৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
কিউবায় অস্থিরতা তৈরিতে মার্কিন মদত
প্রতিবাদ কিউবা সহ দেশে দেশে
কিউবার ওপর থেকে মার্কিন অবরোধ প্রত্যাহার করো -
মার্কিনী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কিউবার রাজপথে সুবিশাল প্রতিবাদী মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কিউবায় অস্থিরতা তৈরি ও সরকারকে অস্থিতিশীল করার মার্কিনী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কেবল কিউবার অভ্যন্তরেই নয়,রাশিয়া, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। ভারতেও বিভিন্ন জায়গায় মার্কিন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। কিউবায় অস্থিরতা তৈরির প্রতিবাদে এবং সরকারের সমর্থনে কিউবার বিভিন্ন শহরে পথে নামেন মানুষ। কিউবার বিপ্লবকে রক্ষা করার আহ্বানে সোশ্যাল মিডিয়াতেও সরব হন নাগরিকরা। রাশিয়া ছাড়াও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ - মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতিরা কিউবায় অবরোধ ও অস্থিরতা তৈরির বিরোধিতা করেছেন।
বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়াও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন সংগঠন যেমন, দ্য বলিভারিয়ান অল্টারনেটিভ ফর দা আমেরিকানস-দ্য পিপলস্ ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এএলবিএ-টিসিপি), বুয়েন্স আয়ার্স প্রেস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সহ কলম্বিয়ার শিক্ষাবিদ-রাজনীতিক এবং সমাজকর্মীরা কিউবার সরকার এবং জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছেন। এছাড়া গুয়াতেমালা কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর সলিডারিটি, ব্রাজিলের ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকেও মার্কিন হস্তক্ষেপের জোরালো বিরোধিতা করা হয়েছে।
কিউবায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক এবং অপরাধমূলক অবরোধ প্রত্যাহারের জোরালো দাবি জানিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি।
১৪ জুলাই সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা এক যৌথ বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে কিউবার মানুষ গুরুতর অসুবিধায় পড়েছেন। আবার সেই সমস্যার অজুহাতে মার্কিন প্রশাসনের মদতেই কিউবায় একদল মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়ে চলেছে। নিজেদেরই চাপানো অবরোধের জেরে এবং মহামারীর সময়ে কিউবাবাসীর গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন সরকার। সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে অস্থিতিশীল করে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে তারা। কিউবার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এহেন হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা করছে সিপিআই(এম) এবং সিপিআই।
গত ৬০ বছর এবং তারও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক এবং অপরাধমূলক অবরোধের পরিণতিতেই অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে যুঝে চলেছে কিউবা। হেমস-বার্টন আইনের ৩ নম্বর শিরোনাম প্রয়োগের মাধ্যমে এই অবরোধ আরও জোরালো করে কিউবায় অভূতপূর্ব দুর্দশা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, কিউবাকে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ‘সন্ত্রাসে মদতদাতা রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে এই মহামারীর সময়ে অবরোধমূলক পদক্ষেপগুলি আরও কঠোর করে তোলা হয়েছে। যে অতিরিক্ত ২৪৩ দফা পদক্ষেপ পূর্বতন ট্রাম্প প্রশাসন চাপিয়েছিল, তা এখনও বহাল রয়েছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এসব অমানবিক অবরোধের কারণে কিউবা খাদ্য আমদানি করতে পারছে না। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আনতে পারছে না। কোভিড ভাইরাসের টিকা, এমনকি জীবনদায়ী চিকিৎসা সরঞ্জামও আমদানি করতে পারছে না। ফলে প্রবল দুর্দশার মধ্যে পড়েছে কিউবার জনগণ। এর মধ্যেই কিউবার মানুষ যাতে নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে বেশি করে বিক্ষোভে নামে, তার উসকানিও দিয়ে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। এজন্য ভুয়ো খবর ও গুজব ছড়াতে সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যমগুলিকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
এত সব সত্ত্বেও কিউবার সরকার নিজেরাই করোনা-টিকা তৈরি করেছে। মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বে সহায়তা পাঠাচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক বাধাগুলিকে জয় করার অভিযানও চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর।
এই গুরুতর কষ্টকর পরিস্থিতিতে কিউবার সরকার ও জনগণের প্রতি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সংহতি জ্ঞাপন করেছে সিপিআই(এম) এবং সিপিআই। সার্বভৌমত্ব ও সমাজতন্ত্র রক্ষায় কিউবা সরকার ও কিউবাবাসীর সংগ্রামের পাশে দাঁড়াতে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আবেদনও জানিয়েছে তারা।
কিউবায় অস্থিরতা তৈরি করতে সরাসরি মদত দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির সু্যোগ নিয়ে আমেরিকার অর্থে পুষ্ট প্রতিবিপ্লবীদের ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে জমায়েতের মধ্য দিয়ে কিউবায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে কিউবার রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল মারিও দিয়াজ-ক্যানেল বার্মুডেজ দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, বিপ্লবের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব মিলেছে, দেশ গঠনের যে কাজ হয়েছে,তা কারও হাতে তুলে দেওয়া হবে না। তিনি মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর মন্ত্রীদের নিয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে জনগণের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন,যাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই বিপ্লবের বিরোধী নন,তাঁদের অসন্তোষও ন্যায়সঙ্গত হতে পারে। তিনি বলেছেন, আমেরিকা যে অবরোধ তৈরি করে রেখেছে,তার ফলে মানুষের যতটা প্রয়োজন সেই পরিমাণ ওষুধ কিউবার সরকার আনতে পারছে না। একইভাবে বিদ্যুৎ মন্ত্রী লিভান অরোনেট বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে কেন অসুবিধা হচ্ছে তা জনগণের সামনে তুলে ধরেন। তিনি জানিয়েছেন, থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটরের সমস্যা সমাধানের জন্য ইঞ্জিনিয়াররা অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন। এক্ষেত্রেও অবরোধ প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে,যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি, প্রতিদিনের জন্য জ্বালানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে অবরোধ।
রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল বার্মুডেজ সম্প্রতি আর্টেমিসার বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন, কিউবায় অস্থিরতা তৈরির জন্য বিদেশি মিডিয়ার পক্ষ থেকে যে উসকানিমূলক প্রচার করা হয়, তার জেরে কিছু মানুষ ভুল বুঝে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমে পড়েন। বাকিদের ন্যায়সঙ্গত অসন্তোষ এবং অনিশ্চয়তা আছে বলে আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, এখানে কিছু প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠী রয়েছে। পরোক্ষভাবে মার্কিন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা এদের অর্থ দেওয়া হয় এই ধরনের বিক্ষোভ দেখানোর জন্য।
প্রসঙ্গত, কিউবা বিপ্লবের পর বিগত ৬০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ করে সঙ্কট তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। কিউবায় অস্থিরতা তৈরিতে মার্কিনী হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ ছিল কিউবার, তার প্রমাণ মিলেছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সাম্প্রতিক একটি বিবৃতিতে। তিনি সেই বিবৃতিতে এটা কিউবার জনগণের স্বাধীনতার জন্য জোরালো দাবি বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, কিউবার জনগণ কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে নাকি মুক্তি চাইছে।
কিউবার রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল বার্মুডেজ নিজে প্রতিবাদী মানুষের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেছেন। তারপর ফিরে এসে মন্ত্রীসভার বৈঠক করে পুরো বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন দেশবাসীকে। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, মহামারীর সময়ে আমেরিকার অমানবিক অবরোধের ফলে সঙ্কট রয়েছে। তারমধ্যেই যথাসম্ভব সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা চালাচ্ছে কিউবার সরকার। এরপরেও মানুষের ন্যায়সঙ্গত অসন্তোষ থাকতে পারে। সেই ক্ষোভ তারা প্রকাশ্যেই জানাতে পারেন। কিউবার মানুষ বিপ্লবের পক্ষে। বিপ্লব রক্ষা করার পক্ষে। কিন্তু এই বিক্ষোভের মধ্যে আমেরিকার অর্থে প্রতিবিপ্লবীদের ভাড়াটে বাহিনী ছিল, যারা এই ধরনের জমায়েত করে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে থাকে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, কিউবার জনগণই তাদের বিপ্লবকে রক্ষা করবে।