৬০ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ / ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (তেরো)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনকে নতুন যুগ ও নতুন বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিবেচনায় রেখে সমৃদ্ধ করলেন ভি আই লেনিন। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিগুলি প্রতি মুহূর্তে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকী ব্যক্তিগত জীবনেও প্রয়োগ করার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনভাবে যত বেশি করে আমরা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিগুলি আত্মস্থ করে তাকে আমাদের কার্যধারায় প্রয়োগ করতে সক্ষম হব, ততই আমাদের কার্যধারা সঠিক চরিত্র অর্জন করবে। কমরেড লেনিন যেভাবে দ্বান্দ্বিকতার নির্যাস (Summary of Dialectics) তুলে ধরেছেন তা এখানে উপস্থিত করা হলো।
কমরেড লেনিন ১৬টি ভাগে দ্বান্দ্বিকতাকে উপস্থিত করেছেনঃ
(১) বাস্তবতার নিরিখে সমস্ত কিছুকে বিবেচনা করতে হবে। সদৃশ (Similar) কোনো কিছু নয়, বস্তু বা ঘটনা যেভাবে রয়েছে বা ঘটছে তাকে সেইভাবে দেখতে হবে। এর জন্য বস্তু বা ঘটনাকে সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে হবে। দ্বান্দ্বিকতা বলে যে, কোনো কিছুকে তার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু যেহেতু তার বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে, তাই তাকে সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে অনুশীলন করতে হবে। তারপর তাকে তার বাস্তব পরিবেশের মধ্যে রেখে অনুশীলন করতে হবে।
(২) প্রতিটি বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়াকে অন্য বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়ার সাথে বহুবিধ সম্পর্কের সামগ্রিকতার মধ্যে বিচার করতে হবে, তা না হলে ভ্রান্তি ঘটবে।
(৩) সমস্ত বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়া এই মহাবিশ্বের যেমন অংশ, আবার প্রতিটি বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়ারও একটা নিজস্বতা (নির্দিষ্ট রূপ, ধরন) রয়েছে। প্রতিটি বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়াকে, তাদের বিকাশকে তার নিজস্ব গতিধারা, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, নিজের জীবন হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
(৪) বিকাশ সর্বসময়ে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরিণতি, আবার বহিঃস্থ দ্বন্দ্বেরও বিকাশের ধারায় প্রভাব রয়েছে। প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যেকার দ্বান্দ্বিকতা (দ্বন্দ্বগুলিকে) চিহ্নিত করতে হবে।
(৫) প্রতিটি ঘটনা, প্রক্রিয়া, বস্তুকে বৈপরীত্যের ঐক্যের পরিণতি হিসাবে দেখতে হবে।
(৬) আবার বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়ার মধ্যেকার সংঘাতকে (দ্বন্দ্বকে) অবশ্যই উন্মোচিত করতে হবে।
(৭) দ্বান্দ্বিকতা হলো প্রথমে বিশ্লেষণ, তারপর সংশ্লেষণ এদের মধ্যেকার ঐক্য। প্রথমে বিভিন্ন অংশে বস্তুকে, ঘটনাকে, প্রক্রিয়াকে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করতে হয়। তারপর সমস্ত অংশের সামগ্রিক যোগফল।
(৮) প্রতিটি বিষয়ের (বস্তু বা ঘটনা যাই হোক) মধ্যে সম্পর্ক শুধু বহুমুখীই নয়, এই সম্পর্ক সাধারণ ও বহুমুখীও বটে। প্রতিটি বস্তু ও ঘটনা অন্য বস্তু ও ঘটনার সাথে সম্পর্কিত।
(৯) শুধুমাত্র বিপরীতের ঐক্যই নয়, ঘটনা, বস্তু ও প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিটি বৈশিষ্ট্য, প্রতিটি দিকের অন্যটিতে রূপান্তরকরণ ঘটে।
(১০) নতুন বৈশিষ্ট্য, নতুন রূপ, নতুন দিক ও সম্পর্কের উন্মোচনের এই প্রক্রিয়া অসীম। সীমাহীনভাবে এই প্রক্রিয়া চলছে।
(১১) যে কোনো বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার মর্মবস্তু, বাচ্য আভাস, (Appearance) প্রভৃতি সম্পর্কে মানব জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধির যে অসীম প্রক্রিয়া - বাচ্য আভাস থেকে অন্তর্বস্তু এবং স্বল্প গভীর অন্তর্বস্তু থেকে গভীরতর অন্তর্বস্তুর নির্দিষ্টকরণের মধ্য দিয়েই অসীম প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়।
(১২) সহ অবস্থান থেকে কার্য-কারণ সম্পর্ক, সম্পর্ক এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার একটি রূপ থেকে আরও গভীরতর অন্তর্বস্তুতে ও আরও সাধারণরূপে এইভাবেই উত্তরণ ঘটে।
(১৩) নিম্নস্তরের কিছু বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি প্রভৃতির পুনরাবৃত্তি উচ্চতর স্তরে ঘটে।
(১৪) মনে হয় যেন আপাতভাবে পুরাতনের দিকে ফিরে যাওয়া। (এটাই নেতির নেতিকরণ)।
(১৫) মর্মবস্তু (Content) ও রূপের (Form) সংঘাত ও সংঘাতের বিপরীত অর্থাৎ ঐক্য।
(১৬) পরিমাণের গুণে রূপান্তর এবং তার বিপরীত অর্থাৎ নতুন গুণের পুনরায় পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে।
* * *
● মার্কসীয় দর্শন অর্থাৎ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মানব সভ্যতাকে সেই অস্ত্র সরবরাহ করল, যার সাহায্যে সমস্ত বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়াকে বিকাশের ধারায় বিচার করা সম্ভব হয়েছে। সাথে সাথে সমস্ত কিছুর মধ্যে যে আত্মঃসম্পর্ক রয়েছে তাকেও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার অন্তর্বস্তুকে অনুধাবন করে যে দ্বন্দ্বের কারণে বিকাশ ঘটছে তাকে সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়। পুরাতনের নেতি ও নতুনের আবির্ভাবের এই নিরন্তর প্রক্রিয়াকে সর্বসময়ে নির্দিষ্ট করা সম্ভব করেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। প্রকৃতি জগৎ, মানব জীবন ও ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক কার্যধারায়ও প্রয়োগ করার যোগ্যতা আমাদের অর্জন করতেই হবে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনার এটাই মূল লক্ষ্য। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অনুশীলন ও চর্চা ব্যতিরেকে প্রকৃত মার্কসবাদী হওয়া সম্ভব নয়। সমগ্র পার্টির অভ্যন্তরে, প্রতিটি পার্টি সদস্যকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অনুশীলনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
● দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যখন মানব সমাজের অনুসন্ধানে প্রয়োগ হয় তাকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোচনা পরবর্তীকালে করা হবে। তবে তার পূর্বে ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে আলোচনা বড়ো বেশি প্রয়োজন।
(সমাপ্ত)