৫৮ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ১৬ জুলাই, ২০২১ / ৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
অর্থ প্রসঙ্গে - কার্ল মার্কস
আবুবকর সেখ
পুঁজিবাদী সমাজে অর্থ যে জাগতিক শক্তি হিসেবে কাজ করে কার্ল মার্কস তাঁর কালজয়ী গ্ৰন্থ 'পুঁজি'তে তা বিস্তারিতভাবে নিখুঁত বর্ণনা করেছেন। সেই আলোচনার দুই একটি বিষয় এখানে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো। মার্কস বিভিন্ন উদাহরণ সহযোগে এই আলোচনা করেছেন।
আলোচনা করতে গিয়ে মার্কস একস্থানে বলেন, ...‘‘এই ক্রিয়া যখন ব্যাপকভাবে চলে তখন মনে হয় যেন তার মধ্যে একটি স্ববিরোধ আছে। কিন্তু মূল্যবান ধাতুগুলির উৎপাদনের উৎসস্থল তার সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের সরাসরি বিনিময় হয়। এখানে আমরা পাচ্ছি (সোনা অথবা রুপোর মালিক কর্তৃক) ক্রয় ব্যতীত (অন্যান্য পণ্যের মালিক কর্তৃক) বিক্রয়। এবং অন্যান্য উৎপাদনকারী কর্তৃক ক্রয় ব্যতীত পরবর্তী বিক্রয়গুলি নবোৎপন্ন মূল্যবান ধাতুগুলিকে সমস্ত পণ্য মালিকদের মধ্যে শুধু বণ্টন করে দেয়। এইভাবে বিনিময়ের সর্বক্ষেত্রে সোনা এবং রুপো বিভিন্ন পরিমাণে মজুত হয়ে পড়ে। একটি বিশেষ পণ্যের আকারে বিনিময়-মূল্য জমিয়ে মজুত করে ফেলবার সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় সোনার জন্য লোভ। সঞ্চলনের বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে শক্তি বৃদ্ধি হয় অর্থের সদাসর্বদা ব্যবহারের উপযুক্ত সম্পদের একেবারে সামাজিক সেই রূপটির।’’ (পুঁজি ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭০-১৭২)
এবিষয়ে মার্কস কলম্বাসের একটি চিঠির (যে চিঠিটি ১৫০৩ সালে জামাইকা থেকে লেখা হয়েছিল) বক্তব্য উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন - ‘‘সোনা একটি বিস্ময়কর পদার্থ ! যে কেউ তার অধিকারী হয়, সেই যা কিছু চায় তা পেতে পারে। সোনার সাহায্যে লোকে আত্মাকে স্বর্গে পাঠাতে পারে’’। (ওই, পৃষ্ঠা-১৭১)
কার্ল মার্কস আরও উল্লেখ করেন, ‘‘পণ্যের সঙ্গে পণ্যের সর্বপ্রকার গুণগত পার্থক্য যেমন অর্থের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সমতা বিধানকারী অর্থ তেমনি নিজেও সর্বপ্রকার ভেদাভেদ দূর করে দেয়।... কিন্তু অর্থ নিজেই একটি পণ্য, এমন একটি বহিঃস্থ পদার্থ যা যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিবর্তন হওয়ার যোগ্য। তাই সামাজিক শক্তি হয়ে পড়ে ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিগত শক্তি। কাজেই প্রাচীন লোকেরা অর্থের নিন্দা করতেন অর্থনৈতিক এবং নৈতিক ব্যবস্থার নাশক শক্তি বলে।’’ (ওই, পৃষ্ঠা-১৭১-১৭২)
শ্রেষ্ঠ ইংরেজি সাহিত্যিক ও নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬) তাঁর ‘টাইমন অব এথেন্স’ (Timon of Athens) নাটকে অর্থের এই সর্বময়তাকে অতি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা কার্ল মার্কস উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন -
‘‘সোনা! পীত, উজ্জ্বল, মহার্ঘ সোনা
ওর একটুকুতেই কালোকে করে সাদা; মন্দকে ভালো;
ভুলকে ঠিক; নীচকে মহৎ; বৃদ্ধকে যুবক, ভীরুকে বীর।
এ কী, হে দেবগণ? কেন এই সোনা টেনে নিয়ে যায়
তোমার পুরুত আর নফরদের, তোমার কাছ থেকে,
বলিষ্ঠের বালিশ কেড়ে নেয় তার মাথার তলা থেকে;
এই পীতবর্ণ দাস
ধর্ম গড়ে, ধর্ম ভাঙে; পাপীকে ধন্য করে আশীর্বাদ দিয়ে;
লালচর্ম কুষ্ঠ রোগীকে বসায় দেবাসনে;
চোরকে বসায় রাজসভাসদ সনে সমান আসনে,
দেয় তাকে মান, স্তুতি আর অভিবাদন;
এই তো সেই, যার বলে, বিধবা হয় নব পরিণীতাঃ
...এস ধিক মৃত্তিকা,
মনুষ্য জাতির বারাঙ্গনা"। (ওই, পৃষ্ঠা-১৭১-১৭২)
মার্কস ফুট নোটে আরও তুলে ধরেন, ‘‘অর্থের চেয়ে খারাপ কিছু নেই মরণশীলদের এ পৃথিবীতে। তা শহর ধ্বংস করে, ঘর থেকে বের করে দেয় নাগরিকদের, মহৎ হৃদয়গুলিকে নির্লজ্জ কাজ করতে শেখায়, ঈশ্বর বিরুদ্ধে পথের দিকে ঠেলে দিয়ে মানুষকে হিংসাত্মক কাজের নির্দেশ দেয়’’। (সফোক্লিস, ‘আন্তিগোনে’)।
বিশ্বের যে কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে এই অর্থ সবসময়ই মহাক্ষমতাধিকারী বস্তু। সেকারণে বর্তমান দুনিয়ায় যিনি যত অর্থ সম্পদ ও শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের মালিক তিনি ততবেশি জাগতিক শক্তির অধিকারী।
এই মুহূর্তে আমাদের দেশের দিকে তাকালে তা আরও ভালো করে উপলব্ধি করা যায়। দেশ এখন ক্ষুধার দিক থেকে গতবারের থেকে দুই ধাপ নীচে নেমে গিয়ে ১১৭ তম স্থানে অবস্থান করছে। এই দিক থেকে অনেক ছোটো ছোটো দেশ আমাদের আগে অবস্থান করছে - যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটান। করোনা আবহে দেশের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। কর্মহীন ও কর্মরতদের কাজ হারানোর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এটা একটা দিক। কিন্তু এর উলটো দিকও আছে। এই সময়ে পুঁজিপতিদের আয় দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থের লোলুপতায় এরা বিভোর। জৈব জ্বালানি পেট্রোল, ডিজেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের অর্থ লুট করছে। অন্যদিকে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরির পরিমাণ হ্রাস করে মুনাফার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে কয়েক গুন। এই অমানবিক অর্থের লালসাই তৈরি করে মুকেশ আম্বানি ও গৌতম আদানিদের মতো মানুষদের। এই অর্থই তাদের বসিয়েছে জগৎজোড়া শীর্ষ বিত্তশালী আসনে। এই অর্থবলে তৈরি হয় মুকেশ আম্বানির সাতাশতলা বিলাসবহুল অট্টালিকা, কন্যার পরিণয়ে ব্যয় হয় সাতশ কোটি টাকা।
আর এই অর্থের লালসায় চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, রাষ্ট্রীয় মদতে দুর্নীতি, তোলাবাজি, কাটমানি, রাফায়েল কেলেঙ্কারি ইত্যাদি।
ফরাসি দার্শনিক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) তাঁর ‘Discourse on Inequality (১৭৫৪)’ নামে বিখ্যাত গ্ৰন্থে উল্লেখ করেন, ‘‘Private property is the original source and basis of all inequality’’.
আর এক ফরাসি দার্শনিক জোসেফ প্রুধোঁ (১৮০৯-১৮৮৫) তাঁর বিখ্যাত ‘What is Property’ (১৮৪০) গ্ৰন্থে বলেন , ‘Property is theft’ অর্থাৎ সম্পদ চৌর্যবৃত্তির ফল।
কিন্তু উভয় দার্শনিক তাঁদের সীমাবদ্ধতার কারণে সম্পদের অবসানের কথা বলেননি। কার্ল মার্কস সর্বপ্রথম সম্পদের ব্যক্তি মালিকানার সম্পর্কের অবসান চাইলেন। এই সূত্রে রাষ্ট্র হিসেবে পুঁজিবাদী সমাজ আর টিকে থাকে না। বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও পরে সাম্যবাদী সমাজে পৌঁছে যেতে হবে। আর তা হলেই অর্থের সর্বময় ক্ষমতাকে বিলীন করা সম্ভব হবে।