E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

রাজ্যে একের পর এক প্রতারক গ্রেপ্তারে তৃণমূল শাসনের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পশ্চিমবঙ্গের একের পর এক ভুয়ো আইএএস-সিবিআই-সিআইডি আধিকারিক সাজা প্রতারক ধরা পড়ার ঘটনা রাজ্যব্যাপী শাসকদল ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতিকে এক নয়া মাত্রা দিয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে এই নয়া জালিয়াতদের নানা অবৈধ কাজ কারবার বেশি করে সামনে আসছে। কসবার টিকা জালিয়াত দেবাঞ্জন দেব থেকে নদিয়ার তৃণমূল ঘনিষ্ঠ জাল সিআইডি অফিসার রাধারানী বিশ্বাস, হাওড়ার জগাছা এলাকার ভুয়ো সিবিআই অফিসার শুভব্রত ব্যানার্জি - নামের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মূলত সরকারি পদমর্যাদা ব্যবহার করার অছিলায় প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতানো এদের লক্ষ্য ছিল। রাজ্যের শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে এই ভুয়ো আইএএস ইত্যাদিদের অধিকাংশের মাখামাখির নানা তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিনই মানুষের চোখের সামনে চলে আসছে। এঁদের দ্বারা প্রতারিতদের দীর্ঘ তালিকা এবং প্রতারণার ধরন থেকে মানুষের সামনে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, শাসকদল ঘনিষ্ঠতা না থাকলে পুলিশ-প্রশাসন এহেন কীর্তিমানদের বিরুদ্ধে অনেক আগেই ব্যবস্থা নিতে পারত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েও পুলিশ গা করেনি বা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। এই জালিয়াতিতে অভিযুক্তদের কুকীর্তির বিভিন্ন খতিয়ান একটু দেখে নেওয়া যাক।

কসবা বিধানসভা এলাকার মধ্যে কসবা থানার কাছেই কর্পোরেশনের লেটারহেড, সীলমোহর, নথিপত্র জাল করে ১০ দিন ধরে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ দেবাঞ্জন দেব ভুয়ো ভ্যাকসিন শিবির চালাচ্ছিলেন। ওই শিবিরে যাদবপুরের সাংসদ মিমি চক্রবর্তী টিকা নিয়ে শংসাপত্র না পাওয়ায় পুলিশে অভিযোগ জানান। তারপরই ঘটনায় অভিযুক্ত নিজেকে আইএএস পরিচয় দেওয়া দেবাঞ্জন দেবকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওই ভ্যাকসিন সেন্টারে ভ্যাকসিনের নাম করে অর্থের বিনিময়ে টিকা হিসেবে কী দেওয়া হয়েছে। কোথা থেকে টিকা আনা হয়েছে তা নিয়ে এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। টিকা নিলেও তাঁদের কাউকেই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। তাঁরা তৃণমূলের অনেক নেতাকে বিষয়টি আগেই জানিয়েছেন কিন্তু নেতারা তা কানে তোলেননি। পৌরসভার অনুমতি ছাড়া এতদিন কিভাবে ক্যাম্প চলল তা নিয়ে অন্ধকারে ছিল স্বাস্থ্য ভবনও। সাংসদ শান্তনু সেন থেকে নারদায় অভিযুক্ত মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি, ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে দেবাঞ্জনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে এখনও। যদিও মেয়র ফিরহাদ হাকিম সহ ছোটো বড়ো সব তৃণমূল নেতা এই প্রতারকের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের কথা অস্বীকার করছেন। নিজেকে কলকাতা কর্পোরেশনের যুগ্ম সচিব হিসেবে পরিচয় দিত এই ভুয়ো আইএএস। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠার ফলকে কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র এবং বর্তমান প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে তাঁর নাম খোদাই করা ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। পরে পুরসভা তা দায়িত্ব নিয়ে সরিয়ে নেয়। কালো কাঁচের গাড়িতে ঘোরা এই দেবাঞ্জনের ভুয়ো সরকারি অ্যাকাউন্ট খোলা সহ আরও কীর্তি রয়েছে।

এরকমই আরেক জন নদীয়ায় রাধারানী বিশ্বাস। রাধারানী বিশ্বাস মাঝে মাঝে পুলিশের পোশাকেই জনসমক্ষে আসতেন, নিজেকে সিআইডি অফিসার হিসেবে পরিচয় দিতেন। কৃষ্ণনগরের ডাকসাইটে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র, মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস সহ তৃণমূলের বিভিন্ন নেতার সাথে বিভিন্ন সামাজিক কাজে তাকে দেখা গেছে বলে এলাকার মানুষ জানিয়েছেন। এই সিআইডি অফিসারের ভেকধারী রাধারানী বিশ্বাস স্বাস্থ্য দপ্তরের গ্রুপ-ডি পদে চাকরি করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক যুবকের থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিয়ে প্রতারণা করেন বলে অভিযোগ। জানা গেছে নদীয়ার বিভিন্ন এলাকার বেকার যুবকদের সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারণা করেছেন রাধারানী বিশ্বাস।

এরকমই আর এক প্রতারক আসিফুল হক ৩০ জুন থিয়েটার রোড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। নিজেকে ভিজিল্যান্স দপ্তরের অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়ে কাজ হাসিল করতেন। অভিযোগ, তার সাথেও যোগ রয়েছে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের।

হাওড়া জেলার জগাছা এলাকার ভুয়ো সিবিআই অফিসার শুভজিৎ ব্যানার্জি তৃণমূল নেতাদের আশীর্বাদধন্য আরও এক প্রতারক। অভিযোগ, সিবিআই অফিসার সেজে প্রতারণাচক্র চালাচ্ছিলেন এই শুভজিৎ ব্যানার্জি। তিনি বিভিন্ন যুবককে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে তাদের প্রতারণা করতেন। তার পরিবারের লোকেরাই এই অভিযোগ করেছেন। তারা এলাকায় তৃণমূলের নেতাদের কাছে প্রতিকার চেয়েও কোনো সুরাহা হয়নি বলে জানিয়েছেন। পুলিশ তাঁকে দিল্লি থেকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে। এছাড়াও অভিজিৎ কর নামের বাঁকুড়ার এক যুবক নিজেকে সেনা অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়েছে যা ভুয়ো। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

উপরের খতিয়ান থেকে পরিষ্কার রাজ্যের পরিস্থিতি এখন অপরাধীদের মুক্তাঞ্চলের মতো ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি অবশ্য একদিনে হয় নি। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী নিজে গিয়ে ভবানীপুর থানা থেকে অভিযুক্তদের ছাড়িয়ে আনার ঘটনায় রাজ্যের অন্ধকারের জীবেরা সকলেই বুঝতে পেরেছিল, যে নয়া সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা তাদের পক্ষে। মানুষ শুনেছিলেন তাঁর সেই স্বীকারোক্তি। আবার ২০১৯ সালে সারদায় নথি গরমিলের দায়ে অভিযুক্ত আইপিএস রাজীব কুমারকে সিবিআই-এর গ্রেফতারি এড়াতে ধরনায় বসেছিলেন তিনি। তৃণমূল কংগ্রেসের ২০২০ সালের ছবিটা আরও অর্থবহ। এই দলের মুখপাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সারদাকাণ্ডে জেল খাটা অন্যতম অভিযুক্ত কুনাল ঘোষ যিনি এর আগে বলেছিলেন সারদার সর্বোচ্চ সুবিধাভোগীর নাম মমতা ব্যানার্জি। আর ২০২১-এ গোটা দুনিয়া দেখল নারদায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের ছাড়াতে সিবিআই দপ্তরে সটান পৌঁছে গেলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। উৎসাহিত দুষ্কৃতীরা এই সব ঘটনা থেকেই বেশি করে বুঝতে পারে এই তথাকথিত মা-মাটি-মানুষের সরকার আসলে দুষ্কৃতীদের জন্য অনুপ্রেরণায় ভরপুর। তারা বার্তা পায় পশ্চিমবঙ্গ এখন দুষ্কৃতীদের অভয়ারণ্য, আর ত্রস্ত সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করছেন এই রাজ্য ক্রমশ জঙ্গলরাজে পরিণত হচ্ছে। এই দেবাঞ্জনদের মতো এরকম আরও বহু নাম ছড়িয়ে রয়েছে রাজ্যজুড়ে। যারা শাসক ঘনিষ্ঠ, কিন্তু মানুষ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেন না বলে অভিযোগ। তবে মানুষ প্রতিবাদ করছেন। পথে নামছেন। তাঁরা পাশে পাচ্ছেন বামপন্থীদের।