E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

অনলাইন মাধ্যম, কৃত্রিম শয়তানি, শ্রমিক শোষণ

সৌম্যজিৎ রজক


চারপাশে সব কিছুই পাল্টে গেছে, যাচ্ছে। শ্রমের বাজারও। শ্রমিকের চেহারা-ছবিও। শহরে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে, এমনকী বহু মাঝবয়সী মানুষও, কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। অন্য কোথাও কাজ না পেয়ে কেউ ওলা-উবের-রাপিডোতে ট্যাক্সি কি বাইক চালাচ্ছেন। কেউ সুইগি-জোমাটো-ব্লিংকিট-অ্যামাজন-মিন্ত্রায় ডেলিভারির কাজ করতে শুরু করছেন। ডিজিটাল মাধ্যমের এই নতুন ধরনের পেশাগুলির সাথে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষদের বলা হচ্ছে ‘প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার’।

শ্রমিকশ্রেণির বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত শ্রমআইনগুলো বাতিল করে মোদি সরকার যে কোডগুলি বানিয়েছে তার একটিতে (কোড অন স্যোশাল সিকিউরিটি-তে) এই ‘প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্ক’ ব্যাপারটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে- “platform work” means a work arrangement outside of a traditional employer employee relationship in which organisations or individuals use an online platform to access other organisations or individuals to solve specific problems or to provide specific services or any such other activities...”। এই সংজ্ঞা থেকে ‘প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্ক’-এর তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা পাওয়া যাচ্ছে।

প্রথম বৈশিষ্ট্যটি নিয়োগকারী এবং নিযুক্ত কর্মীটির মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে। এই ধরনের কাজ হবে প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে। মোদ্দা কথাটা হলো, সুইগির টি-শার্ট পরে লোকের বাড়ি খাবার পৌঁছতে যাওয়া ছেলেটা সুইগির দ্বারা নিযুক্ত ‘কর্মী’ নয়! সে নিজেই নিজেকে নিয়োগ করেছে, মানে সে স্বনিযুক্ত। উল্টোদিক থেকে বললে সুইগিও তার নিয়োগকারী নয়। এদের সম্পর্কটা নিয়োগকারী ও নিযুক্তের নয়। পার্টনারের। এদের তাই বলা হয় ‘ডেলিভারি পার্টনার’‍, পরিবহণক্ষেত্রে (অর্থাৎ ওলা, উবের, রাপিডো ইত্যাদিতে) বলা হয় ‘রাইডার’। যাই হোক এই ফেরেপবাজিটার কথায় পরে আসা যাবে। তার আগে অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা সেরে নিই।

এই ধরনের কাজের দ্বিতীয় বিশিষ্ট দিকটা হলো, প্রযুক্তির (বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমের) ব্যবহার। এখানে একটি বিন্দুতে রয়েছেন গ্রাহক, একটি বিন্দুতে শ্রমিক আর এই দুই বিন্দুর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেওয়ার জন্যে রয়েছে উবের বা সুইগি বা এরকম কেউ। এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলি মধ্যস্থতাকারী; গ্রাহক ও উৎপাদকের (বা পরিষেবা শ্রমিকের মধ্যে) যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে। তাদেরকে কানেক্ট করিয়ে দিচ্ছে। যাতে গ্রাহক তাঁর নির্দিষ্ট চাহিদাটি (অফিস থেকে বাড়ি ফেরা বা এক প্লেট চিকেন চাউমিন) পূরণের জন্যে একজন শ্রমিককে খুঁজে পেতে পারেন এবং একজন শ্রমিক যিনি নিজের গতর খাটিয়ে কিছু টাকা আয় করার জন্যে কাজ খুঁজছেন তিনিও একটি কাজের অর্ডার পেতে পারেন। আর এইটাই ‘প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্ক’-এর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য। নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কাজ বা অন-ডিমান্ড কাজ বা ফুরনের কাজ।

ফুরনের কাজ নতুন কিছু নয়। পুঁজিবাদের উষালগ্ন থেকেই যে এই ব্যবস্থা রয়েছে তার উল্লেখ মার্কসও করেছেন। ‘ক্যাপিটাল’-এর প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় অংশে ‘ফুরন মজুরি’ সংক্রান্ত অধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “সেই ১৪শ শতাব্দীর ফরাসি ও ইংরেজ শ্রম সংবিধিতেও আনুষ্ঠানিকভাবে সময় হিসেবে মজুরির পাশাপাশি এটাও (ফুরনের মজুরির কথা) আছে।” যেহেতু এখানে সময়ের হিসেবে মজুরি মেলে না, একটা নির্দিষ্ট কাজের অর্ডার পূরণ করলে সেই কাজের হিসেবে মজুরি মেলে তাই একজন উবের ড্রাইভার যত বেশি সম্ভব টিপ গাড়ি চালাতে চান কেননা একটা টিপের হিসেবে তিনি আয় করেন, নির্দিষ্ট টিপের বেশি চালালে তবেই তো ইনসেনটিভ (অর্থাৎ বাড়তি আয়) মিলবে। কোনো মালিক তাকে বেশি সময় কাজ করার জন্যে আর চাবুক হাতে শাসায় না, বরং বেশি আয়ের জন্যে তিনি নিজেই বেশি সময় ধরে কাজ করতে চান। মার্কসের ভাষায়, “শ্রমিকের নিজস্ব স্বার্থ হলো কর্ম-দিবসকে দীর্ঘ করা, কেননা তার সঙ্গে সঙ্গে তার দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি বাড়ে।” ফুরনের কাজের স্বাভাবিক পরিণতি এটা। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্ক অর্থাৎ ডিজিটাল মাধ্যমে ফুরনের কাজের বেলায় গোদের উপরে বিষফোঁড়া যুক্ত হয়েছে।

সরষের মধ্যে ভূত তো চিরকালই ছিল, এখন সফটওয়্যারেও ঢুকেছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যে কাজ হয় সেখানে পুরো প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রিত হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা। এক্ষেত্রে কৃত্রিম-শয়তানি বলাই ভালো। কীরকম শয়তানি? ধরুন আপনকে আজ পাঁচ টিপ গাড়ি চালাতে হবে, শুরু করেছেন সকাল ১০টায়। প্রথম তিনটে টিপ আপনি শেষ করে ফেললেন দুপুর ২টোর মধ্যে, এরপর ৬টা বেজে গেল! ৭টা-৮টা বেজে গেল! রাত ১০টা বেজে গেল অর্থাৎ টানা ১২ ঘন্টা আপনি গাড়িতে, অথচ চতুর্থ রাইডের অর্ডারই ঢুকছে না আপনার ফোনে। সকালে বেরোনোর সময় আপনি, বেচারা, ভেবেছিলেন যে আজ ওই ৫টার পরেও আর ২টো করে কিছু বাড়তি আয় করবেন। বাড়তি আয়ের কথা ছাডুন এখন, বেসিক ৫-টাই করে উঠতে পারলেন না। অলগারিদমের গ্যালাখেলায় গাড়ির স্টিয়ারিংটা এখন মনে হচ্ছে গলার ফাঁস।

একজন ডেলিভারি শ্রমিকের ফোনে দেখাচ্ছে, খাবারটা পৌঁছে দিতে হবে ৩ কিলোমিটার দূরের একটা বাড়িতে। বাইক স্টার্ট দিলেন তিনি। গ্রাহকের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বুঝতে পারলেন আসলে দূরত্বটা ৫ কিলোমিটারেরও বেশি! এরকম ঘটনা হরদম ঘটছে। কিলোমিটারের হিসেবে ঠকাচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো। কৃত্রিম শয়তানি!

ফুরন মজুরি সংক্রান্ত আলোচনায় কার্ল মার্কস দৃঢ়ভাবেই বলবেন, “এখানে শ্রমের গুণ নির্ধারণ করা হয় খোদ কাজটি দিয়েই, ফুরনে দাম যদি পুরোপুরি দিতে হয় তবে সেই কাজটাও হতে হবে গড়পড়তা নৈপুণ্যের কাজ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ফুরন মজুরি হয়ে ওঠে মজুরি হ্রাসের আর পুঁজিবাদী প্রতারণার সবচেয়ে ফলপ্রসূ উৎস।” প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকের ক্ষেত্রে কাজের নৈপুণ্যের বিচার কীভাবে হচ্ছে বা মার্কস যে প্রতারণার কথা বলেছেন সেটা কীভাবে ঘটছে?

আপনি নির্দিষ্ট গ্রাহকের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিলেন, হয়তো একটু দেরি হলো ট্রাফিকের কারণে আর খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেছে ততক্ষণে কিংবা অন্য কোনো কারণে বা অকারণে গ্রাহকটি আপনার পরিষেবায় ‘সন্তুষ্ট’ হলেন না, তিনি সাথে সাথে তাঁর মোবাইল থেকে আপনার নামে অভিযোগ জানাতে পারেন বা খারাপ রেটিং দিতে পারেন। ব্যাস! সুইগি হোক বা জোমাটো বা অন্য কোনো কোম্পানি সে কিন্তু আর আপনাকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না, আপনার কথা শুনতেও চাইবে না, পত্রপাঠ আপনাকে পেনাল্টি করবে। টাকা কাটবে বা আপনার আইডি ব্লকও করে দিতে পারে। দেয়ও আকছার। আইডি ব্লক করে দেওয়ার অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আপনি আর কাজ পাবেন না। কি দারুণ পদ্ধতি ভাবুন! গ্রাহকের রেটিংয়ের ভিত্তিতে একতরফা ব্লকিংয়ের এই সমস্যা শুধু ডেলিভারি শ্রমিকরাই ভোগ করেন তা নয়, পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিকরাও ভোগ করেন। কিংবা ধরুন আপনি অনলাইনে অর্ডারের ভিত্তিতে প্রুফ দেখেন বা কপি এডিট করেন বা গ্রাফিক ডিজাইনার - প্রতিটি ক্ষেত্রেই মজুরি কাটার জন্যে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে তার বিরুদ্ধে এবং সেটা হবে, এরকমই, একতরফাভাবে।

মজুরি কমানোর ধান্দায় অর্ডার না দেওয়া বা কিলোমিটারে ঠকানো কিংবা এজাতীয় একতরফা ব্লকিং বা মজুরি কাটা ইত্যাদি থেকে একটা কথা স্পষ্ট যে, এইজাতীয় কাজের ক্ষেত্রে সমগ্র প্রক্রিয়াটা মধ্যস্থতাকারী অনলাইন কোম্পানিগুলির দ্বারা (সুইগি, জোমাটো, অ্যামাজন, উবের, ওলা যেই হোক তার দ্বারা) কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার একদিকে শ্রমের বাজারকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিকেন্দ্রীভূত করেছে, আরেকদিকে শ্রমশোষণের প্রক্রিয়াকে করেছে অভূতপূর্ব মাত্রায় কেন্দ্রীভূত।

উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতে অথচ উৎপাদনের হাতিয়ারের বৃহৎ অংশটারই মালিকানা তার নয়। এইটাই সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য। উৎপাদনের হাতিয়ারের বেশিরভাগটা অর্থাৎ গাড়িটা তার নয়, তেলের বা মেনটেন্সের খরচাও তার নয়, মোবাইল এবং মোবাইলের ডেটার খরচাও সে করে না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা সম্পূর্ণত উবেরই করে। কেননা তার হাতে আছে সফটওয়্যারটা। প্রযুক্তিটা। আর সেটা দিয়েই সমগ্র শোষণ প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করা হচ্ছে। এমনকী গোটা প্রক্রিয়ার বাকি কোনো খরচখরচার দায়ও তাকে আর নিতেই হচ্ছে না। সেসব দায় বহন করছে শ্রমিক।

এখন যদি শ্রমিকটি বলেন, “নিয়ন্ত্রণ তো ভাই তুমি করছ, মুনাফাও লুটছ তুমিই তাহলে ইনভেস্ট আমি করব কেন?” সুইগির উত্তর হবে, “এই বিজনেস মডেলে ভাই তুমি তো পার্টনার তাই পার্টনারশিপের শর্ত মেনে ইনভেস্ট তোমাকে করতেই হবে।” কিন্তু পার্টনারশিপের শর্ত মেনে প্রফিটের ভাগ কিন্তু ডেলিভারি করা ছেলেটা কখনোই পায় না, পাবেও না। কোম্পানি বলবে, “যা আয় হচ্ছে তার থেকে তোমাকে তো কমিশন দিচ্ছি হিসেব মতোই!” ঘটনাটা কি আদৌ তাই? নাকি উল্টোটা?

আদতে শ্রমিককে নিজের মালিকানাধীন অথবা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে, সেই গাড়ির ট্যাঙ্কে তেল ভরিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। অর্থাৎ শ্রমশক্তি আরোপ করতে হচ্ছে। সওয়ারি যে টাকাটা দিচ্ছেন সেটা ওই গাড়ির খরচ ও শ্রমশক্তির যে মূল্য তার যোগফল। অথচ উবের কোম্পানি তার প্রতি ট্রিপের ভাড়া থেকে ৬৫-৭০ শতাংশ সেই শ্রমিককে দিচ্ছে মাত্র। বাকি ৩০-৩৫ শতাংশ কমিশন নিজের পকেটে পুরছে। কমিশন তো তাহলে সে দিচ্ছে না শ্রমিককে, বরং শ্রমিকের প্রাপ্য থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন সে খেয়ে নিচ্ছে। এটাই তো ঘটনা!

উল্টোদিকে বাকি যে টাকাটা চালক পাচ্ছেন তাই দিয়ে গাড়ির ভাড়া, মেনটেনেন্স, বিমা, তেলের খরচ ইত্যাদি প্রভৃতি মিটিয়ে হাতে পাচ্ছেন যা তা আদতে (সহজ অঙ্কের হিসেবেই) তাঁর শ্রমশক্তির মোট যা মূল্য তার থেকে ৩০-৩৫ শতাংশ কম। শ্রমশক্তির এই বাড়তি মূল্যটার মালিকানাকে কেন্দ্র করেই তো শ্রমের সাথে পুঁজির চিরকালীন দ্বন্দ্ব। প্ল্যাটফর্মভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলের একটি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকছেন মানেই তিনি ব্যবসার পার্টনার নন, তিনি আদতে শ্রমিকই যার শ্রমশক্তির একটা অংশ চুরি যাচ্ছে রোজ। আর সেই বাড়তি অংশটাই মুনাফা হিসেবে ঢুকছে মালিকের পকেটে। সর্বোচ্চ মুনাফার সন্ধানে, শ্রমশক্তিকে সর্বোচ্চ নিংড়ে নেওয়ার কী নিপুণ ফেরেপবাজি, লক্ষ করুন!

এই ফেরেপবাজিটাকে টিকিয়ে রাখার জন্যেই প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে এসে দাঁড়ানো প্রয়োজন হয়েছে ওদের। শ্রম সম্পর্কটাকে নমনীয় করে তোলা হয়েছে। শ্রম আইনগুলোর এক্তিয়ারের বাইরে শ্রমিককে টেনে নিয়ে এসে শুষে ছিবড়ে করা হচ্ছে। শোষণের এই নির্দয় আইডি ব্লক করে দেওয়া ছাড়া শ্রমিকশ্রেণির সামনে ভিন্ন রাস্তা নেই।