৬০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৬ জুন, ২০২৩ / ৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
পঞ্চায়েত নির্বাচনে একমাত্র বিকল্প বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি
অর্ণব ভট্টাচার্য
এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন গ্রাম বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার ও আত্মমর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াই। এই রাজ্যের মানুষ কখনো ভুলতে পারবে না কি ভয়ংকর জুলুম করে তৃণমূল কংগ্রেস বিগত ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। মনোনয়নপত্র জমা করতে গিয়ে আহত, রক্তাক্ত হয়েছিলেন বিরোধী দলের প্রার্থীরা। ভোটের দিন বুথে গিয়ে মানুষ দেখেছিলেন তাদের ভোট দিয়ে দিয়েছে শাসকদলের গুন্ডাবাহিনী। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকে এরকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি এ রাজ্যের মানুষের। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর জয়ী বিরোধী প্রার্থীদের জোর করে, ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা মামলা দায়ের করে দল পরিবর্তন করিয়ে নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক আধিপত্য তৈরির যে অসুস্থ সংস্কৃতি আমদানি করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস তার সব থেকে কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে। গণতন্ত্রকে সমূলে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ প্রাণহীন করে দিয়েছে এ রাজ্যে। বাংলার গ্রামাঞ্চলকে লুঠেরা আর দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত করেছে তৃণমূল। দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলার মানুষ যে অধিকার অর্জন করেছিলেন এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সুফল ভোগ করেছিলেন তাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এ বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলকে গ্রামবাংলা থেকে মুছে দিতে হবে।
এবারে বশংবদ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে কোনো সর্বদলীয় বৈঠক ছাড়াই নজিরবিহীনভাবে তড়িঘড়ি পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হলো। মনোনয়নের জন্য ইচ্ছাকৃত অত্যন্ত কম সময় রাখা হলো। তা সত্ত্বেও বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম করার স্বপ্ন এবার অধরা থেকে যাবে। কেননা, ২০১৮ আর ২০২৩-র পার্থক্য কেবল বছরের নয়, অভিজ্ঞতার। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, মানুষ শাসক তৃণমূলের অপশাসনে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছেন। তাই তারা প্রস্তুত হচ্ছেন।
এখনো পর্যন্ত যেভাবে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে মনোনয়নপত্র জমা পড়ছে তা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। ভয় ভীতিকে জয় করে, শাসকদল ও পুলিশের বাধা পেরিয়ে মনোনয়নপত্র জমা করতে আসছেন মানুষ। মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস বাঁশ, লাঠি, ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করেও বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিকে দমাতে পারছে না। সব থেকে বড়ো কথা কোথাও হামলাকারীরা পার পাচ্ছে না। আঘাত খেয়ে প্রত্যাঘাত করছে মানুষ। অনেক জায়গায় বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে জনসমাবেশ আর তার প্রতিরোধী মেজাজ দেখে গুটিয়ে যাচ্ছে শাসকদলের গুন্ডাবাহিনী। সব মিলিয়ে সাহসী, প্রত্যয়ী জনতার সামনে তৃণমূলের পশ্চাদপসরণ বাংলার রাজনীতিতে অন্য মাত্রা যোগ করছে। রাজ্যে গণতন্ত্র কায়েমের সংগ্রামে এ এক ইতিবাচক ইঙ্গিত।
বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলির পক্ষে এই জনসমর্থন ও তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির লড়াকু মেজাজ রাজ্যের শাসকদল ও সাম্প্রদায়িক শক্তির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। যথারীতি বশংবদ মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে বিজেপি-কে তুলে ধরে তৃণমূল বনাম বিজেপি’র পুরনো বাইনারি তৈরির চেষ্টা চলছে। লক্ষণীয় যে, এই নির্বাচনে এখনো পর্যন্ত শাসকদলের হাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিজেপি’র ক্ষেত্রে খুব কম। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল বনাম বিজেপি’র দ্বিমুখী লড়াইয়ের ভাষ্যকে জনমানসে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কাজ চলছে। এবারেও এই ভাষ্য শাসকদলের পক্ষে অত্যন্ত সুবিধাজনক কেননা এর ফলে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে বামপন্থী বিকল্পের যে ধারা বাংলার গ্রামাঞ্চলে ১৯৭৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বহমান ছিল তা নিয়ে চর্চা আলোচনার বাইরে চলে যেতে পারে। আর সাম্প্রদায়িক শক্তির পক্ষেও এই পরিকল্পনা অত্যন্ত সুবিধাজনক কারণ এর ফলে মেরুকরণের রাজনীতির আড়ালে চলে যায় মানুষের দৈনন্দিন রুটিরুজির জ্বলন্ত সমস্যা।
বাংলার মানুষ দেখেছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের যে সমস্ত দুষ্কর্ম জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম করায় সর্বাগ্রে থেকেছে বামপন্থী দলগুলি ও তাদের সহায়ক গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ। ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারির সময় থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের একের পর এক দুর্নীতি আর লাগামহীন লুঠ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাস্তার ও আদালতের লড়াই চালিয়েছে বামপন্থীরা। অথচ যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের সারদা-নারদা কেলেঙ্কারির জন্য কোনোরকম শাস্তি হয়নি, সৌজন্যে দিল্লির বিজেপি সরকার। নিয়োগ-দুর্নীতি, কয়লা-গোরু পাচার কাণ্ডের তদন্তেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘসূত্রিতা চলছেই। শাসকদলের কয়েকজন নেতা কারাবন্দি হলেও দুর্নীতির উৎসমুখে পৌঁছানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির গড়িমসি লক্ষ করছেন রাজ্যবাসী। যত সময় নষ্ট হচ্ছে তত দুর্নীতির প্রমাণ লোপাট করছে শাসকদল। আর এই সবকিছু হচ্ছে তৃণমূল-বিজেপি’র রাজনৈতিক দরকষাকষির অঙ্গ হিসেবে। বিপন্ন হচ্ছে বাংলার ভবিষ্যৎ।
গত এক দশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলার মানুষের অতীতের ঐতিহ্য যে অনেকটাই ম্লান হয়েছে তার জন্য দায়ী তৃণমূল এবং বিজেপি। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে এই দুই দলের মদতে। প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রেখে পরিস্থিতি জটিল করে তোলা হয়েছে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার স্বার্থে। সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করার ধ্বংসাত্মক এই পরিকল্পনায় তৃণমূল এবং বিজেপি পরস্পরের সহযোগী। বাংলার গ্রামীণ জীবন তথা সামগ্রিক সমাজজীবনকে দূষিত করার ষড়যন্ত্রে শামিল এই দুই দলকে প্রত্যাখ্যান করাই সময়ের দাবি।
এই যাবতীয় দুর্নীতি, অপশাসন, লুঠ, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপরীতে জনমুখী ও গণতান্ত্রিক অবস্থান গ্রহণ করেছে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি। কৃষকের ফসলের ন্যায্য দামের স্বার্থে, বেকার যুবকের কাজের দাবিতে, ১০০ দিনের কাজের দাবিতে ও মজুরি বাড়ানোর দাবিতে, আবাস যোজনা সহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে লাগাতার সরব হয়েছে বামপন্থীরা। বিভিন্ন সময় পাশে পেয়েছে অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে। তাই গ্রামাঞ্চলে মানুষ জোট বাঁধছেন বিকল্প নীতির ভিত্তিতে। জাত-ধর্ম নিয়ে ছায়াযুদ্ধ নয়, ভাতের-কাজের -আত্মমর্যাদার লড়াইকে জয়যুক্ত করতে হলে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। এরাজ্যের লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ে কাজ না পেয়ে যেভাবে ভিন রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে তার অবসান ঘটাতে, কৃষি ও শিল্পের ভারসাম্যমূলক বিকাশকে সম্ভব করে তুলতে মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হয়ে, ঋণের জালে জড়িয়ে কৃষকরা যেভাবে আত্মঘাতী হচ্ছেন তাকে আটকাতে হলে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যেভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুঠ চলছে তাকে প্রতিহত করতে হলে পঞ্চায়েত স্তর থেকেই রাজনৈতিক ও আইনি প্রতিরোধ গড়তে হবে। যে বিজেপি আম্বানি-আদানিদের মতো আগ্রাসী ও লুঠেরা করপোরেটের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত, যারা অন্যায়ভাবে করপোরেটমুখী কৃষি বিল পার্লামেন্টে পাস করিয়ে কৃষককে ভাতে মারার ব্যবস্থা করে, যারা বাংলার ধর্মীয় সম্প্রীতির পরিবেশকে সর্বদা কলুষিত করে, যাদের সরকার করোনা মহামারীর সময় লাখো লাখো পরিযায়ী শ্রমিক সহ অসংখ্য সাধারণ মানুষকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তারা কখনো অত্যাচারী, লুঠেরা তৃণমূলের বিকল্প হতে পারে না। জ্বলন্ত উনুনের বদলে ফুটন্ত কড়াই কেন বেছে নেবে বাংলার মানুষ? রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিজেপি এবং তৃণমূলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলিতে যোগদানের যে সমস্ত ঘটনা সামনে আসছে তা এই মোহভঙ্গেরই ইঙ্গিত।
তাই মানুষের সামনে নিঃসন্দেহে নির্ভরযোগ্য বিকল্প বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি। এরাজ্যে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বলিষ্ঠতা লাভ করেছিল। গ্রামে গ্রামে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে তপশিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু ও নারীদের যে ক্ষমতায়ন হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন - তার কোনো নজির এদেশে নেই। বিগত ১২ বছরে বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করে, ভয় দেখিয়ে, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর দৈহিক সন্ত্রাস ও মিথ্যা মামলার বোঝা চাপিয়ে, অবাধে লুঠ-দুর্নীতি চালিয়ে যে অপরাধ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস, তার যোগ্য জবাব দেবার সময় এসেছে। উজ্জীবিত বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি কেবল এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম।