৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
গণতন্ত্র ও শিক্ষা
সায়ন ভট্টাচার্য
গণতন্ত্রের পুষ্টি বৃদ্ধি পায় রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার শিক্ষার মানদণ্ডের সূচক বৃদ্ধি অনুসারে। ২০২০-২১, এই দেড় বছর ধরে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বুকে যেভাবে ছুরিকাঘাত করা হলো - সেই অভিশপ্ত ইতিহাস একদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে ক্রুশকাঠের মতো বহন করে নিয়ে চলতে হবে।
ভ্যাকসিন আটকে রেখে দিনের পর দিন, চিকিৎসা ব্যবস্থায় তীব্র কর্পোরেট অনুপ্রবেশ আর অর্থনৈতিকভাবে বন্দি জীবন - প্রকৃত প্রস্তাবে মহামারীর আকার ধারণ করলো। মধ্যবিত্তের অজ্ঞতা এই মহামারীকে দিনের পর দিন আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের হতাশা তৈরি করার মধ্যে দিয়েই তো ক্ষমতাশালী শাসন আরও বেশি করে জনবিচ্ছিন্ন শাসনতন্ত্রের দৃঢ় কাঠামো তৈরি করছে। প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয় ইতিহাসে গণতন্ত্র ও শিক্ষার সম্পর্কটা ঠিক কেমন - সেটা বুঝে নেওয়া।
আধুনিক যুগের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশ গণতন্ত্র বলতে কেবল নির্বাচনকেই বুঝে থাকে। কার্যত এটি ভুল নয়। কেননা একটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সহ যেসকল বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়, তা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্তিম পরিণতি, একমাত্র শর্ত নয়। গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রথম এবং প্রধান শর্তটির নাম নাগরিকের শিক্ষা। গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য আরও কয়েকটি শর্তের (রাজনৈতিক সচেতনতা, স্বাধীনতা, সাম্য, আইনের শাসন প্রভৃতি) প্রয়োজন হলেও শিক্ষা ব্যতীত তা অর্জন অসম্ভব। শিক্ষার দ্বারাই একজন নাগরিক রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিজ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করার মাধ্যমে ত্যাগ, সহানুভূতি, নিস্বার্থ রাষ্ট্রীয় সেবা, নিয়মানুবর্তিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ আয়ত্ত করতে পারে। শিক্ষার মধ্য দিয়েই নাগরিকের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। শিক্ষার এই চেষ্টাকেই বর্তমানে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। দিবারাত্র অনুশীলন দ্বারা এক একজন মানুষ এমন একটা পর্যায়ে উত্তীর্ণ হন যেখানে তিনি সমসাময়িক বিশ্বচিন্তা এবং বিশ্ববোধের মাধ্যম হয়ে ওঠেন, তাঁর মধ্যে সর্বদাই তখন প্রকাশিত হয় বিশ্বের সর্বাধুনিক চিন্তাগুলো। মার্কিন বিপ্লবী চিন্তানায়ক টম পেইন, ফরাসি বিপ্লবের অনুপ্রেরণাদাতা ভলতেয়ার, জার্মানির মুক্তিকামী চিন্তাবিদ মার্কস ও এঙ্গেলস। এঁদেরই তখন বলা যায় বিশ্বনাগরিক। কিন্তু এমন বিশ্বনাগরিক তো রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক, তাই যেভাবেই হোক শিক্ষা আর একতার থেকে আস্তে আস্তে একটি প্রজন্মের চৈতন্যকাঠামো ভেঙে দিতে তৎপর আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
গণতন্ত্রের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বর্তমান সময়ের গণতন্ত্রের সাফল্যে বাধাসৃষ্টিকারী নানা সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনায় শিক্ষার প্রসঙ্গটি অব্যক্ত ও অমূল্যায়িত থেকে যাচ্ছে।
প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো ও অ্যরিস্টটল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন কেননা তৎকালীন গ্রিসে কেবল যোদ্ধা ও ভূমির মালিকদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো। এরা ছিল মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ এবং এদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত। প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বলেন, “প্রশাসন হলো এমন একটি কলা যা সাধারণ মানুষের দ্বারা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। শুধু বুদ্ধিমান ও যোগ্য মানুষের পক্ষেই প্রশাসনকে অনুধাবন করা সম্ভব।” তৎকালীন গ্রিসে সাধারণ ও বুদ্ধিমান-যোগ্য মানুষের মাঝে যে একটি ব্যাপক পার্থক্য ছিল তা প্লেটোর এ উক্তি থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একজন মানুষকে অসাধারণ, বুদ্ধিমান ও যোগ্য করে তুলতে শিক্ষাই অপরিহার্য। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল গণতন্ত্রের প্রধান দুটি শর্ত হিসেবে শিক্ষা ও উত্তম নৈতিক চরিত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মিল তার ‘কনসিডারেশনস অন রিপ্রেজেনটেটিভ গভর্নমেন্ট’ (Considerations on Representative Government) গ্রন্থে বলেন, “জনগণের জন্য সর্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করার পূর্বে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।”
গণতন্ত্রকে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কবল থেকে রক্ষা করতে নাগরিকদের যে সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন তারও মূলে রয়েছে শিক্ষা। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে একটি স্বতন্ত্র রূপ দান করে এর অন্তর্নিহিত সাম্য ও স্বাধীনতার নীতি। আর নির্বাচন এর সবচেয়ে দৃশ্যমান বহিঃপ্রকাশ। নাগরিকের শিক্ষা এ দু’টির মাঝে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের সংকটের সমাধান ও এর সাফল্যের জন্য তাই শিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। আর এটি অর্জন করা সম্ভব হলে আগামী দিনগুলোতে জনগণের মাঝে গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে এর জনকল্যাণ নিশ্চিত করার সক্ষমতা।
সংকটকালীন সময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই মানুষের এই রাষ্ট্রবাদী জীবনে শিক্ষা ও গণতন্ত্রের প্রয়োগ একটি সমাজ ব্যবস্থাকে নতুন প্রাণের আশা দিতে পারে।