৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
রাজ্যভাগের যে কোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই হবে
উত্তরবঙ্গের একাধিক সভায় সূর্য মিশ্র
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ পরিচিতিসত্তার রাজনীতির ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভাজনের কৌশল নিয়ে রাজ্য ভাগের চক্রান্ত করছে বিজেপি-আরএসএস। আর তৃণমূল সরকার সুকৌশলে সেই রাজনীতিকেই মান্যতা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা বামপন্থীরা অতীতে যেমন পশ্চিমবঙ্গকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য লড়াই করেছি, এখনো রাজ্যভাগের যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করব।
সম্প্রতি সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় পার্টির ডাকা সভায় দৃঢ়তার সঙ্গে একথা জানিয়ে দিয়েছেন। সূর্য মিশ্র গত ৯ জুলাই কোচবিহার, ১০ জুলাই আলিপুরদুয়ার, ১১ জুলাই জলপাইগুড়ি এবং ১২ জুলাই শিলিগুড়িতে সভায় বক্তব্য রেখেছেন। এরমধ্যে আলিপুরদুয়ারে পার্টির প্রয়াত জেলা সম্পাদক ও কৃষক নেতা কমরেড মৃণাল রায় এবং শিলিগুড়িতে পার্টি ও কৃষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা প্রয়াত কমরেড অনিল সাহার স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন সূর্য মিশ্র। এছাড়া তিনি কোচবিহারে ‘আসন্ন পৌর নির্বাচন ও আশু কাজ’ বিষয়ে কর্মীসভায় বক্তব্য রাখেন। জলপাইগুড়িতে তিনি পার্টির এক সাধারণ সভায় বক্তব্য রেখেছেন। এর পাশাপাশি তিনি বিজেপি’র নেতা-সাংসদদের রাজ্যভাগ করার পক্ষে সাম্প্রতিক নানা মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের কাছে রাজ্যের সংহতি ও ঐক্যের প্রশ্নে পার্টি ও বামপন্থীদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এই সমস্ত উপলক্ষেই তিনি বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক-বিভেদের রাজনীতি এবং তৃণমূলের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াই জারি রাখার কথা জানিয়েছেন।
সূর্য মিশ্র বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য করার দাবিতে সরব হয়েছেন উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকজন বিজেপি সাংসদ। বিজেপি উত্তরবঙ্গ থেকে বেশি আসন পেয়ে বিধানসভায় গিয়েছে। আর সেই সুযোগে বাংলা ভাগের কথা বলে এরা সস্তা রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিজেপি’র রাজ্য ভাগের দাবির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে কার্যকর প্রতিবাদ করতে এখনো দেখা যায়নি। জেলা ও রাজ্যের নামে মানুষকে ভাগ করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, তৃণমূলই বিজেপি-কে পশ্চিমবঙ্গে ডেকে এনেছে, আর বিজেপি তৃণমূলকে বৈধতা দিয়েছে। এখন কে ক্ষমতায় বসবে তার জন্য ওদের মধ্যে লড়াই হচ্ছে। তৃণমূল সরকার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে সংবিধানকে অবমাননা করছে।
তিনি বলেছেন, বিভাজনের এই রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্য রক্ষায় সমস্ত শোষিত বঞ্চিত গরিব খেটে খাওয়া মানুষকে আমাদের সংগঠিত করতে হবে। বর্তমানে উগ্র দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তির আক্রমণ শুরু হয়েছে মানুষের ওপর। এর বিরুদ্ধে ব্যাপকতম মঞ্চ গড়ে আগামীদিনে লড়াই চালাতে হবে।
তিনি বলেন, আরএসএস-বিজেপি ফ্যাসিবাদী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। ওদের নীতিগত অবস্থানই হলো ব্রিটিশের মতো মানুষকে ভাগ করে শাসন করা। এই জন্যই ওরা ছোটো ছোটো রাজ্য গঠনের পক্ষপাতী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করতে চায় কেন্দ্রীভূত শাসন কায়েম করতে চায়। মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পারলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের দাবির সমাধান হবে না, বরং বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম নেবে। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে সুকৌশলে এই রাজনীতিই করছেন। তিনি কামতাপুরি, রাজবংশী ভাষার জন্য আলাদা আলাদা পর্ষদ করেছেন। এ রাজ্যের শাসকদল পাহাড় নিয়েও বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি করছে। আর বিজেপি এখন শুধু উত্তরবঙ্গকে নয়, জঙ্গল মহলকেও ভাগ করার চেষ্টা করছে।
এক সময়ে আমরা গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন দেখেছি, কামতাপুরি-কেএলও-গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলন দেখেছি। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিকভাবে আমরা এই বিপদের মোকাবিলা করেছি। কিন্তু বর্তমান তৃণমূল সরকারের জমানায় এরা যা করছে, তাতে বিপদ আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এই বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির মোকাবিলায় বামপন্থীরা কীভাবে লড়াই করেছেন তার উদাহরণ দিয়ে সূর্য মিশ্র বলেন, ২০০৫ সালে রাজ্য ভাগের দাবিতে কামতাপুরি আন্দোলনের সময় তৃণমূলের মদতে বামপন্থী কর্মীদের উপর হিংসাশ্রয়ী আক্রমণ হয়েছিল। ধূপগুড়ি পার্টি অফিসে আক্রমণ হয়েছিল। কেএলও জঙ্গিরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আমাদের সাত জন কর্মীকে হত্যা করেছিল। সেদিন বামপন্থীরা রাজ্যের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করেছিলেন, আজও আমরা রাজ্য ভাগ চাইনা। বিভিন্ন জনজাতিকে ভাগ করে তাদের মধ্যে উত্তেজনা, অস্থিরতা তৈরির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি থাকবে।
সূর্য মিশ্র বলেন, বামফ্রন্ট সরকার থাকার সময়ে পাহাড়কে ভাগ করার চেষ্টা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার পাহাড়ে শান্তি রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিল। আমাদের কমরেডরা প্রাণ দিয়েছেন,পাহাড়কে রাজ্য থেকে আলাদা করার অপচেষ্টা রুখেছেন। আমরা তখন মানুষকে মর্যাদা দিয়ে সবার মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষা করেছিলাম। পাহাড়কে রাজ্য থেকে আলাদা করার অপচেষ্টা রোখার পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে কামতাপুরি, কেএলও, গ্রেটার কোচবিহার প্রভৃতি বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। উত্তরবঙ্গকে আলাদা করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন বামপন্থী নেতা-কর্মীরা। এখনও বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা লড়াই করবে, জনগণকে এই বিপদের কথা বোঝাবে।
সূর্য মিশ্র বলেছেন, স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজনীতির উদ্ভব পর্ব থেকে কমিউনিস্টরা ভারতের জাতীয় সংহতি ও সাংস্কৃতিক ঐক্য রক্ষায় এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে আসছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরও এই লড়াইয়ে প্রথম সারির নেতৃত্বে বামপন্থীরা। অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পর অসম লাগোয়া উত্তরবঙ্গে বারবার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছে। আর সেই আন্দোলনকে প্রতিহত করে চা শ্রমিক, ভূমিহীন বর্গাদার, খেতমজুর সহ সমস্ত শ্রমজীবী অংশের মেহনতি মানুষের অভাব-অভিযোগকে প্রতিবাদ আন্দোলনে রূপায়িত করার মহৎ কাজ বামপন্থীরাই করেছে। আজ এই কঠিন সময়ে সমস্ত রকম প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে গিয়ে তাদের কথা শুনে মানুষের ঐক্য রক্ষা করার কাজটা বামপন্থীদেরই করতে হবে।