E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৬ জুন, ২০২৩ / ৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

পঞ্চায়েত

পথে নেমেই পথের সন্ধান করতে হবে

সূর্য মিশ্র


১৯৭৭ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবার পরের বছরই পশ্চিমবঙ্গে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তি‍তে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কমরেড জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পরই ঘোষণা করেছিলেন, শুধু রাইটার্স বিল্ডিং থেকে নয়, জনগণের পঞ্চায়েত ও পুরসভা গঠন করে তাদের হাতে ক্ষমতার ‍‌বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। তখন বাস্তুঘুঘুর বাসা ভেঙে কেবল দার্জিলিং বাদে রাজ্যের সব জেলা পরিষদে বামপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। দার্জিলিং জেলায় গোর্খালিগ ও বামপন্থীদের জোট জয়যুক্ত হয়।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল জয় সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার শুরু থেকেই পঞ্চায়েত পরিচালনার দৈনন্দিন কাজে নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলি ও তাদের অনুগামীদের প্রতি আচরণ কী হবে - তা কেবল সদিচ্ছার ওপর নির্ভর না করে কতগুলি আইনগত রক্ষাকবচ তৈরি করেছিল। জেলা পরিষদ থেকে শুরু করে গ্রামসভা স্তর পর্যন্ত হিসাবনিকাশ, বিভিন্ন প্রকল্পের উপভোক্তা কমিটি ও সহায়তা প্রাপকদের তালিকা ইত্যাদি জনসমক্ষে প্রকাশ সুনিশ্চিত করেছিল। নিয়মিত নির্বাচন, উপনির্বাচন, রাজনৈতিক দলের প্রতীক নির্বাচন, রাজ্য নির্বাচন, কমিশনের নিরপেক্ষতা সুনিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য গ্রামসভার নিচে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এলাকায় প্রতিটি গ্রামস্তর পর্যন্ত গ্রাম পরিকল্পনা সমিতি রেজিস্ট্রিভুক্ত করে তাদের হাতে নিঃশর্ত অর্থ বরাদ্দ (Untied fund) করা হয়েছিল। প্রতি বছরের অডিট রিপোর্ট এবং কোনো পঞ্চায়েতের রিপোর্টে কোনো ত্রুটি থাকলে সেগুলি বিধানসভায় পেশ করা হতো। দলমত বিচার না করে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। সমস্ত স্তরের বিরোধী দলনেতাকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটির আদলে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সকল স্থায়ী সমিতিগুলিতে বিরোধী দলের সদস্যদের জন্য একটি আসন সংরক্ষিত করা হয়েছিল। বিরোধী দল পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলির প্রতি কোনো বৈষম্যের অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা ছিল। নির্বাচনের সময় স্থানীয় স্তরে মনোনয়নপত্র দাখিল করায় বাধা দিলে উচ্চতর স্তরে মনোনয়নপত্র জমা দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সর্বোপরি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভের প্রচেষ্টাকে রাজনৈতিক স্তরে বাধা দেওয়া হতো। যদিও এক্ষেত্রে সর্বত্র সাফল্য অর্জন করা যায়নি। কিন্তু এইসব উদ্যোগের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার ও শাসকদলের সদিচ্ছা তো দূরের কথা, বিপরীত ভূমিকা নিতেই দেখা যায়।

চন্দ্রকোনা ২নং ব্লক দপ্তর অভিমুখে মনোনয়নপত্র জমা দিতে সিপিআই(এম) এবং আইএসএফ' র মিছিল। ছবিঃ চিন্ময় কর

গ্রামের মূল সম্পদ কৃষি জমির কেন্দ্রীকরণ না ভেঙে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অসম্ভব হতো। রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত সদস্যদের শ্রেণি বিন্যাস নিয়ে যতগুলি সমীক্ষা হয়েছিল তাতে গ্রামের গরিব ও নিম্নবিত্ত অংশের প্রাধান্য প্রমাণিত হয়েছে। তখনকার স্লোগান ছিল - দুই পায়েই এই পথে এগোতে হবে - ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েতকে হাতিয়ার করে গ্রামোন্নয়ন। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশের বাস এই রাজ্যে; অথচ জমির ভাগ মাত্র তিন শতাংশ। সারা দেশে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে পুনর্বণ্টিত জমির মধ্যে ২২ শতাংশই হলো পশ্চিমবঙ্গের অবদান। ২০১০ সালের হিসাব মতো ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের মধ্যে পুনর্বণ্টিত খাস জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১১.২৭ লক্ষ একর। দু’টো মিলিয়ে প্রাপকের সংখ্যা ৩০ লক্ষ পরিবারের কিছু বেশি। জোতদার-জমিদারদের হাতে শিলিং আইন লঙ্ঘন করে বেনাম জমি উদ্ধার করে পুনর্বণ্টনের জন্য যে রাজ‍‌নৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল, বামফ্রন্ট সরকার তা পূরণ করেছে। তেভাগা আন্দোলনের সময় থেকে বর্গাজমি বর্গাদারদের নামে নথিভুক্ত করার দাবি বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম পূরণ করেছিল। ১৫ লক্ষাধিক বর্গাদার ১১.২৫ লক্ষ একর জমিতে বর্গা রেকর্ড পেয়েছিলেন। খাস জমির পাট্টা প্রাপক ও রেকর্ডভুক্ত ও বর্গাদারদের হাতে ন্যস্ত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ২২.৫২ লক্ষ একরে। জমির প্রাপক ৩০ লক্ষ পরিবারের সদস্য সংখ্যা গড়ে ৫ জন ধরলে মোট দেড় কোটি মানুষ এতে উপকৃত হয়েছিলেন। এদের পরিবারে গড়ে ৭৫ ডেসিমেল জমিতে চাষের অধিকার পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ তফশিলি, ১৮ শতাংশ আদিবাসী ও ১৮ শতাংশ সংখ্যালঘু - মোট ৭৩ শতাংশ মানুষ। গ্রামের ও সব চাইতে গরিব এবং সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ অংশের পক্ষে রাজনৈতিক ভারসাম্যের এই পরিবর্তন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত সদস্যদের শ্রেণি ও সামাজিক বিন্যাসের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে হাতিয়ার জুগিয়েছিল। এর পরে পরেই স্বামী-স্ত্রীর নামে যৌথ পাট্টা এবং মহিলা পাট্টা বিতরণের কাজ শুরু হয়। একথা মনে রাখা দরকার যে, সংবিধানের ৭৩তম সংশোধন লাগু হবার পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গই হলো একমাত্র রাজ্য যেখানে এই সংরক্ষণগুলির পাশাপাশি ওবিসি (হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের)-দের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারই ওবিসি সম্প্রদায়গুলিকে নির্দিষ্টভাবে তালিকাভুক্ত করে এগুলিকে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি মহিলাদের জন্য ‘ন্যূনতম’ ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের আইন প্রণয়ন করে। পরে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এই ওবিসি তালিকার কিছু অবাঞ্ছিত অদল বদলের পাশাপাশি মহিলাদের জন্য সংরক্ষণকে ‘অনুচ্চ’ ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনে।

ভূমি সংস্কার ও পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি দু’দফায় কৃষকদের খাজনা মকুব, ব্যাংক, সমবায় ও অন্যান্য কৃষি ঋণের ব্যবস্থা, সেচ ও বিদ্যুৎ, সার ও উন্নত বীজের মিনিকিট, বৃক্ষ রোপণের চারা, ভূমিক্ষয় রোধকারী জল ও বিভা‍‌জিকা প্রকল্প, গ্রামীণ কর্মসংস্থান ইত্যাদি বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে কৃ‍‌ষিক্ষেত্রে আয় ও উৎপাদন অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ধান ও আলু চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পেলে সরকার সহায়ক মূল্যে কেনার ব্যবস্থা করত। ২০০৯-১০ সালে মোট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গে যখন ছিল ৪.২ শতাংশ, তখন দেশে এই হার ছিল ২ শতাংশের নিচে। কৃষি নিবিড়তা (১৮০%) অর্থাৎ ৮০ শতাংশ জমিতে দো ফসলি চাষ হতো। এক্ষেত্রে দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের হার ছিল দ্বিতীয় স্থানে। এই সময়ে চাল উৎপাদন ৭৪ থেকে ১৭০ লক্ষ টনে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছিল প্রথম স্থানে। তেমনি পাট, সবজি, আনারস ও মৎস্য উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ ছিল প্রথম স্থানে। আলু ও লিচু উৎপাদনে ছিল দ্বিতীয় স্থানে। দেশের‍‌ মোট চা উৎপাদনের ২৫ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে হলেও মোট চা রপ্তানির ৪৫ শতাংশ হতো এ রাজ্য থেকেই। কৃষক ও চা শ্রমিকরা এই উৎপাদনের সাফল্যে লাভবান হয়েছিল। গ্রামীণ দারিদ্র্য ৭১ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। গ্রামীণ পরিকাঠামো পানীয় জল, রাস্তাঘাট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, বাসস্থান, গৃহনির্মাণ সমস্ত ধরনের গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পে এমনকী বন্যা, খরা ইত্যাদি বিপর্যয় মোকাবিলায় পঞ্চায়েত ও স্থানীয় জনগণের উদ্যোগ একটা বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল।‍‌ জেলায় জেলায় গণউদ্যোগে সাক্ষরতা ও গণস্বাস্থ্য, বৃক্ষরোপণ, বনসংরক্ষণ অভিযান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। যেমন সাক্ষরতার জন্য ‘নোমা’ (NOMA) পুরস্কার এবং বনসৃজনে ‘পল গেটি’ পুরস্কার পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। এছাড়াও কোনো সরকারি সাহায্য ছাড়াই স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন একটা আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট স্বনির্ভর গোষ্ঠী ছিল ১২ লক্ষ। এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। মোট সদস্য ১.২ কোটি। এদের নিজস্ব সঞ্চিত অর্থ ছিল ২ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণ পেয়েছিল সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এদের প্রদেয় ১১ শতাংশ সুদের মধ্যে দিতে হতো ৪ শতাংশ, বাকি অংশের সুদ সরকার মেটাত। এদের অবস্থা এখন দুর্বিষহ। কেবল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ দিয়ে বর্তমান মাইক্রো ফিনান্সের দাপট মোকাবিলা করা যাবে না।

কৃষি ও পরিষেবা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এই অগ্রগতি সত্ত্বেও ৯০-এর দশকের প্রথমার্ধেই নয়া উদারবাদী অর্থনীতি দেশ ও দুনিয়ার মতো এ রাজ্যেও থাবা বসি‍‌য়েছিল। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে সচেতন ছিল, বৈষম্য বৃদ্ধি না করেও উৎপাদন বৃদ্ধির হার (তখন ৬ শতাংশের বেশি) ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয় নয়া শিল্পনীতি। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির সাফল্য যে রাজ্যের শিল্পায়ন ও পরিষেবা ক্ষেত্রের বিকাশ ছাড়া ধরে রাখা যাবে না, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। কেবল কৃষিক্ষেত্রের বিকাশ গ্রামাঞ্চ‍‌লে ও শহরে ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থানের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে না। এটা সত্য যে, গ্রামীণ হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (MSME) ও তাতে কর্মসংস্থানে বামফ্রন্ট সরকারের শেষদিন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল। গুজরাট দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও অনেকটা পিছিয়ে ছিল। তখন এ রাজ্যে মোট ইউনিটের সংখ্যা ছিল ২৮ লক্ষ ও কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫৫ লক্ষ। কিন্তু বৃহৎ শিল্পের বিকাশ ছাড়া রাজ্যের মোট আয় ও কৃষি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান যে বৃদ্ধি করা অসম্ভব - এ কথা তর্কাতীত। উদারনীতি চালু হবার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের লাইসেন্সিং ও মাসুল সমীকরণের বৈষম্যমূলক নীতি আমাদের রাজ্য সহ দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির শিল্প বিকাশের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নয়া উদারনীতির সময়কালে এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাগুলি কিছুটা দূরীভূত হলেও প্রয়োজনীয় পরিকাঠা‍মো নির্মাণে বৈষম্যগুলি পূর্ববৎ বহাল ছিল। কমরেড জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার শুরু থেকেই পঞ্চায়েত ও পুরসভার হাতে ক্ষমতার বি‍‌কেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার জন্য কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের অবিরাম লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজ্যের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি সারা দেশে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের এই সংঘাতকে ছোটো করে দেখা যায় না। কোলাঘাট, সাঁওতালডিহি, বক্রেশ্বর ইত্যাদি মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও হলদিয়া বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির প্রশ্নে কে‍ন্দ্রের উপেক্ষা একটা বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে হলদিয়ায় যৌথ মা‍‌লিকানায় পেট্রোকেমিক্যাল প্রকল্প, তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আইবিএম, উইপ্রো, টিসিপি, ইনফোসিস সংস্থার বি‍‌নিয়োগ, দেশের দ্বিতীয় অর্থতালুক (ফিনান্সিয়াল হাব), উত্তরবঙ্গে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে বিশেষত কমরেড জ্যোতি বসু ও পরবর্তীকালে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং কমরেড নিরুপম সেনের উদ্যোগে বামফ্রন্ট সরকারের শেষ তিন বছরে যথাক্রমে ৪, ৮ ও ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছিল। কিন্তু বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলায় ইস্পাত, বিদ্যুৎ ও সিমেন্ট উৎপাদন, শালবনিতে প্রস্তাবিত দেশের বৃহত্তম ইস্পাত শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৃহৎ বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলেও সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ি তৈরির কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পটিকে বাংলা ছাড়া করে গুজরাটকে উপহার দেওয়ার ‘কৃতিত্ব’ অবশ্যই মূলত তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি দাবি করতে পারে। এই সর্বনাশা নীতি আমাদের রাজ্যের উন্নয়নের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে। সামগ্রিকভাবে কৃষি, শিল্প, পরিষেবা সহ রাজ্যের অর্থনীতি কয়েক যুগ পিছিয়ে দিয়েছে।

বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের যৌথ উদ্যোগে প‍‌‍‌শ্চিমবঙ্গের শান্তি, সম্প্রীতি, গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ সবকিছুই ধ্বংসস্তূপে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে হলে বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্যের উভয় সরকারকে, ক্ষমতাসীন তৃণমূল-বিজেপি-কে ক্ষমতাচ্যুত করাই হলো রাজ্য ও দেশবাসীর প্রধান কর্তব্য। একথা ঠিক যে, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই সমস্যার নিষ্পত্তি হবে না। কিন্তু এটাই হবে এই মহা সংগ্রামের প্রথম ধাপ। বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়েই এই নির্বাচনকে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্ব হি‍সেবে পরিকল্পনা তৈরি করেছে। যদিও লোকসভা নির্বাচনের আসন ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে দর কষাকষি শেষপর্যন্ত নাগপুরের রায়ের উপর নির্ভর করবে। সেইজন্য এরাজ্যে বামফ্রন্ট, বামফ্রন্ট বহির্ভূত বামদল, কংগ্রেস, আইএসএফ সহ বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধী সমস্ত দল ও শক্তিসমূহকে দ্বিধাহীনভাবে এই সংগ্রামে এক সাথে শামিল হতে হবে। একথাও মনে রাখা দরকার, কেন্দ্রে বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূল সরকার থাকলেও এদের বিরোধী শক্তিগুলি পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়যুক্ত হলে এদের বিরোধিতার মোকাবিলা করেই একটি জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলা সম্ভব। এটা একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এর সামনে রয়েছে এক বিপুল সম্ভাবনাময় বিকল্প। একটি পঞ্চায়েত-বিরোধী সরকার থাকলে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার কাজ সহজ হবে না একথা সত্য। কিন্তু সরকার-নির্ভর একটি পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর নির্ভর না করে গণ উদ্যোগের ভিত্তিতেই একটি স্বনির্ভর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা একটি বিরাট সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। যা শুরু হবে উপরতলা নয়, নিচের তলা থেকে, সরকারের উদ্যোগে নয়, গণ উদ্যোগ থেকে, ক্রিয়াশীল জনগণের অসংখ্য স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিশীল সংগ্রাম থেকে। এই পথ সমস্যাসংকুল, কিন্তু বিশাল সম্ভাবনাময় - যা আগামী দিনের মহাসংগ্রামগুলির একটি প্রস্তর কঠিন ভিত্তি স্থাপন করবে। পথে নেমেই পথের সন্ধান করতে হবে।


তথ্যসূত্রঃ

● সাফল্যের নতুন সীমানা
● এক নজরে
● উন্নয়ন ও অগ্রগতি
● তথ্য ও সংস্কৃতিবিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, নভেম্বর ২০১০