎ করা এবং সংবিধানের মর্মবস্তুকে গুলিয়ে দেওয়ার আরএসএস-এর এই অপচেষ্টাকে রুখতেই হবে।