E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৬ জুন, ২০২৩ / ৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

গ্রামবাংলাকে বাঁচাতে তৃণমূল-বিজেপি-কে পরাস্ত করুন

বিমান বসু


একথা আমাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, গ্রাম বাংলার ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা জনস্বার্থবাহী যা বিগত বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠার সময় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মহাকরণের অলিন্দ থেকে মহাকরণের সামনে সমাবেশে উপস্থিত জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, বামফ্রন্ট সরকার শুধু মহাকরণ থেকে কাজ করবে না। জনগণকে যুক্ত করে জনস্বার্থে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা সহ সমস্ত স্বশাসিত সংস্থা নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে উঠবে। এর এক বছর পর ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা ও তারপর পুর এলাকার জন্য পুরসভা গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য পঞ্চায়েতের ভোটেতেই প্রথম সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১৮ বছরে ভোটাধিকার চালু হয়, যা হয়েছিল জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে।

২০১১ সালে তৃণমূল সরকার গড়ে ওঠার পর ধীরে ধীরে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কর্মসূচি শুরু হয়। শুরু হয় একদলীয় পঞ্চায়েত গড়ে তোলার অভিযান। আজকের প্রজন্মের একথা জানা প্রয়োজন যে, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন আদালতের নির্দেশে পাঁচ দফায় অনুষ্ঠিত হলেও সন্ত্রাস ও অরাজকতা কম ছিল না। বেছে বেছে বামপন্থীদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের জন্য হামলা হয়েছে। সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ‘শতকরা ১০০ ভাগ’ আসনে জয়লাভের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার বিরোধী কর্মসূচির সত্যতা যাচাই করতে যে কোনো গবেষক ওই বছরের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আনুপূর্বিক পর্যালোচনা করলেই তা খুঁজে পাবেন।

২০১৮ সালের পর থেকে রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি’র বোঝাপড়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং জনগণের মধ্যে জাতি ধর্ম ভাষা ও বর্ণকে ঘিরে যে বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছিল তার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তোলার অভিযান শুরু হয়। আলোচনা হতে থাকে, রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিচারে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি-কে জনবিচ্ছিন্ন করতে সমস্ত বামপন্থী যাঁরাই তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান তাদের কাজের ঐক্য (Unity in action) গড়ে তুলতে হবে। এ অভিযান সব ক্ষেত্রে সমানভাবে না হলেও বামপন্থীরা তাদের নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে প্রচার আন্দোলন শুরু করে। কখনও কখনও তৃণমূল-বিরোধী সমস্ত শক্তির ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

উপরোক্ত অবস্থার বিচারে ধীরে ধীরে তৃণমূল সরকারের নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটতরাজের কার্যকলাপ জনগণের সামনে প্রকাশিত হতে শুরু করে। দেখা যায় এ কাজে পুলিশ প্রশাসনের একাংশ সহ কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ মদতে ওই সব অনৈতিক কার্যকলাপ চলতে থাকে, পরবর্তী সময়ে চাকরি চুরির ঘটনা প্রকাশিত হলে দেখা যায়, যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বাদ দিয়ে টাকাপয়সার বিনিময়ে অযোগ্যদের এমনকী যারা পরীক্ষা দেয়নি বা খালি খাতা জমা দিয়েছে তাদেরও কপালে চাকরি জুটেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রথমে কিছু জেলায় মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে শামিল হতে থাকে। পরে প্রায় সব জেলায় চাকরি চুরি সহ লুঠতরাজের বিরুদ্ধে মানুষ সংঘবদ্ধভাবে মুখর হতে শুরু করে। বিশেষকরে সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক চুরি ও লুটতরাজের ঘটনা প্রকাশিত হলে মন্ত্রীসভার সদস্য উপাচার্য-প্রাথমিক শিক্ষা পরিষদের সভাপতি-আধিকারিক সহ বিধায়কদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় রাজ্যের প্রায় সর্বত্র স্লোগান উঠতে থাকে ‘চোর তাড়াও বাংলা বাঁচাও’।

বামফ্রন্ট সরকার কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে এককথায় রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে যে ভূমিসংস্কার আইন সংশোধন করে চালু করেছিল যা ত্রিস্তরীয় জনস্বার্থবাহী পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা চালু না থাকলে কার্যকরভাবে রূপায়ণ করা যেত না। ভাগচাষিদের স্বার্থে পাট্টা দেওয়ার লক্ষ্যে ‘অপারেশন বর্গা’ কার্যকরী করা যেত না। নতুন ধাঁচে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে সরকারি খাসজমি ও জমিদারের লুকানো জমি টেনে হিঁচড়ে বার করে ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হতো না। এই কাজের ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ কৃষক পরিবার অর্থনৈতিক দিক থেকে উপকৃত হয়েছে। এই নীতি কার্যকরী করায় সমাজের নিচের তলার মানুষ বিশেষকরে তপশিলি জাতি, আদিবাসী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়েছেন। এই কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেই সময়ে রাজ্যে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে সারা দেশে এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছিল, যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানার বিষয়।

কৃষির ব্যাপক সাফল্যের ভিতে দাঁড়িয়েই শিল্প গড়ে তোলার যে কর্মসূচি তখন নেওয়া হয়েছিল তাতে গ্রামীণ কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছিল, যা এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের প্রথম স্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। বড়ো শিল্প গড়ে তুলে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সবক্ষেত্রে করা সম্ভব হয়নি।

সামগ্রিক বিচারে আমাদের রাজ্যের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা। জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রামবাংলার স্থানীয় সরকার। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কিত সমস্ত বিষয় হাতে কলমে প্রয়োগ করার অধিকার ও দায়িত্ব গ্রামীণ জনগণের।

রাজ্য রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে তৃণমূল কংগ্রেস এবং আরএসএস পরিচালিত বিজেপি দলকে জনবিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে জনগণের ঐক্য গড়ে তোলা এই মুহূর্তের অত্যন্ত জরুরি কাজ। তৃণমূল কংগ্রেসের নৈরাজ্য সৃষ্টির রাজনীতি, অনৈতিক কার্যকলাপ, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের অভিযান এবং বিজেপি’র জনগণকে ধর্ম, বর্ণ, জাত ও ভাষার ভিত্তিতে বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে এই উভয় দলের বিরুদ্ধে যারাই লড়াই করতে প্রস্তুত তাদের সঙ্গে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রয়োজন। বিগত দিনের অষ্টম (২০১৩) ও নবম (২০১৮) পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় যেভাবে হামলা-আক্রমণ করে বামপন্থী ও অন্যান্যদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে তা প্রতিরোধ করতেই হবে। ইতিমধ্যে একজন মুর্শিদাবাদে ও দুইজন উত্তর দিনাজপুরে তৃণমূলের হামলাকারীদের আক্রমণে খুন হয়েছেন। প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্বে হামলা হয়েছে প্রতিরোধও হয়েছে, তাকে স্মরণে রেখেই জনগণের শত্রুদের হাত থেকে বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিশিবিরের প্রার্থীদের রক্ষা করার প্রয়োজনীয় সমস্ত বিধি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করার সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিতেই হবে।

তবে, একথা সত্য যে অবাধ সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মুখ্য দায়িত্ব রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের। কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কানে তুলো‍‌ দিয়ে এবং চোখে ঠুলি পরে বসে রয়েছেন। আমাদের বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রয়োজনে হয়তো প্রতিদিন তাঁকে স্মারকলিপি জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাকে জাগানো যায়।

এবারকার দশম পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের শরিক দলসমূহের বোঝাপড়া অন্যান্যবারের তুলনায় উন্নত। তাই, এই উন্নত বোঝাপড়াকে রক্ষা করতে এবং তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি প্রার্থীদের পরাস্ত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার প্রয়োজনীয় সমস্ত রকমের উদ্যোগ সবদলকেই নিতে হবে।

আসুন, আমরা সকলে মিলে গ্রামবাংলাকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে জনগণের ঐক্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাই।