E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

বিশ্বকাপে আফ্রিকাঃ তিন দশকের প্রতিস্পর্ধা

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়


ফিফা যতই চেষ্টা করুক, ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবল ও তার আঁতুড়ঘর ইয়োরোপের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির উত্থান এই ২০২২-এর বিশ্বকাপে করপোরেট দুনিয়া দ্বারা একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রিত ফুটবল জগতে পালটা ধারার সৃষ্টি করছে। দেখার বিষয় তা কতদিন টিকে থাকে ও ফিফাকে বাধ্য করে ফুটবল বিশ্বের বৈষম্য কাটাতে।

পুঁজিবাদ যতটা ক্রিকেটের নিয়মকানুন যুগে যুগে পরিবর্তনের কারণ হয়েছে, ফুটবলে প্রকৃতপক্ষে নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে অন্তত বড়ো কোনোও প্রভাব ফেলতে পারেনি। মূল কাঠামো অবিকৃত (এবং যুগপৎভাবে অবিক্রীত) রয়েই গেছে। তার একটা বড়ো কারণ হলো ফুটবল একটা পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া। বল সহযোগে শারীরিক সক্ষমতা ও অ্যাথলেটিকসের পুরোদস্তুর প্রয়োগ রয়েছে এখানে। কিন্তু শিল্প, স্কিল - প্রায় সরে গেছে মুনাফালোভী দর্শনের সামনে পড়ে, গোলের সংখ্যা কমেছে, কমেছে পায়ের জাদু। যা নিশ্চিত লাতিন ফুটবলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং অবশ্যই এশিয়া ও আফ্রিকাকেও প্রভাবিত করেছে অন্যভাবে।

আফ্রিকার জনগণের সর্বাপেক্ষা প্রিয় খেলা ফুটবল। অন্যান্য উপনিবেশের মতো এখানেও ব্রিটিশদের হাত ধরে ফুটবল শুরু হয় উনিশ শতকের শেষপর্বে। ১৮৬২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় সৈন্য ও সিভিল সার্ভেন্টের মধ্যে খেলা একটি ম্যাচকে বলা হয় আফ্রিকার প্রথম ফুটবল ম্যাচ। তখনও রাগবি ফুটবল থেকে পৃথক হয়নি। ১৮৮০ সালে তৈরি হয় পিটারমারিতসবার্গ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, ১৮৮২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্যাভেজ এফ সি আর মিশরের গেজিরা এফ সি তৈরি হয়। এগুলোই আফ্রিকার প্রথম ফুটবল সংগঠন। ১৮৮২ সালেই শ্বেতাঙ্গদের তৈরি দক্ষিণ আফ্রিকা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (SAFA) তৈরি হয়। ১৮৯০ সালে তৈরি হয় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া এফ সি, আলজেরিয়ার সিডিজে ওরান তৈরি হয় ১৮৯৪ সালে এবং সি এ এল ওরান তৈরি হয় ১৮৯৭ সালে। ১৯১০ সালে সাফা (SAFA) ফিফার সদস্যপদ পায়। ১৯২৩ সালে সদস্য হয় মিশর। সুদান সদস্য হয় ১৯৪৮ সালে, ইথিয়োপিয়া ১৯৫৩ সালে।

১৯০৬ সালে বুয়েনস আয়ার্সে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা, এরপরেই ১৯০৭ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবল সংস্থা তৈরি হয় ডারবান ও জেলা ফুটবল সংস্থা নামে। কিন্তু ১৯১০-এ পাওয়া ফিফা স্বীকৃতি ছেড়ে দেয় সাফা ১৯২৪ সালে। পরে ১৯৫২ সালে আবার ফিরে আসে।

১৯২০ সালে মিশর প্রথম আফ্রিকা থেকে অলিম্পিক খেলে ফুটবলে। প্রথম ম্যাচেই ইতালির বিরুদ্ধে হেরে যায়। প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপেও অংশগ্রহণ করে মিশর। ১৯৩৪ সালে মিশর পরাজয় বরণ করে তাদের একমাত্র খেলায় হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে (২-৪)।

১৯৫২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ফিফার সদস্য হলেও তারা সাসপেন্ড হয়ে যায় বর্ণবৈষম্যের জন্য। ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্যার স্ট্যানলি, স্ট্যানলি রস ফিফার তৎকালীন সভাপতি, বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারে আফ্রিকার দেশগুলির অনড় অবস্থান লক্ষ করে একটি পরিকল্পনা করেন যে দেশগুলি বর্ণবৈষম্যের সমর্থক, সেই আফ্রিকার দেশগুলি নিয়ে আলাদা জোন তৈরি করার। ফিফা দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফিরিয়ে নিলেও CAF সাসপেন্ড করে দেয় ১৯৫৮ সালে। ফলে ১৯৬১ সালে অবশেষে আবার ফিফা সাসপেন্ড করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। কারণ অনর্থক বিভাজনকে ফিফা স্বীকৃতি দিতে চায়নি অন্যন্য আফ্রিকা ও এশিয়ার চাপ পড়ে। এমন সময় সভাপতি স্যার স্ট্যানলি, দক্ষিণ আফ্রিকায় যান ‘তদন্ত’ করে দেখতে। চূড়ান্ত বর্ণবৈষম্যের পক্ষে থাকা এই প্রাক্তন ব্রিটিশ রেফারি রিপোর্ট দেন, দক্ষিণ আফ্রিকাকে না ফেরালে ফুটবল খেলাটাই ওই দেশে মৃত্যুর মুখে পতিত হবে।

এইবার দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফিরিয়ে সঙ্গে রোডেশিয়া, মালাউই, মাদাগাস্কার, মরিশাস ও বতসোয়ানাকে নিয়ে আলাদা জোন তৈরি করার গোপন পরিকল্পনা করেন। কংগ্রেস শুরু হওয়ার আগে স্যার স্ট্যানলিকে একসঙ্গে সব অফ্রিকার দেশ হুমকি দেয়, যদি ফিফা অবৈধভাবে একই মহাদেশে দুটো আলাদা কনফেডারেশন করার মতো ঘৃণ্য বিচ্ছিন্নতাবাদী মদতদানকারী পক্ষপাতমূলক আচরণ বজায় রাখে, তারা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে ফিফা ছাড়বেন।

প্রকাশ্যে এই ঘটনা বড়ো রকমের বিতর্ক সৃষ্টি করতেই পারে, বুঝতে পেরে স্যার স্টানলি পিছিয়ে আসেন। এর চার বছর বাদে রোডেশিয়াকে সাসপেন্ড করে ফিফা।

এতেও থামেনি ফিফা। ১৯৬৬ সালে নিয়ম করে যে আফ্রিকার তিনজন দ্বিতীয় রাউন্ডের জয়ী দলকে এশিয়া জোনের দলের সঙ্গে প্লে অফ খেলে আসতে হবে। কারণ ফিফার ধারণা ছিল আফ্রিকা বা এশিয়ার সরাসরি খেলার যোগ্যতা নেই। এর প্রতিবাদে ঘানার ওহেনে জানের নেতৃত্বে ৩১টি আফ্রিকার দেশ সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতা বয়কট করে। ফিফা আর এই ধৃষ্টতা দেখায়নি।

১৯৭০ সালে প্রথম আফ্রিকার দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে নামে মরক্কো। পশ্চিম জার্মানি ও পেরুর কাছে হেরে এবং বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে ড্র করে বিদায় নেয় তারা। ১৯৭৪ সালে জাইরে স্কটল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া এবং ব্রাজিলের বিরুদ্ধে হেরে বিদায় নেয়। ১৯৭৮ সালে তিউনিশিয়া আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে ম্যাচ জেতে মেক্সিকোকে হারিয়ে। ১৯৮২ সালে আলজেরিয়া ও ক্যামেরুন ভালো খেলেও বিদায় নেয়। আলজেরিয়া দুটো ম্যাচ জেতে, ক্যামেরুন না জিতলেও কোনোও ম্যাচে হারেনি। পরের বার আলজেরিয়া না জিতলেও মরক্কো শেষ ১৬-য় যায়। পোল্যান্ড আর ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ড্র করে, পর্তুগালকে হারিয়ে দেয়। তবে পশ্চিম জার্মানির বিরূদ্ধে হেরে যায় নকআউটে।

১৯৯০ সাল আফ্রিকার ফুটবলের নতুন যুগ। ইজিপ্ট মোটামুটি খেললেও, ক্যামেরুন জায়ান্ট কিলার হয়ে ওঠে। প্রথম ম্যাচে গতবারের বিশ্বজয়ী মারাদোনা সমৃদ্ধ আর্জেন্টিনা, রোমানিয়া ও কার্লোস ভালদেরামার কলম্বিয়াকে হারিয়ে দেয়। যদিও শেষবারের মতো খেলতে আসা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরূদ্ধে ০-৪ গোলে হেরে। কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হেরে যায়।

১৯৯৪ সালে ক্যামেরুন ও মরক্কো প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেয়। নাইজিরিয়া দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে।

১৯৯৮ সালে তিউনিশিয়া, মরক্কো, ক্যামেরুন ও দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিলেও নাইজিরিয়া আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে।

২০০২ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে। এবারও পাঁচটি দেশ আফ্রিকা থেকে খেলতে আসে। ক্যামেরুন, নাইজিরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তিউনিশিয়া প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেয়, কিন্তু সেনেগাল হয়ে ওঠে ১৯৯০ সালের ক্যামেরুন। প্রথম ম্যাচেই গতবারের বিশ্বজয়ী জিনোদিন জিদানের ফ্রান্সকে হারিয়ে দেয়। ডেনমার্ক ও উরুগুয়ের সঙ্গে ড্র করে (উরুগুয়ের বিরুদ্ধে ৩-৩) দ্বিতীয় রাউন্ডে যায়। সেখানে সুইডেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। সেখানে হেরে যায় তুর্কির কাছে ২-১ গোলে। ২০০৬ সালের জার্মানির বিশ্বকাপে কেবল ঘানা দ্বিতীয় রাউন্ডে যায়। আঙ্গোলা, আইভরি কোস্ট, তিউনিশিয়া, টোগো সবাই প্রথম রাউন্ডেই বেরিয়ে যায়।

২০১০ এ আফ্রিকায় বসে বিশ্বকাপের আসর। দক্ষিণ আফ্রিকায়। আয়োজক দেশ ছাড়া আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া ও ঘানা অংশগ্রহণ করে। ঘানা কোয়ার্টার ফাইনালে যায়। প্রথম রাউন্ডে সার্বিয়াকে হারায়, অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে ড্র করে, জার্মানির কাছে হারে। দ্বিতীয় রাউন্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হারায়, কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়েকে মূল সময়ে ১-১ করে রুখে দিয়েও পেনাল্টি শুট আউটে ২-৪ গোলে হেরে যায়।

২০১৪ সালে ব্রাজিলের বিশ্বকাপে ক্যামেরুন, আইভরি কোস্ট ও ঘানা প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিলেও আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়া দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে।

২০১৮ সালে আফ্রিকার সব দেশ বিদায় নেয় প্রথম রাউন্ডে। কিন্তু ২০২২ ইতিহাস সৃষ্টি করে। সেনেগাল দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে গেলেও মরক্কো কিন্তু প্রথম আফ্রিকার দেশ হিসেবে উঠলো।

এশিয়ার মতোই নিচের র‌াঙ্কের দেশগুলিকে নিচ থেকে খেলানোর ফলে বড়ো দলের সঙ্গে খেলে অভিজ্ঞতা লাভ করে না ছোটো দলগুলি। এদিকে বড়ো দলগুলির খেলোয়াড়রা ভিড় করে ইয়োরোপে, খিদেয় জর্জরিত আফ্রিকার ফুটবলাররা ভিড় করে ভারতে, এমনকী ভারতে এসে এজেন্টদের থেকে প্রতারিত হয়ে ক্লাব না পেয়ে খেপ খেলে, মাদক সেবন করে, ঝকঝকে জীবনে প্রত্যাশী কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা হারিয়ে যায়, রিকশা টানতে বাধ্য হয়, আর রাতের পর রাত স্বপ্নে দেখে নিজের দেশকে, মনে পড়ে পরিবারের লোকদের কথা। ফুটবলের অতলে ঘুরে মরে জীবন।

সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট অন্ধকারের জীবনের থেকে বেরোনোর আকাঙ্ক্ষা ঠোক্কর খায় ক্রনি ক্যাপিটালের সৃষ্ট দুষ্ট চক্র দ্বারা। এর মুক্তি কীভাবে আসবে? ফিফা কি আদৌ উদ্যোগী হবে? আফ্রিকার তিন দশকের বেশি সময় ধরে তৈরি করা প্রতিস্পর্ধা কি পালটা ধারা তৈরি করবে? না হারিয়ে যাবে? নাকি পালটা করপোরেটের মুনাফার নতুন বাজার তৈরি করে শোষণ নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে তা আগামী দিনেই বোঝা যাবে।