৬০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৬ জুন, ২০২৩ / ৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
কেন দরকার জনগণের পঞ্চায়েত?
অমিয় পাত্র
আপনার প্রিয় পশ্চিমবাংলা তৃণমূলী দৌরাত্ম্যে আজ ধ্বংসের কিনারায়। রাজ্যের ঘাড়ে দেনা সাড়ে ছয় লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে রাজ্যের ঘুরে দাঁড়ানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। রাজ্যে কাজ নেই, শিল্প নেই, ফসলের মূল্য নেই, আইনের শাসন নেই, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই। রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্র বিপর্যস্ত। ছাত্র আছে শিক্ষক নেই, শিক্ষক আছে ছাত্র নেই। সরকারে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছেন, পঠন-পাঠন লাটে উঠেছে। এক বছরে মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী কমেছে চার লক্ষের বেশি, পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পৌঁছাতে ২২ শতাংশ ছাত্রছাত্রী হারিয়ে যাচ্ছে। এই স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ শ্রমজীবী ও গরিব চাষির পরিবার থেকে আসা। শিক্ষা দপ্তর এবং শাসকদলের অফিস এখন চাকুরি বিক্রির দোকানে পরিণত হয়েছে। বাচ্চাদের মিড-ডে-মিল, মা ও শিশুদের পুষ্টি প্রকল্পের খাবারেও কাটমানি খাচ্ছে। সীমাহীন লুটতরাজ চলছে - কয়লা, বালি, পাথর, জঙ্গলের গাছ এবং অবাধ গোরু পাচারে। দুর্নীতির ক্ষীর খাচ্ছেন দলের সর্বোচ্চস্তরের নেতা বা নেত্রী। দুর্নীতির ধাক্কায় একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্প - রেগা, আবাস যোজনার কাজ বন্ধ। স্বাস্থ্য পরিষেবা বেহাল। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীর বহু পদ শূন্য। গ্রামের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বর্তমানে জরুরি পরিষেবা দিতেও অক্ষম। বহুক্ষেত্রে গ্রামের রাস্তাঘাট ব্যবহারের অবস্থায় নেই। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার চলছে। সরকার এখন সম্পদ বিক্রির রাস্তা ধরেছে। মাদার ডেয়ারি, তাজপুর বন্দরের পর এবার বিক্রির তালিকায় ট্রামের জমি, বন্ধ কলকারখানার জমি, জেলখানার জমি, সরকারের হাতে থাকা খাস জমি। এরজন্য আইন সংশোধন করে বলা যায় আটঘাট বেধেই সরকার নেমে পড়েছে। বর্তমানে রাজ্যে মদের বিক্রি বেড়েছে, লুট-পাচার বেড়েছে, তৃণমূল ও পুলিশের জুলুম বেড়েছে, সংবাদ মাধ্যমের গোলামি বেড়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আঘাত তীব্র হয়েছে। এই দুর্নীতি ও অরাজকতার শেষ দেখার সময় এসেছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, উৎপীড়িত। গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে এই বিষবৃক্ষকে শিকড় সহ তুলে ফেলার প্রস্তুতি। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে বামপন্থীদের ভাবনা কী, কাজের অগ্রাধিকরা কী হবে, কোন বিকল্প পথে অগ্রসর হতে হবে তার একটি রূপরেখা নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণের সামনে উপস্থাপিত করার দায় স্বীকার করেই কিছু কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।
পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে লালঝান্ডার মিছিল, রয়েছেন অমিয় পাত্র সহ অন্যান্য নেতৃত্ব।
(১) গণতান্ত্রিক পরিবেশ, আইনের শাসন ও স্বচ্ছতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা
পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার প্রাণশক্তি হলো মানুষের অংশগ্রহণ। গ্রামের সম্পদ বলতে বোঝায় - মানবসম্পদ, প্রাণিসম্পদ, জলসম্পদ, জমি, বাগান-বৃক্ষাদি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-রাস্তাঘাট ইত্যাদি পরিকাঠামো। এই সম্পদের চিহ্নিতকরণ, বিকাশ ও জনকল্যাণে তার সদ্ব্যবহার পঞ্চায়েতের মুখ্য উন্নয়নের কাজ। বিকন্দ্রিত ব্যবস্থায় একাজের জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অর্থ পঞ্চায়েত পেয়ে থাকে। এই অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিক করা, ভাতা-অনুদানের ক্ষেত্রে উপভোক্তা নির্বাচন করা - উভয় ক্ষেত্রেই প্রক্রিয়া হলো গ্রাম সংসদের সভায় আলোচনা, মতামত গ্রহণ ও পরিকল্পনা অনুমোদন। এছাড়া যে কাজ ইতিমধ্যে হয়েছে সে সম্পর্কে জনগণের মতামত নথিভুক্ত করা বাধ্যতামূলক। প্রতিটি সংসদ সভায় জনগণের যে মতামত উঠে আসে তা গ্রাম পঞ্চায়েতের সভায় আলোচ্য বিষয় হবে। কোনো মতামত গ্রহণ করা সম্ভব না হলে তার কারণ কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এই পদ্ধতি তৃণমূলী পঞ্চায়েত তুলে দিয়েছে। এই জমানায় জনগণের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই, এমনকী নির্বাচিত সদস্যদের সভায় মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। প্রায় সর্বত্র একই চিত্র। বিন্দুমাত্র স্বচ্ছতা নেই।
বামপন্থীরা চায়ঃ আগামীদিনে সাধারণ মানুষ সম্মান, মর্যাদা নিয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশে নির্ভয়ে বসবাস করতে পারবেন এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশ ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার ফিরে পাবেন। বাংলা জুলুম, জরিমানা ও তোলাবাজি মুক্ত হবে। পুলিশি জুলুম, মিথ্যা মামলা ও হয়রানি বন্ধ করে রাজ্যে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা হবে। আমাদের দাবি - নীতিচ্যুত, প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারী সদস্যকে ফিরিয়ে না আনার অধিকার নির্বাচকমণ্ডলীকে দিতে হবে। বছরে দু-বার গ্রাম সংসদের সভা হবে। সবধরনের কাজের পরিকল্পনা এবং সামাজিক সুরক্ষার উপভোক্তা নির্বাচন হবে গ্রাম সংসদ সভায় এবং সেই তালিকা প্রকাশ্যে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। নির্বাচিত সদস্যদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া হবে। পঞ্চায়েতের সমস্ত কাজে, প্রকল্প রূপায়ণে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতায় সমস্ত ভুয়া কার্ড বাতিল করা হবে। প্রত্যেকের জবকার্ড নিজের কাছেই থাকবে।
(২) কাজের সুযোগ
শ্রমজীবীদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হলো কাজের সুযোগ এবং তা থেকে প্রাপ্ত মজুরি। বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগে চাষবাসে যন্ত্র-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ফলত কৃষিমজুরদের কাজের সুযোগ কমেছে। গ্রামের গরিব তাই রেগার কাজ যা প্রচলিত কথায় ১০০ দিনের কাজের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তৃণমূলের পুকুরচুরির কারণে কেন্দ্র বরাদ্দ অর্থ আটকে দিয়েছে। চোরদের শাস্তি না দিয়ে, সর্বনাশ করা হলো গ্রামের খেটেখুটে কোনোক্রমে বেঁচে থাকা পরিবারগুলোর। কেন্দ্র ও রাজ্যের উভয় সরকার রেগার কাজের সুযোগ কেড়ে নেওয়ার জন্য দায়ী। লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েদের জন্য কাজের কোনো সুযোগ নেই। এই সরকার চুরি-দুর্নীতিতে দেশজুড়ে এতটাই কুখ্যাতি অর্জন করেছে যে, যার পরিণতিতে এরাজ্যে শিল্পে বিনিয়োগের সমস্ত সম্ভাবনাই শেষ হয়ে গেছে। সেটা মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ বোঝেন তাই সরকারি জমি তড়িঘড়ি বিক্রি করা শুরু করেছেন। নিজে শিল্প ধ্বংস করেছেন, আবার পরবর্তী সরকার যাতে কলকারখানা করার জন্য জমি না পায় তার ব্যবস্থা করে চলেছেন। সরকারি দপ্তরে শূন্যপদে লোক নিয়োগ বন্ধ। ঠিকাকর্মী নিয়ে কোনোক্রমে কাজ চলছে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বহর এতটাই যে, যার কিনারা করতে তদন্তকারী সংস্থার কত সময় লাগবে তা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা। এই অবস্থায় বাংলার ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কী? কোথায় যাবে তাঁরা?
বামপন্থীরা চায়ঃ শিক্ষাক্ষেত্র সহ সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগের বন্ধ দরজা খুলে দেওয়া হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এবং বন, পাহাড়, জঙ্গল ভিত্তিক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার কাজে পঞ্চায়েত অগ্রাধিকার দেবে। কেবলমাত্র খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৪২৬টি প্রকল্পে ৩৩০৫.১৩ কোটি বিনিয়োগ হয়েছিল এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছিল ১.১৭ লক্ষের । গ্রামীণ কর্মসংস্থানের জন্য এই উদ্যোগ পুনরায় গ্রহণ করা হবে। জমি-জল সহ গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত সদ্ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। মাছ, ডিম, মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য উন্নত প্রজাতির প্রাণী পালনের ব্যবস্থা করা হবে। স্থানীয় প্রজাতির সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শাক, সবজি, ফলফুল সংরক্ষণের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনে ১০০ দিনের পরিবর্তে ২০০ দিন কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি প্রদানের লড়াই চালিয়ে যাবে। রেগার কাজে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বর্তমান আইনে ১০০ দিনের কাজ অবিলম্বে চালু করা হবে। একইভাবে আবাস যোজনার কাজও রাজ্যে পুনরায় চালু করা হবে।
গ্রামের বেকার ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বহুমুখী পরিষেবা প্রদানের জন্য গ্রামীণ সার্ভিস সেন্টার গড়ে তোলা সম্ভব। পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে জনগণের সবধরনের চাহিদা পূরণের জন্য বিকল্প কাজের উপযুক্ত করে গ্রামের ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলা হবে।
পঞ্চায়েত গ্রামীণ সম্পদকে বিকশিত করে নতুন আয়ের পথ দেখাবে, বেকার ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দেবে। বেকার যুবকদের স্বনির্ভর দল ও সমবায় তৈরি করবে। ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে বীজ, মূলধনের ব্যবস্থা করবে।
(৩) শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ ও পরিকাঠামো
তৃণমূল জমানার ১২ বছরে শিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়নে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি হয়েছে। স্কুল, কলেজ, পর্ষদ, কাউন্সিল, কোর্ট, সিনেট কোথাও গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা নেই। স্কুলের ছুটির তালিকা, প্রশ্নপত্র তৈরি, উত্তরপত্রে কীভাবে নম্বর দেওয়া হবে এই স্বাধিকারটুকুও বোর্ড বা কাউন্সিলের নেই। সবকিছুই চলে নবান্ন থেকে। গ্রাম শিক্ষা কমিটি তুলে দেওয়া হয়েছে কেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ছাত্রছাত্রী কমছে কেন, স্কুলছুট বাড়ছে কেন, ৮,২০০ স্কুল তুলে দেবার দিকে কেন যেতে হচ্ছে, কেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে, কেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সিলেবাস ছেড়ে সিবিএসসি স্কুলে চলে যাওয়ার গতি বেড়েছে - এসব প্রশ্নে সরকারের কোনো হেলদোল নেই। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল। গরিব ও সাধারণ পরিবার এই ব্যয়বহুল শিক্ষার সুযোগ নিতে পারবে না।
এই প্রেক্ষিতে বামপন্থীরা চায়ঃ স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবস্তরে আইন অনুযায়ী শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে গণতান্ত্রিক পরিচালনা নিশ্চিত করা হবে। স্কুলের, পরিবেশ, পঠন-পাঠন, মিড-ডে-মিল সম্পর্কে গঠনমূলক পরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রাম শিক্ষা কমিটি গঠনের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হবে। স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। শিশু শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষা সম্প্রসারক নিয়োগ করে সমস্ত কেন্দ্র চালু রাখা হবে। সমাজে আর্থিকভাবে দুর্বল ও অনগ্রসর অংশের শিশু ও কিশোরদের মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সমস্ত দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে। এলাকার শিক্ষিত, ভাতাপ্রাপ্ত মহিলাদের সাম্মানিক প্রদান করে এই অংশের পড়ুয়াদের জন্য ফ্রি কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় ৫ বছরের বেশি বয়সের সকল ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভরতি করা হবে এবং পড়াশোনা ছেড়ে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা হবে। আদিবাসী ও তপশিলি জাতির ছাত্রদের স্কুলের হোস্টেল পুনরায় চালু করা হবে।
(৪) সামাজিক সুরক্ষা
সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষের পুষ্টি, আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি বা দারিদ্র্য সীমার নিচে থেকে উপরে তুলে আনার পদক্ষেপ হিসাবে নানা ধরনের দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৭৪-১৯৭৮) মূল লক্ষ্য ছিল। একেবারে গোড়ার দিকে পরিকল্পনা প্রণেতাদের মতামত ছিল উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেকারি, বৈষম্য ও দারিদ্র্য কমে যাবে। একে বলা হয় উন্নয়নের চুইয়ে পড়া প্রভাব। এই তত্ত্বে কাজ না হওয়ায় সরকারি অনুদান, ঋণ বা আইআরডিপি-র মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে স্বাধীনতার পর তিন দশক কেটে যায়। গত শতকের আটের দশক থেকে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তা কার্যত সামাজিক সুরক্ষা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে। কন্যাশ্রী নামটা বর্তমান সরকারের দেওয়া। ২০০৮ সালের এই কেন্দ্রীয় প্রকল্প সারা দেশে চালু ছিল Incentive Scheme for girl students - এই নামে। এ রাজ্যেও এই স্কিম চালু হয়েছিল। ২০০৮ থেকে ছিল, এখনও আছে, পরেও থাকবে। ২ টাকা কেজি চাল - বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের প্রকল্প। রাজ্য বাজেটে চালের ভরতুকির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা হয়েছিল। এখন সারা দেশের জন্য ভরতুকি দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ১০০ দিনের কাজ বামপন্থীদের লড়াইয়ের ফসল। ২০০৬ সাল থেকে চালু হয়েছে। এখন বন্ধ তৃণমূলের লুটপাটের জন্য। তৃণমূল বিদায় হলেই আবার শুরু হবে।
বামপন্থীরা দায়িত্বে এলে - সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষের জন্য চালু সমস্ত জনকল্যাণমুখী প্রকল্প অব্যাহত থাকবে। সমস্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের প্রয়োজন ভিত্তিক সম্প্রসারণ করা হবে এবং রূপায়ণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে।
স্ব-সহায়ক গ্রুপের সদস্যরা স্ব-নির্ভরতা অর্জনের পরিবর্তে মাইক্রোফাইন্যান্সের চড়া সুদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন। মাইক্রোফাইন্যান্সের চড়া সুদের লুট বন্ধ করা হবে। বাম আমলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের দেয় সুদের একাংশ রাজ্য সরকার বহন করত। সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে। মহিলাদের সশক্তিকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কার্যকরী পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিটি গোষ্ঠীকে অর্থকরী কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নে দায়বদ্ধ বামফ্রন্ট সরকার ২০০৯ সালে ‘আমার বাড়ি’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল।এই প্রকল্পে মাসে ছ’হাজার টাকা পর্যন্ত পারিবারিক আয় এবং নিজেদের পাকা বাড়ি নেই এরূপ পরিবারের জন্য পাকা বাড়ি করে দেওয়া শুরু হয়। এই প্রকল্প সময়োপযোগী করে গৃহহীন মানুষের প্রত্যেক পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে।
ভূমিহীন কৃষক-খেতমজুরদের জন্য বাম আমলে প্রফিডেন্ট ফান্ড (প্রফলাল) প্রকল্পে যুক্ত হয়েছিলেন ২৫ লক্ষ খেতমজুর। বর্তমানে প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বামপন্থীরা দায়িত্ব পেলে সুদ সহ সমস্ত টাকা ফেরত দেবে এবং এই প্রকল্প পুনরায় চালু করা হবে।
বামফ্রন্ট সরকার ‘চাষ ও বসবাসের ভূমিদান প্রকল্পে’ খেতমজুর, গ্রামীণ কারিগর ও মৎস্যজীবীদের বিনামূল্যে ৫ কাঠা করে জমি দিয়েছে। প্রায় দু’লক্ষ পরিবার এই প্রকল্পে উপকৃত হয়েছেন। দায়িত্ব পেলে এই প্রকল্প রূপায়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সরকারের হাতে থাকা জমি ভূমিহীন, বাস্তুহীনদের বঞ্চিত করে বৃহৎ ব্যবসায়ী, কোম্পানি বা করপোরেটকে মালিকানা স্বত্ব দেওয়ার আইন বাতিল করা হবে।
(৫) কৃষিকাজ ও কৃষক কল্যাণ
উদারনীতির যুগে কৃষকদের অস্তিত্বের সংকট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই একাংশের কৃষক জমি চাষ ছেড়ে বাঁচার বিকল্প পথ খোঁজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সার, বীজ, কীটনাশক সহ সমস্ত কৃষি উপকরণের মূল্য যেভাবে বেড়েছে তার তুলনায় ফসলের দাম পাওয়া যাচ্ছে না। সহায়ক মূল্য ফসল কেনার ব্যবস্থায় কিছু ব্যবসায়ী, ফড়ে এবং শাসকদলের নেতা-কর্মীদের মুনাফা অর্জনের পথ প্রশস্ত করেছে। কৃষক যথারীতি বঞ্চনার শিকার।
আমাদের অগ্রাধিকার হলোঃ কৃষকের স্বার্থে সমবায় সমিতিগুলোর গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সমবায় থেকে চাষিদের দাদন, বিমার সুযোগ, ন্যায্য মূল্যে সার ও কৃষি উপকরণ পাওয়ার সুবিধা দেওয়া হবে। সমবায় সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার ব্যবস্থা করবে। কৃষিকে উৎসাহিত করতে পঞ্চায়েতের ব্যবস্থাপনায় নাবার্ড (NABARD)-এর সাহায্যে গ্রামে গ্রামে খামার পাঠশালা গড়ে তোলা হবে যেখানে কম খরচে চাষবাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সমবায় সমিতির মাধ্যমে ফসল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের ব্যবস্থা করা হবে।
কৃষকের ফসল সহায়ক মূল্যে বিক্রির জন্য ফুড কর্পোরেশনের ক্রয়কেন্দ্র বাড়াতে, বিপণন সমবায়গুলিকে ফসল কেনার কাজে যুক্ত করতে পঞ্চায়েত কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বর্তমানে মৌখিক চুক্তিতে গ্রামের খেতমজুর এবং গরিব চাষি জমি চাষ করেন। তাদের জমির কোনো বৈধ নথিপত্র নেই। ফলে কোনো সরকারি সুবিধা বা বিমার সুযোগ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানে পঞ্চায়েত কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
বর্গাদার ও পাট্টাদারদের দখল থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করা হবে। পাট্টা বাতিল করে জমি কেড়ে নেওয়া বন্ধ করা হবে। সমস্ত পাট্টা প্রাপকের জমি চিহ্নিত করে দখল দেওয়া হবে।
বনভূমিতে চাষ ও বসবাসকারী আদিবাসীদের সংশ্লিষ্ট জমি পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কৃষির সঙ্গে রেগার কাজকে যুক্ত করার জন্য পঞ্চায়েত উদ্যোগ গ্রহণ করবে।