E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

দেশ ও রাজ্যের শাসকদলের মদতে রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিসমূহ সক্রিয় হতে চাইছে

সুপ্রতীপ রায়


নিজেদের শাসন কায়েম রাখার জন্য পরিচিতি সত্তার ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করার কৌশল নিয়ে চলেছে বিজেপি এবং তৃণমূল। পশ্চিমবাংলাকে ভাগ করার স্লোগান নতুন কিছু নয়। বিজেপি পাহাড় ও উত্তরবঙ্গকে ভাগ করতে চাইছে। পশ্চিমবাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাজ্য বা দেশ গঠন করতে চায় এধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে বারংবার হাত মিলিয়েছে তৃণমূল।

আসলে মানচিত্রে ‘উত্তরবঙ্গ’ বলে কিছু নেই। পশ্চিমবাংলার উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলিকে (দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, আলিপুরদুয়ার, মালদহ) সাধারণভাবে উত্তরবঙ্গ বলা হয়। নানা ভাষার মানুষ, নানা ধর্মের মানুষ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে বসবাস করেন।

পৃথক জাতিসত্তার স্লোগান তুলে পশ্চিমবাংলা থেকে পৃথক হয়ে যেতে চেয়েছে উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। এগুলির পিছনে তৃণমূল ও বিজেপি’র বিভিন্ন সময় প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মদত ছিল।

বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলির আন্দোলনকে বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী আন্দোলন বলে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করেছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি। কেপিপি এক সময় স্লোগান দিয়েছিল ‘উত্তরে কামতা, দক্ষিণে মমতা’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথক কামতাপুর রাজ্যের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘বঞ্চনার প্রতিবাদে এই আন্দোলনে তিনি অন্যায় দেখছেন না’’। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮/১১/২০০০)

দার্জিলিঙের প্রশ্নে বিজেপি বরাবর চরম সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন নির্বাচনে বিজেপি পাহাড়বাসী গোর্খা জনগোষ্ঠীর মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে সাফল্য পেয়েছে। তৃণমূল ও বিজেপি’র প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি রাজ্যের ঐক্যকেই বিপন্ন করে তুলেছে।

নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সঙ্গে ছোটো রাজ্য গঠনের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বিজেপি অর্থনীতির প্রশ্নে নয়া উদারবাদের সমর্থক। প্রথম এনডিএ সরকারের আমলেই ইঙ্গিত মিলেছিল বিজেপি বেপরোয়াভাবে নয়া উদারনৈতিক সংস্কারগুলি কার্যকর করবে। আসলে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার হলো - ‘কর্পোরেট হিন্দুত্বের সরকার’। ভারতের কর্পোরেটকুল খুব সচেতনভাবেই বিজেপি-আরএসএস-এর ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু কেন?

ভারতের বুকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক জাতীয় প্রতিরোধ দুর্বল করবে ও কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের একতাকেও দুর্বল করবে। ছোটো ছোটো রাজ্য গঠন হলে ও পরিচিতিসত্তা-নির্ভর রাজনীতি সফল হলে - লগ্নিপুঁজির অভিযান হবে বাধাহীন। বিজেপি’র ছোটো ছোটো রাজ্য গঠনের প্রকল্পের সঙ্গে কর্পোরেট স্বার্থ সামঞ্জস্যপূর্ণ।

নয়া উদারবাদী বিশ্বায়ন কি কেবলমাত্র একটি আর্থিক প্রক্রিয়া? না এটি মতাদর্শগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এমন একটি প্রকল্প যা বাজারের নিরঙ্কুশ প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের ভূমিকাকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে। জাতি রাজ্যের পুরাতন ভূমিকা আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির কাছে অপ্রয়োজনীয়। তাই জাতীয় ঐক্য, জাতীয় চেতনা নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রে অপ্রাসঙ্গিক। ফলে রাজ্যভাগের নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পুঁজিবাদ সঙ্কটে। আমাদের দেশের আর্থিক সঙ্কট বাড়ছে। এই সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে পরিচিতিসত্তার উপাদানটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিচিতিসত্তার রাজনীতি আর নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের মূল ভাবনার সঙ্গে কোনো সংঘাত নেই। জনগণের সংগ্রামকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এটি রাজ্যভাগের ভাবনাকে মদত দেয়।

উত্তর আধুনিকতার ফেরিওয়ালারা বলে বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রেণি নয় - জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ক্রমাগত রাজনীতির ভিত্তি। এ কথার অর্থ হচ্ছে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি দিয়ে শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বকে, শ্রেণির ধারণাকে লঘু করে দেওয়া। বুর্জোয়া শাসক শ্রেণিগুলির কাছে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি খুবই প্রয়োজন। কারণ পরিচিতির বিভাজনের মধ্যে দিয়ে বাজার দখল ও নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়।

বিজেপি’র রাজনীতি ধর্মীয় পরিচিতি-নির্ভর রাজনীতি। ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গ বৈষম্য, আঞ্চলিকতা, আদিবাসী ও জনজাতির ভিত্তিতে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি বহুত্ববাদী ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। আরএসএস ভারতের বহুত্ববাদী বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে। ধর্ম আশ্রিত পরিচিতিসত্তার রাজনীতি ভারতকে টুকরো টুকরো করে দেবে। দুর্বল ছোটো ছোটো রাজ্য গঠনের অপচেষ্টা রুখতে না পারলে অখণ্ড ভারত আর থাকবে না।

পরিচিতিসত্তার আন্দোলন কয়েক দশক ধরেই উত্তরবঙ্গে ক্রিয়াশীল। নানা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৈচিত্র্য উত্তরবঙ্গে আছে। আবার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য যুগ যুগ ধরে রক্ষিত হয়েছে। পরিচিতিসত্তা-নির্ভর রাজনীতি উত্তরবঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা বৃদ্ধি করেছে। পশ্চিমবাংলায় গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি ও তৃণমূল উগ্র বামবিরোধিতা ও নির্বাচনী সুবিধার জন্য সরাসরি বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে মদত দিয়েছে। ফলে পৃথক রাজ্য গঠনের মানসিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং পাহাড়ে জাতিসত্তার আন্দোলন, ডুয়ার্স-তরাইয়ে আদিবাসী বিকাশ পরিষদের আন্দোলন, কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-উত্তর দিনাজপুর-আলিপুরদুয়ারের নানা স্থানের ‘বৃহৎ কোচবিহার’, ‘কামতাপুর’, ‘উত্তরাখণ্ড’ প্রভৃতি আন্দোলনকে সরাসরি মদত দিয়েছে বিজেপি-তৃণমূল আবার কংগ্রেসও। পরিচিতি সত্তার সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করেছে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি।

বিজেপি কেন ছোটো রাজ্য গঠনের পক্ষপাতী? বিজেপি’র বক্তব্য - প্রশাসনের সুবিধার জন্য ছোটো ছোটো রাজ্য গঠন জরুরি। আসলে বিজেপি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভাঙতে চায়। তাই শক্তিশালী রাজ্য গঠনের তুলনায় দুর্বল রাজ্য গঠনই ওদের লক্ষ্য। বিজেপি যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণার অবলুপ্তি ঘটাতে চায়। বিজেপি’র আসল লক্ষ্য, আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে ফেলে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে ক্ষতিকর। আরএসএস-র এককেন্দ্রিক হিন্দুত্বের দর্শনের উপর দাঁড়িয়েই বিজেপি সরকার পরিচালিত হচ্ছে।

ছোটো ছোটো রাজ্য গড়ে তোলার পিছনে বিজেপি যুক্তি হাজির করছে - বড়ো আয়তনের রাজ্য নাকি সমস্যার অন্যতম উৎস। আয়তন কখনই মূল সমস্যা নয়। ভাষা ও জাতির ভিত্তিতে যে রাজ্যগুলি ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে, সেগুলি নতুন রাজ্য গঠনের নামে পুনরায় ভাঙলে দেশ দুর্বল হবে। প্রচার করা হচ্ছে ছোটো রাজ্য গঠন করে হরিয়ানার নাকি অনেক উপকার হয়েছে। কিন্তু হরিয়ানার ভৌগোলিক অবস্থান, সবুজ বিপ্লব, দিল্লির নিকটে অবস্থান প্রভৃতির কারণে হরিয়ানার উপকার হয়েছে।

আলাদা ঝাড়খণ্ড রাজ্য বা ছত্তিশগড় রাজ্য করে কি কিছু লাভ হয়েছে! পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। বিহার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাজ্য গঠন করলে নাকি উন্নয়ন হবে। একই স্লোগান ছিল মধ্যপ্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন ছত্তিশগড় রাজ্য গঠনের ক্ষেত্রে। কিন্তু আদিবাসী বা পিছিয়ে পড়া জনজাতিগুলির কী কোনো উন্নতি হয়েছে? উলটে আদিবাসীদের জমি জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তা তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোটো ছোটো রাজ্যগুলির কী উন্নয়ন হয়েছে? দেশের ক্ষুদ্রতম রাজ্য মণিপুর অনুন্নত রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম। ছোটো রাজ্য গড়ে তুলতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়।

শক্তিশালী রাজ্য যদি প্রকৃতই বিজেপি’র লক্ষ্য হয় তাহলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের ‍‌ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে যদি বেশি অর্থ ও ক্ষমতা না দেওয়া হয় তাহলে রাজ্যগুলির বিকাশ কখনই সম্ভব নয়। প্রদেশগুলির পূর্ণ বিকাশ ছাড়া দেশের সমৃদ্ধির ও পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাজ্যগুলির অধিকার খর্ব হয়েছে ও কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা বাড়ছে। ফলে ছোটো রাজ্য গঠনের মধ্য দিয়ে বিজেপি’র শক্তিশালী রাজ্য গঠনের স্লোগান ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

সিপিআই(এম) বরাবর শক্তিশালী রাজ্য গঠনের প্রশ্নে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছে। সিপিআই(এম)’র কর্মসূচির ৬.৩ ধারার ২নং উপধারাতে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতীয় ইউনিয়নের সকল রাজ্যগুলির প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন ও সমান ক্ষমতা থাকবে। উপজাতি এলাকা বা সেইসব এলাকা যেখানে জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং যা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দ্বারা পৃথক রূপে চিহ্নিত তাদের সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মধ্যেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং তাদের বিকাশের জন্য পূর্ণ সাহায্য পাবে’’। সিপিআই(এম) খুব সঠিকভাবে মনে করে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ভারতের জাতিসত্তা বা জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়ক হবে।

খুব সঠিকভাবেই ১৯৫৫ সালে ৯ ডিসেম্বর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দার্জিলিঙের পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং নেপালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্রকৃত অবস্থা হলো যদি রিজিওনাল অটোনমি তাদের দেওয়া হয় এবং ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়, যদি সংবিধান সংশোধন করে সেই ক্ষমতার সম্প্রসারণ করা হয় ও প্রয়োগ করা হয়, তাহলে দার্জিলিঙের নেপালিভাষী মানুষের মধ্যে বিভেদকামী মনোভাব দূর হবে বলেই আমি মনে করি। তারা অভূতপূর্বভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এবং ভারতের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হবে। সে কারণেই আমরা রিজিওনাল অটোনমি দাবি করছি।’’

নতুন রাজ্য গঠনের প্রশ্নে সিপিআই(এম)’র অবস্থান পরিষ্কার। সিপিআই(এম)’র দৃষ্টিভঙ্গিও বৈজ্ঞানিক। এ প্রসঙ্গে ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসে (৫-১১ অক্টোবর, ১৯৯৮, কলকাতা) গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘‘২.৫৭ এই সময়কালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, বিদর্ভ, বোড়োল্যান্ড এবং তেলেঙ্গানা প্রভৃতির মতো পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি উঠেছে। অর্থ‍‌নৈতিক ভারসাম্যের অভাব এবং তার ফলশ্রুতিতে কতকগুলি অঞ্চলের পশ্চাৎপদতা, আদিবাসী এলাকায় চিরন্তর অনগ্রসরতা এবং আঞ্চলিক মনোভাবকে উসকে দেওয়ার ফলে এই ধরনের আঞ্চলিক আন্দোলন শুরু হয়েছে।

২.৫৮ এই আঞ্চলিক আবেগকে কাজে লাগিয়ে এই ধরনের স্লোগান তুলে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কয়েকটি বুর্জোয়াদল পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় নেমেছে। উপরস্তু, কয়েকটি দল, বিশেষ করে বিজেপি, যারা বরাবরই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করেছে, তারা বর্তমানে রাজ্যগুলিকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে চাইছে। সিপিআই(এম) বর্তমান রাজ্যগুলিকে আরও খণ্ডিত করার বিরুদ্ধে, কেননা এর ফলে বিভেদপন্থী ও সংহতি বিনাশকারী দাবিসমূহে ইন্ধন যোগানো হবে। আসল কথা হলো এসব অঞ্চলের অনগ্রসরতা দূর করা। যে সব অঞ্চলের আদিবাসীরা বেশি সংখ্যায় একত্রে বাস করেন সেসব এলাকায় আঞ্চলিক স্বশাসন জরুরি হলেও অন্যসব পিছিয়ে পড়া এলাকার পরিস্থিতি কিন্তু স্বতন্ত্র। তেলেঙ্গানা ও বিদর্ভের মতো অঞ্চলের অনগ্রসরতা দূর করার জন্য পার্টি গুরুত্ব সহকারে প্রচার চালালেও এরই পাশাপাশি পৃথক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করতে হবে।’’

সিপিআই(এম)’র সপ্তদশ কংগ্রেসে (১৯-২৪ মার্চ, ২০০২, হায়দরাবাদ) গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ছোটো রাজ্য গঠনকে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত’ বলা হয়েছিল। গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘‘২.৫৩ ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও উত্তরাঞ্চলে তিনটি পৃথক রাজ্যের গঠন বর্তমানের ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলি ভেঙে আরও নতুন রাজ্য গঠনের দাবিতে উৎসাহ যুগিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে নজর কেড়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে পৃথক তেলেঙ্গানা এবং মহারাষ্ট্র ভেঙে বিদর্ভ গঠনের দাবি। বিজেপি ছোটো রাজ্য তৈরি করতে চায় যাতে কেন্দ্র তাদের ওপর আধিপত্য করতে হবে। সীমায়িত সম্পদের ছোটো রাজ্য মানেই হলো দুর্বল রাজ্য যা কেন্দ্রের খবরদারি আটকাতে অক্ষম। সুনির্দিষ্ট ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পরিচয় সত্তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজ্য তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাদের বদলে ছোটোো রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হয়েছে রাজ্য কাঠামোকে গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে শক্তিশালী গণআন্দোলনের পর। এই রাজ্যগুলিকে ভেঙে ফেলার প্রবল বিরোধী সিপিআই(এম)। একইসঙ্গে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলির উন্নয়নের পক্ষে সিপিআই(এম)।’’

দেশকে রক্ষার জন্যই পশ্চিমবাংলাকে পুনরায় ভাগের চক্রান্ত রুখতেই হবে।