৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
আজহারউদ্দীন খানঃ জীবনভাষ্য জীবনতথ্য
বিজয় পাল
একেবারে সূচনাতেই অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর রেখে সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন আজহারউদ্দীন খান। পনেরোটি গ্রন্থ লিখলেও প্রথম গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ লিখে যে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, সেটাই তাঁর পরিচয় হয়ে দাঁড়ালো। যেমন অসংখ্য অসাধারণ কবিতা উপহার দিয়েও ‘বিদ্রোহী’ ‘সাম্যবাদী’ কাব্যখ্যাতিই নজরুলের প্রধান পরিচয় হয়ে রয়েছে। আজহারদাও তেমনি ‘নজরুল গবেষক’ পরিচয়ে থেকে গেছেন। ষাট বছরের সাহিত্য সাধনায় কত পথ অতিক্রম করেছেন তিনি, খুব অল্প মানুষই তার হদিশ রাখেন। নিজে বুঝেওছিলেন সেটা। তাই বলেছেন, ‘‘আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল কবিকে নিয়ে আলোচনা ব্যাপক হোক, আমার এ আকাঙ্ক্ষা ফলবতী হয়েছে। সাধারণ পাঠক থেকে বিদগ্ধজনের প্রশংসা লাভ করেছে। এপার-ওপার বাংলায় বইটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর গ্রন্থ (Reference book) রূপে সম্মানিত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডকুমেন্টারি চিত্রে স্বীকৃতি পেয়েছে। পাঠক আমার প্রত্যাশা পূরণ করেছেন, এর চেয়ে বেশি আর কী পাবার আছে। আমি তৃপ্ত, আমি আনন্দিত।’’
এই আজহারদা চলে গেলেন, ২২ জুন ’২১, রাত ১১.৫৫ মিনিটে। দিন সাতেক ধরেই বোঝা যাচ্ছিল, যে কোনো সময় চলে যাবেন। ১৩ বছর আগে প্রস্টেট অপারেশনের সময় ক্যান্সার ধরা পড়ে। তার বিরুদ্ধে লড়াই করেই কাজের মধ্যে ছিলেন। বলার মতো অন্য কোনো অসুখ ছিল না তাঁর। আর যা কিছু, তা ৯১ বছর বয়সের অনুষঙ্গ, যা ১৯৩০-এর ১ জানুয়ারি থেকে শরীর ও মনের বিকাশের চাপ সহ্য করতে অনিবার্যভাবে এসেছিল। সে সবের পরিসমাপ্তি হলো জীবনের বিনিময়ে।
মানুষটার স্বভাবের মতোই মৃত্যুও এলো যে ধীর লয়ে। কোথাও কোনো চাপল্য নেই, কপটতা নেই, নেই কোনো লুকোছাপা, শান্ত কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল। ভেতরে দৃঢ়তার কাঠিন্য কিন্তু বাইরে সুভদ্র - সৌজন্যের পরিমিতিতে কোথাও এতটুকু ঘাটতি নেই। এক ঝাঁক বক্তা সভায়। কত যুক্তিপূর্ণ কথা বলছেন কত বক্তা, যা তাঁর ভাবনার সঙ্গে সবটা খাপ খাবে না। তাই বলে নিজের ভাবনা থেকে একচুল সরে আসার লক্ষণ নেই তাঁর মধ্যে; মুখেচোখেও কোনো গররাজির চিহ্ন নেই। পালা এলে শান্তভাবেই নিজের কথা বললেন, বিরোধিতা আপনার থাকতেই পারে তাঁর কথায়, কিন্তু মুগ্ধতাও থাকবে তাঁর যুক্তিবাণে আর পরিবেশনের আঙ্গিকে। ধীরে ধীরে শরীরটা ক্ষয়ে যাচ্ছিল, হয়ে যাচ্ছিলেন শীর্ণ থেকে শীর্ণকায়। ভেতরটা যন্ত্রণায় কাহিল, কিন্তু মুখাবয়বে সেই প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসার চিহ্ন অটুট। সবাক থেকে নির্বাক হলেন। তবুও মুখাবয়বে হৃদ্যতার ছাপটুকু স্পষ্টই থেকে গেল; নিভে গেল জীবনদীপ।
তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ সাহিত্যের লেখক। প্রবন্ধ লিখিয়েদের কতজন পাঠক চেনেন, জানেন বুঝতে অসুবিধা হয় না কারও। আজহারদা একে শুধুই প্রবন্ধ লিখিয়ে তার ওপর সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। তাছাড়া অন্য কোনো ধরনের লেখা প্রায় লেখেনইনি। তার উপর গত প্রায় এক দশক তিনি লেখার জগতে থাকতে পারেননি। এক পুত্রতুল্য অনুজ হিসেবে নানা সময়ে তাঁর মতামত শুনেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। গবেষণামূলক বা অনুসন্ধানমূলক লেখার পাশাপাশি সমসাময়িক সময়ে সামনে আসা ঘটনাক্রমের বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখতে রাজি হননি তিনি কখনও। তাই লেখার রাজ্যে উপরিতলে ভেসে থাকা যাকে বলে সে পথ তিনি মারাননি। নিজের কথায় বলেছেনঃ ‘আমি লেখক হতে চাইনি, পাঠক হতে চেয়েছি।’ পেশার জীবনে গ্রন্থাগারিকের চাকরিকে পুরোদস্তুর ব্যবহার করেছেন বই পড়ায়। পড়তে পড়তে যেখানে মনে করেছেন আলো ফেলা দরকার সেখানেই কলম ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু তাঁকে নিয়ে লেখেননি। এই বাংলায় বাংলা সাহিত্যে যাঁদের পরিচয় সমধিক তাঁদের মধ্যে কেবল নজরুল ইসলাম ছাড়া আর যাঁদের নিয়ে তিনি কলম ধরেছেন সাধারণের মধ্যে তাঁদের নিয়ে জানা-বোঝা খুবই কম। হবেই তো, যেখানে আলো পড়েনি তিনি বিচরণ করেছেন সেখানে।
তাঁর আগে কেউ নজরুলের সাহিত্য কৃতি নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো তিনি নজরুল গবেষক হয়ে উঠতেন না। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম প্রামাণ্য নজরুল জীবনীকার ও তাঁর সাহিত্য সমালোচক। তিনিই আকর। প্রথম সংস্করণে ৮টি প্রবন্ধ ২১২ পৃষ্ঠার ডিমাই সাইজের বই। সর্বশেষ ৮ম সংস্করণ ২১টি প্রবন্ধ নিয়ে। রয়াল সাইজে পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৫০। সে এক মহাভারতোপম পুস্তক। বোঝাই যাচ্ছে, নিরন্তর অনুসন্ধান ও গবেষণায় তিনি নিমগ্ন থেকেছেন। পাশাপাশি নজরুলের অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত লেখা একত্রিত করে নজরুল রচনার সম্পূর্ণতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ। এই পুস্তক দুই বাংলায় তাঁর জনপ্রিয়তা তুলে ধরে। কলকাতা থেকে দূরে থেকে এমন গভীর গবেষণামূলক কাজ করা সত্যিই এক অসাধ্যসাধন ব্যাপার। মাত্র ২০-২১ বছরের সাহিত্য জীবন নজরুলের। তার মধ্যেই সঙ্গীত রচনায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে গেছেন। তা সত্ত্বেও নজরুলের কত গান হারিয়ে গেছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত যত শোনা যায়, নজরুলগীতি সেখানে কোথায়? নজরুল স্বরলিপির ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। এমন সব বিষয় খুঁটিয়ে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি পাঠ করলে বোঝা যায় মফস্সল শহর মেদিনীপুরে বসে তিনি কীভাবে এমন তথ্যবহুল কাজ করেছেন। এই গ্রন্থ লেখায় তিনি অকৃপণ সহায়তা পেয়েছেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কাছ থেকে।
এছাড়া ‘বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল’, ‘বাংলা সাহিত্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’, ‘বাংলা সাহিত্যে আব্দুল হাই’, ‘গ্যেটে ও বাংলা সাহিত্য’ তাঁর অন্যতম গবেষণা গ্রন্থ। মীর মোশারফ হোসেন, মোজাম্মেল হক প্রমুখের জীবনী নির্ভর গ্রন্থ ‘বিলুপ্ত হৃদয়’। ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ লিখেছেন মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের জীবনীনির্ভর গ্রন্থ ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’। শাহাদাৎ হোসেন-এর জীবনী গ্রন্থের নাম রেখেছেন, ‘অফুরন্ত রৌদ্রের তিমির’। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে নিয়ে লেখা ‘মেধাবী নীলিমা’। উল্লেখিত শেষ চারজনকে নিয়ে একত্রে আরও একটি গ্রন্থ ‘দীপ্ত আলোর বন্যা’ লিখেছেন। লিখেছেন - ‘সাহিত্য সাধনায় বিদ্যাসাগর’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র অন্য ভাবনায়’।
তিনি প্রথম প্রবন্ধ লেখেন ‘মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ’। যদিও এটি তাঁর দ্বিতীয় মুদ্রিত প্রবন্ধ। মুদ্রিত প্রথম প্রবন্ধ, ‘কবি দর্শনে’, এস ওয়াজেদ আলি ও কায়কোবাদকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন যুগান্তর-এর রবিবাসরীয়তে।
তাঁর ৬০ বছরের সাহিত্য জীবনে দেড়শতাধিক প্রবন্ধ, ১৭টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৫টি গ্রন্থ সম্পাদনায় ও তিনটি পত্রিকা সম্পাদনায় নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকেছেন। ৩৩টি গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন। দশ জন লেখক তাঁদের গ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করেছেন।
চারজন বন্ধু মিলে ছাত্রাবস্থায় গঠন করেন ‘আহ্বান সংস্কৃতি পরিষদ’। পরিষদের মুখপাত্ররূপে হাতে লেখা পত্রিকা ‘আহ্বান’ বছরে দুটি করে সংখ্যা, চার-পাঁচ বছর প্রকাশ করেছেন। সম্পাদক ছিলেন তিনি। একটি পূজা সংখ্যা কলকাতার ‘ছাত্র সংহতি’ কর্তৃক শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায় (১৯৫৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি)।
ইতিহাস, দর্শন না সাহিত্য কোন্ বিষয়ে তিনি মনোনিবেশ করবেন এই দ্বিধা গোড়ায় তাঁর মধ্যে ছিল। আত্মকথায় জানা যায়, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে তিনি সাহিত্যের পথ বেছে নেন। মুহম্মদ বাণী ‘ইলাহি আর –না’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বর বস্তু যেমনটি আছে ঠিক তেমনটি আমাদের দেখাও।’ ভাষাচার্যের পরামর্শে তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দৃঢ় ছিলেন। নজরুলের জীবন কাহিনির কয়েকটি ঘটনার ব্যাখা নিয়ে তাঁর সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদ-এর দ্বিমত হয়েছে। সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘জীবনী লিখতে গিয়ে কত ধরনের হ্যাপা সামলাতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দোষ-গুণে মানুষ কিন্তু আমাদের দেশে জীবনী লিখতে গেলে নির্ভেজাল প্রশংসা করতে হয়, কোনো দোষের কথা বলা যাবে না পাছে ব্যক্তির ইমেজ নষ্ট হয়। ...জীবনী রচনার প্রচলিত আদল না পালটালে রক্তমাংসের মানুষ পাওয়া যাবে না। ...ইংরেজিতে কথা আছে প্রকৃত জীবনী লেখক সে-ই যে রাত্রে বিছানা পাতে, সকালে বিছানা গোটায়। বিদেশি সাহিত্যে জীবনী রচনায় কোনো ঢাক গুড় গুড় ভাব নেই, ...দান্তে, গ্যেটে, শেলি, বায়রন, ব্রাউনিং প্রমুখের প্রেমকাহিনি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। ...নারী প্রগতির কথা আমরা মুখে যাই বলি না কেন এখনও আমাদের সমাজ পুরোপুরি সংস্কারমুক্ত হয়নি। ...নজরুল চরিত্রকে অমলিন রাখার জন্য জীবনীকাররা তাঁর প্রেম নিবেদনকে স্বর্গীয় অর্থাৎ প্লেটোনিক বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ...ভণ্ডামিরও সীমা আছে।’’
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাঁর ব্যবহৃত তথ্য, ব্যাখ্যা নির্ভুল হোক বা না হোক, পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কতটা স্বচ্ছ ও আধুনিক। এই নির্মোহ সাহিত্য সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর জীবন দর্শনের সঙ্গে অভিন্ন ছিল। স্কুল জীবনের তৎকালীন সময়ের কমিউনিস্ট নেতা কানাই ভৌমিক তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁর প্রভাব থাকা বিচিত্র কিছু নয়। আসল কথা তাঁর নিজের মানস গঠন। তিনি লিখেছেন, ‘‘দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার হাতে ‘সঞ্চিতা’ আসে। ‘সঞ্চিতা’র ‘সাম্যবাদী’ কবিতা সমষ্টি আমাকে আলোড়িত করে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আমার ঘুম কেড়ে নেয়।’’ কলেজে ভরতি হয়ে নজরুলের দারিদ্র্যের খবর জানতে পারেন। কলেজে ফুটবল খেলার প্রদর্শনীর আয়োজন করে কবিপত্নীর হাতে অর্থ তুলে দিতে যান মানিকতলার রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিটের বাড়িতে। অসুস্থ কবিকে দেখে তাঁর মন বেদনায় ভরে ওঠে। শুরু হয় তাঁর নজরুল গবেষণার কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে কলেজের আই এ পরীক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগারে কর্মী হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে। চাকরি পাকা হওয়ার সময় তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে, তিনি সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, কমিউনিস্ট ও পাকিস্তানের গুপ্তচর। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস ও ইসলাম ধর্মের বিষয়ে গভীর পড়াশোনা করে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইসলাম ও পাকিস্তান’ (যুগান্তর সাময়িকী, ১৯৫০), ‘মধ্যযুগের ভারতীয় সংস্কৃতি’ (বঙ্গশ্রী, ১৯৫১), ‘ইসলামিক সংস্কৃতি ও বিশ্ব প্রগতি’ প্রবন্ধ ১৯৫২ সালে ‘বঙ্গশ্রী’, পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। ১৯৫৭ সালে ‘জাগরণ’ পত্রিকায় ‘ইসলাম বহুবিবাহ ও কয়েকটি সমস্যা’ প্রবন্ধটি লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি ‘পীরপ্রথা’র বিরোধিতা করেন। প্রবন্ধের কপি মৌলবাদী মুসলিমরা কলকাতায় পুড়িয়ে দেয়, আগুন লাগিয়ে দেয় প্রেসে। এই সময় বাড়ি থেকে গ্রন্থাগারে যাওয়ার সময় সাদা পোশাকে আইবি তাঁকে অনুসরণ করত। যাই হোক কলকাতায় তাঁর লেখা পোড়ানোর খবরে ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘মৌলবাদী’ অভিযোগ থেকে রেহাই পান। ‘পাকিস্তানের গুপ্তচর’ অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ ছিল তাঁর প্রবন্ধের নাম ‘ইসলাম ও পাকিস্তান’। এই সময় এক বছরের জন্য তাঁর কলকাতা যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সেই সময় মেদিনীপুরের কমিউনিস্ট নেতা দেবেন দাশ, সরোজ রায়, অনিল ভঞ্জ, রজনী মাইতি প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং এঁদের দ্বারা প্রকাশিত ‘মেদিনীপুরের কথা’ সংবাদপত্রের সঙ্গে তাঁর যোগ থাকার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে ‘কমিউনিস্ট’-এর অভিযোগ দাখিল হয়। শহরের প্রগতিপন্থী শুভচেতনার মানুষজন পাল্টা চাপ তৈরি করে পুলিশের বিবেচনায় তাঁকে অভিযোগ মুক্ত করে।
আজকের দিনে চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, সেই সময় এভাবে বহুচিন্তক প্রগতি তথা সাম্যবাদী চিন্তার অনুসারী হলেও সময়ের বাঁকে নিজেদের অবিচল রাখতে পারেননি। কলকাতাকেন্দ্রিক কত খ্যাতনামা ‘বুদ্ধিজীবী’র এমন স্খলন দেখেছি, দেখেছি সাহিত্য জগতের কত নক্ষত্রের বিচারধারার ভ্রান্তি। মনে ঝড় তোলা, আগুন ঝরানো লেখা তিনি লেখেননি কখনও। কিন্তু তাঁর প্রগতি, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভাবনায় কমিউনিস্টদের ভূমিকা চিনতে বা বুঝতে কখনই দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়নি। সমগ্র জীবনচর্যায় ফল্গুধারার মতো তা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বিরতিহীন ছিল। সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর সময়ও তাঁর মস্তিষ্ক ও ভাবনাকোষ সম্পূর্ণ সচল ও সজাগ ছিল। এর পরেও বেশ কয়েকবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছি। তাঁর ভাবনারেখায় কোথাও কোনো চিরের সন্ধান পাইনি। সেই শান্ত অথচ ঋজু ভাব অটুট ছিল।
নজরুল গবেষণার জন্য ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ তাঁকে ‘নজরুল পুরস্কার’ প্রদান করে। এছাড়াও নানাবিধ অন্তত দশটি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে পেয়েছেন আব্দুল হাই সাহিত্য পুরস্কার। জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি লিট, ২০০৭ সালের ৭ এপ্রিল।
‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’-এর ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিয়ে ১৯৭২ সালে এই রাজ্যে প্রগতি ভাবনার লেখক শিল্পীরা যুক্ত হয়ে নবধারায় যে সংগঠনের সূচনা করেন তা পূর্ণাঙ্গতা পেল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় ১৯৮২ সালের ১১ জুলাই তাঁর সভাপতিত্বে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ-এর জেলা শাখার পত্তনের মধ্য দিয়ে। সেই দায়িত্ব পালন করে গেলেন প্রায় ৪০ বছর ধরে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। সংগঠনের এই পদ গ্রহণ করা ও বজায় রাখার কারণে কোনো কেজো মহল তাঁকে না-পসন্দ করেছে। কিন্তু তিনি অবিচল ছিলেন। সংগঠনে থেকেও অনেকেই এ ডালে সে ডালে ঘুরে বেড়ান। আজহারদা তাদের ত্যাগ করার দৃঢ় মতামত দিতেন। বহু সভায় নাম ধরে বলতেন, ‘গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে, এদের বাদ দাও বিজয়’।
সংগঠনের অনেক প্রাজ্ঞ বন্ধুকে দেখেছি, আজহারদার পাণ্ডিত্যকে তারা ব্যবহার করতে চাইত, কিন্তু তাঁর আদর্শকে নয়। মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু বজ্র কঠিন কাঠিন্যে তাদের এড়িয়ে চলতেন। দীর্ঘ এই সময়ে কত বাঁক এসেছে। কত পাখি বাসা পাল্টেছে, কতজন দুয়ো দিয়েছে। কিন্তু প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার ফারাক বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়নি কোনোদিন। এক মুহূর্তের জন্য তাঁকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি। তিনি কোনোদিন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ গ্রহণ করেননি। কিন্তু কমিউনিস্ট বিচারধারা তাঁর সত্তায় মিশে ছিল। কোনোদিন কোথাও তাঁকে তত্ত্বের আধারে কথা বলতে দেখা যায়নি। তিনি জীবনভাষ্যের সঙ্গে জীবনতথ্যের মিশেল ঘটিয়ে সাহিত্যের ভাষাতেই কথা বলেছেন। এখানেই তাঁর জয়, সাফল্য, অনন্যতা।
তাঁর নেতৃত্বে আমরা যৌথ কাজের ধারা বজায় রাখতে পেরেছি। মাঝেমধ্যে ছন্দপতন হলে তিনি বলতেন, ধরিয়ে দিতেন। সেই বোঝাপড়া নিয়েই ৩৬ বছর তিনি জেলা সংগঠনের সাহিত্য মুখপত্র ‘শব্দের মিছিল’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বলা বাহুল্য সম্পাদনার কাজ একটা যৌথ দায়িত্ব, বিশেষত পত্রিকা যখন সংগঠনের মুখপত্র। কাজের ধারায় আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল। হাতে কলমে কাজ শেখাতেন। অনেক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘সম্পাদকীয় কলম’ খুব জোর করে না ধরলে লিখতেন না, বলতেন তোমরাই লেখ, সংগঠনের মুখপত্র, সম্পাদকীয় কলম যে কোনো একজন ভাগ করে লেখ। ধারাবাহিকভাবে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না। একক পত্রিকা সম্পাদনায় ব্যাপক স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। সংগঠনের মুখপত্রের দায় অনেক, তাও আবার এমন একটা শিথিল সংগঠন বুননের ক্ষেত্রে। বিষয়সূচি ও লেখকসূচি ভাবার পরের কাজ নিরন্তর যন্ত্রণার। দৈনন্দিন সেসব হয়তো তিনি হাতে কলমে ততটা করতেন না কিন্তু নিরন্তর খোঁজ নেওয়া ও তাগাদার অন্ত ছিল না। তিনি সম্পাদক থাকায় কত রকমের সহায়তা যে পাওয়া গেছে তা অন্যত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি সম্পাদক থাকার কারণে ‘শব্দের মিছিল’ অনেক খ্যাতনামা লেখকদের আনুকূল্য পেয়েছে। ২০০৩ সালে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনায় ‘শব্দের মিছিল’ শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার লাভ করে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদক হিসেবে আজহারদার হাতে সম্মাননাপত্র তুলে দেন। তাঁর অভিভাবকত্বে অনেকগুলি গ্রন্থ জেলা সংগঠন প্রকাশ করতে পেরেছে। ‘সারস্বত সাধনায় মেদিনীপুর’, ‘অগ্নিবীণ’ (নজরুল জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ), ‘প্রত্যহ নবীন ’ (গোপাল হালদার জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ), ‘অরূপ রতন’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ), ‘নিত্যকালের যাত্রী’ (রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ) প্রভৃতি।
মৃদুভাষী, স্নেহশীল ও অতিথিপরায়ণতার মতো গুণাবলি সহজেই সকলের নজরে পড়বে। অতি সাধারণ জীবন যাপন। ধুতির সঙ্গে সাদা পাঞ্জাবি, কোনোদিন ইস্তিরি করা পরতে দেখিনি। নিজের মতাদর্শে অটুট থেকেও কীভাবে সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলা যায় তার আদর্শ দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন আজহারদা।
এমন লাবণ্যপূর্ণ প্রাণের সন্ধানেই তো মানুষের অভিযান। এখনকার হিসেবে পরিণত বয়সেই তাঁর মৃত্যু হলেও এমন মানুষের চলে যাওয়া মেনে নিতে গভীর বেদনা সহ্য করতে হয়। তাঁর জ্ঞানচর্চার ফসল অধ্যয়ন করা ও সেই লক্ষ্যে নিজেদের পরিচালনা করার অঙ্গীকারই হোক আমাদের শোক প্রকাশের ভাষা।