৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
চাই না ‘মোদীর দেশ’, চাই আমাদের দেশ
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
বর্তমান শাসকদলের একটা বৈশিষ্ট্য হলো এরা ওদের অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোনো সংকাচ বা দ্বিধাতে ভোগে না। অপেক্ষা করে কখন অনুকূল সময় আসবে, এদের মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো প্রকাশ পায় না। কিন্তু অনুকূলে সময় বুঝলে ঝড়ের গতিতে নিজেদের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সারা পৃথিবীতে কেউ সাহস পায়নি কোবিড-১৯ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির, শিক্ষানীতির মৌলিক পরিবর্তনের। একমাত্র ব্যতিক্রম ‘মোদীর দেশ’। অথচ সারা দেশে চিকিৎসার অভাবে, অক্সিজেনের অভাবে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ চলে গেল, নদীতে ভেসে বেড়ালো মৃতদেহ, অধিকাংশ মানুষের টিকার ব্যবস্থা হলো না। শুধু ‘মন কি বাত’ শুনিয়ে যাবতীয় নাগরিক কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না এটা মানুষ বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছে রাজ্যে রাজ্যে।
‘মোদীর দেশ’ হলো এই পৃথিবীর একমাত্র হতভাগ্য দেশ, যেখানে মানুষ করোনা থেকে মুক্তি পেতে দলবেঁধে থালা-গেলাস-বাটি বাজাতে বাজাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আর, ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনা তাড়ানোর পরামর্শ পেয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এ দেশ হও সেই দেশ যে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি প্রকাশ্যে চমকাতে-ধমকাতে পারে। কুণালের ‘এক ফোনে এক লাখ’এর মতো ‘এক ফোনে বাজিমাত’ করে দিয়ে ওষুধের গাড়ি পোঁছে গিয়েছিল এদেশ থেকে ওদেশে। সেদিনের সেই অসম্মানজনক ফোনে আমাদেরও বুকে ধাক্কা লেগেছিল যারা দেশকে ভালোবাসি, যারা দেশকে নিয়ে বা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বিদেশির অপমানজনক আচরণ মানতে রাজি না কখনোই। যদিও সব বিষয়ে ‘দেশপ্রেমের বাণী’র বন্যা বইয়ে দেওয়া বাহিনীর নীরবতা, নিঃস্তব্ধতা ছিল দেশ জুড়ে। বাজনদার মিডিয়ার মুখে কথা ছিল না সেই সময়ে। আঙুল উঁচিয়ে গলা তুলে কথা বলা গোস্বামী বাবুরা পর্যন্ত সাক্ষী গোপাল হয়ে বসে ছিলেন। অথচ এখন সরকারের বিরোধিতা আর দেশ বিরোধিতাকে সমার্থক করে দেওয়া হচ্ছে। ৮৪ বছরের সমাজকর্মী (প্রান্তিক আদিবাসী মানুষকে সাহায্য করে যাঁর জীবন কেটেছে)স্ট্যান স্বামীকে বৃদ্ধ অবস্থায় চেন বাঁধা অবস্থায় গোরু-ছাগলের জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছে। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে দেশজুড়ে অভিযোগ উঠেছে। এই ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’র বিরুদ্ধে কোনো ‘সুবিধাবাদী নীরবতা’ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এমন রব উঠে যেতে শুরু করেছে দেশের কোণে কোণে।
যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনাকে পিছনে ফেলে শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে কেউ নিজের দলের চিন্তার অভিমুখে দেশকে চালাতে চাইলে যা যা ঘটতে পারে আমাদের দেশেও তাই তাই ঘটে চলেছে। করোনা ভাইরাসকে ঠেকাতে যখন স্বাস্থ্য বিজ্ঞানসচেতন দেশগুলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দিয়েছে, তখন মার্কিন দেশের (তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সেই দেশের নির্বাচনে জেতাতে হয়তো) এদেশে এনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদেরকে অভ্যর্থনার রাজকীয় ব্যবস্থা করে সংক্রমণ ছড়ানোর সরকারি আয়োজনের মূল্য দিতে হয়েছে দেশবাসীকে। নিজেরা দোষ করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্যে সব দেশে সব কালেই শাসকের হাতে থাকে ‘নন্দ ঘোষ’। এবারের ‘নন্দ ঘোষ’ হল চীন।
সচেতন, বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ তো প্রমাণ চায়। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাদের সংখ্যা নগণ্য। পিরামিডের সাথে তুলনা করলে বলা যায় তাদের স্থান পিরামিডের ডগায়। তাই শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে কোনো সন্দেহ নেই , তবে শিক্ষা বাড়লেই সচেতন, বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে এমন গ্যারান্টি নেই। তার প্রমাণ কোবিড-১৯ পর্বেও দেখা গেল বারবার। গায়ে গোবর মেখে, গোমূত্র মেখে করোনা সারিয়ে ফেলার বিজ্ঞাপনে ভরে গেল দেশ।
শাসক বোঝে বেকারি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থায় তিতিবিরক্ত মানুষ। মানুষের মনে ক্ষোভ জমছে। তাই ‘দেশদ্রোহী’ অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে সব কণ্ঠকে আটকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা শুরু করেছে সরকার বাহাদুর। ভয় দেখিয়ে, এমএলএ-দের দল বদল করিয়ে সরকার দখল করে, মিডিয়া হাউসগুলোকে হাতের মুঠোয় ভরে ফেলে, লাভজনক সরকারের সংস্থাকে পেয়ারের শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেবার বন্দোবস্ত করে, ভোট ম্যানেজার শিল্পপতিদের ব্যাঙ্ক লোন মকুব করে, সরকারি ব্যাঙ্ককে নানা কৌশলে অলাভজনক দেখিয়ে বেচার ব্যবস্থা করে, লাভজনক জীবনবিমাকে শুকিয়ে দেবার চক্রান্ত করে, রেল দপ্তরকে ধাপে ধাপে বেসরকারি হাতে তুলে দেবার চেষ্টা শুরু করে, শেষ ৪৬ বছরের মধ্যে বেকারত্ব শিখরে তুলে দেশের উন্নতির জয়গানের ঢাক বাজানোর লোকের অভাব নেই। নিজের দেশের মানুষ যখন টিকার জন্যে হাহাকার করছে, তখন টিকা বিদেশে পাঠিয়ে ‘মহান বিশ্বনেতা'র ভূমিকা নেবার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ খবরের কাগজে, টিভিতে দেশের ‘উন্নতির’ গল্প ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এত প্রচার করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। চারদিকে ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বারবার দেখা গেছে শাসক যখনই বেকায়দায় পড়েছে, তখন সে চেয়েছে মানুষের চিন্তা-চেতনার জগৎটাকে ভোঁতা করে দিতে, চেষ্টা করেছে মানুষের মনে গেঁথে দিতে যে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী মানুষের ভাগ্য। শাসকের প্রশ্রয়ে মজবুত হয়েছে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার। যেন-তেন-প্রকারেণ ক্ষমতা দখলে রাখতে চায় যে শাসক, তারা সব কালেই নিজের অনুকূলে জনমত গড়তে শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করে। সিলেবাসে যুক্ত করতে চেষ্টা করে নানা অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা। সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ হিসাবে এবছরে দেশে জ্যোতিষশাস্ত্রকে পাঠক্রমে যুক্ত করার একটা প্রয়াস শুরু হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে দেশে এমন উদ্যোগ শুরু হলেও দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তনে সেই কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি দেশের শাসকদল। চলতি বছরে কয়েকটি ইউনিভার্সিটি স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে জ্যোতিষ শাস্ত্রকে যুক্ত করেছে, আরও কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাঠক্রম চালু হয়ে গেছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে এর বিরুদ্ধে সচেতন ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষকে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতেই হবে। সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, দেশে এখনো কিছু মানুষ বেঁচে আছেন যারা মাথা নত করেন শুধুমাত্র যুক্তির কাছে, ন্যায়নীতির কাছে, বিজ্ঞানের কাছে। কোনো যুগেই কোনো শাসক শত প্রলোভনেও এদের দমিয়ে রাখতে পারে নি। এবারেও পারবে না। ব্রিটিশ পতাকা সরিয়ে এই দেশের পতাকা হাতে এসেছে লাখ লাখ দেশপ্রেমিকের লাঞ্ছনা-অত্যাচারের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে। লড়াইয়ের ময়দানে বুঝিয়ে দিতে হবে দেশটা আমাদেরও, শুধু একা ‘মোদীর দেশ’ না।