E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৬ জুন, ২০২৩ / ৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

সাভারকরের অপরাধ আড়ালের চেষ্টা

সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


গান্ধী হত্যার বিচারের সময় আদালতে সাভারকার। (পেছনের সারিতে)

[আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অরগানাইজার’ তার ২৮ মে ২০২৩ তারিখের সংখ্যায় বিনায়ক দামোদর সাভারকরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমালোচনাকে ‘মিথ’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। তার মধ্যে দুটি বিষয়ের দিকে বর্তমান আলোচনায় দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হবে।]

।। এক ।।

‘অরগানাইজার’-এ প্রশ্ন তোলা হয়েছেঃ সাভারকর কি দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন?

সরাসরি উত্তর হলো হ্যাঁ। ‘অরগানাইজার’-ও কিন্তু এমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি, যা থেকে প্রমাণ করা যায় যে, সাভারকর কি দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন না।

১৯৩৭ সালে আমেদাবাদের কর্ণাবতিতে সারা ভারত হিন্দু মহাসভার কনভেনশনে সাভারকর বলেছিলেনঃ ভারতে দুটি বৈরি জাতি পাশাপাশি বাস করে। বেশ কিছু শিশু সুলভ রাজনীতিবিদ একথা মনে করে গুরুতর ভুল করেছেন যে, ভারতকে ইতিমধ্যেই সম্প্রীতিপূর্ণ জাতি হিসেবে নির্মাণ করা হয়ে গেছে। অথবা ভারতকে সম্প্রীতিপূর্ণ জাতি হিসেবে নির্মাণ করা যেতে পারে নিছক ইচ্ছার ওপর ভর করে। এসব কথা ভাবতে ভালো লাগে, কিন্তু চিন্তাহীন বন্ধুরা তাদের স্বপ্নের ওপর ভর করে বাস্তবের দিকে তাকিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে তথাকথিত সাম্প্রদায়িক প্রশ্নগুলি হিন্দুদের ও মুসলমানদের মধ্যে, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং জাতীয় বৈরিতার প্রকরণে, বহু শতাব্দী ধরে নির্মিত হয়ে উঠেছে ও আমাদের হাতে একটি উত্তরাধিকার হিসেবে অর্পিত হয়েছে। আসুন আমরা সাহসের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনাগুলির মুখোমুখি হই। ভারতকে আজও একটি ঐক্যবদ্ধ এবং সমসত্ত্বধর্মী জাতি হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। ভারতে দুটি বিপরীতধর্মী জাতি আছে - হিন্দু ও মুসলমান। সাভারকরের ধারণা অনুসারে ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠনের ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল– তা ১৯৭১-এ বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে।

সাভারকর ধরে নিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িকতা প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বেও অস্তিত্ববান ছিল। কিন্তু আধুনিক ভারতে গণতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেসব ঐতিহাসিক ইতিহাসচর্চা করেছেন ও করছেন, তারা যে স্কুল বা ঘরানার ঐতিহাসিকই হন না কেন, তারা সবাই এই বিষয়ে একমত যে, সাম্প্রদায়িকতা আধুনিক যুগের, ঔপনিবেশিক যুগের নির্মাণ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ১৯২৩-এ সাভারকর যখন ‘হিন্দুত্ব’ বইটি লিখলেন তখন থেকেই একটি ঔপনিবেশিক যুগের রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে তা সামনে এল। তার আগে হিন্দুত্ব নামে কোনো তত্ত্বের অস্তিত্ব ছিল না।

আবার ১৯৪০-এর মার্চে মুসলিম লিগ যখন পাকিস্তান-প্রস্তাব গ্রহণ করল, তখন মহম্মদ আলি জিন্না সাভারকরের ১৯৩৭-এর উক্ত বক্তব্যের উল্লেখ করেছিলেন ও দ্বিজাতি তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। আবার ১৯৪৩-র ১৫ আগস্ট নাগপুরে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে সাভারকর নিজেও বলেছিলেনঃ দ্বিজাতি তত্ত্ব বিষয়ে আমার সঙ্গে জিন্নার সঙ্গে ঝগড়া নেই। আমরা হিন্দুরা নিজেরাই একটি জাতি। এটা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য যে, হিন্দু ও মুসলিমরা দুটি পৃথক জাতি। আরএসএস ‘অরগানাইজার’-এর উক্ত সংখ্যায় এই বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করুক না কেন সাভারকরই যে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। পাশাপাশি এটাও লক্ষণীয় বিষয়ঃ ১৯৪২-এ সিন্ধু প্রদেশে হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগ কিন্তু কোয়ালিশন সরকার চালিয়েছিল। যদিও এই দুই দল আগেই ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলিমরা দুটি পৃথক জাতি - একথা আগেই ঘোষণা করে দিয়েছে।

১৯৪০-এর অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার ২২তম বার্ষিক অধিবেশনে ভাইসরয়ের মূল্যায়নের সঙ্গে যে তিনি একমত একথা ঘোষণা করে সাভারকর বলেছিলেন, হিন্দু মহাসভা ভারতের সমস্ত হিন্দুর প্রতিনিধি ও মুসলিম লিগ সমস্ত মুসলিমের। যা ঐতিহাসিকভাবেই ভুল। তার এই সোচ্চারে ঘোষিত সিদ্ধান্তের ভিত্তি ছিল ‘দুই অ্যান্টাগোনিস্টিক নেশনের’ ধারণা।

তাঁর চিন্তায় এই অ্যান্টাগোনিজম বা অমীমাংসেয়তার উৎপত্তি হিন্দুত্বের ধারণার মধ্যে। ‘হিন্দুত্ব’ বইতে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেনঃ হিন্দুইজম ও হিন্দুত্বের ধারণাকে গুলিয়ে ফেলা হয়। হিন্দুইজম হলো হিন্দুত্ব থেকে উৎপন্ন একটি পৃথক শব্দ ও তারই একটি ডেরিভেটিভ। তিনি হিন্দুত্বের ইংরেজি হিসেবে হিন্দুনেস শব্দটি পছন্দ করেছিলেন। হিন্দুজাতির যতকিছু চিন্তাধারা ও ক্রিয়াকলাপ ‘হিন্দুত্ব’ শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সাভারকরের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ববাদ গুণগতভাবে পৃথক। হিন্দুধর্ম একটি ধর্ম ও তার ইতিহাস হলো ইনক্লুসিভ বা গ্রহণমূলক এবং হিন্দুত্ববাদ হলো একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব ও তার অবস্থান হলো এক্সক্লুসিভ বা বর্জনমূলক। হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ মানে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে আক্রমণ নয়।

‘হিন্দুত্ব’ পুস্তিকাটিতে এই মতাদর্শকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল এইভাবেঃ তাদের বিশ্বাস যাই হোক যে, সমস্ত মানুষ ভারতকেই তাদের নিজেদের ‘মাতৃভূমি, পিতৃভূমি ও পূণ্যভূমি’ হিসেবে বিবেচনা করে হিন্দুত্বের আওতায় (ambit) আসতে পারে। যারা ভারতে বাস করে, কিন্তু যাদের পূণ্যভূমি অন্য কোথাও, যেমন মুসলিমদের (মক্কা ও মদিনা) ও ক্রিশ্চিয়ানদের (যাদের পবিত্র ভূমি বর্তমান প্যালেস্তাইনের জেরুজালেম, বেথেলহেম ইত্যাদি) তারা হিন্দুত্বের আওতার বাইরে থাকবেন। হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘হিন্দুআইজ দ্যা মিলিটারি, মিলিটারাইজ হিন্দুডম’। হিন্দুত্ব আধিপত্যবাদীরা সবসময়েই অবৈজ্ঞানিক ও অনৈতিহাসিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ‘প্রতিষ্ঠা’ করতে চেয়েছে যে, হিন্দুরা সবসময়েই ও ধারাবাহিকভাবে একটি নেশন বা জাতি ছিল। যা তাদের এগিয়ে দিয়েছে হিন্দুত্ব জাতি বিষয়ক অসহিষ্ণু, ফ্যাসিস্টিক জেদের দিকে। এই জেদের ভিত্তিতেই সাভারকরকে বানিয়ে তুলতে হয়েছিল তার দ্বিজাতি তত্ত্ব। হিন্দু ও মুসলিমরা দুটি আলাদা জাতি, তাই তাদের জন্য চাই দুটি আলাদা রাষ্ট্র। আরএসএস এখন সাভারকরকে দ্বিজাতি তত্ত্বের সৃষ্টির অপরাধ থেকে যতই মুক্ত করার চেষ্টা চালাক না কেন, তা পুরোপুরি অসম্ভব।

।। দুই ।।

‘অরগানাইজার’-এর উক্ত সংখ্যায় সাভারকরকে গান্ধীহত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। লালকেল্লায় গান্ধীহত্যার বিচারপ্রক্রিয়া চলেছিল জাস্টিস আত্মাচরণের বিশেষ আদালতে ১৯৪৮’র ২২ জুন থেকে ও ১৯৪৯-র ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। জাস্টিস আত্মাচরণের কোর্টে গান্ধীহত্যার বিচার প্রক্রিয়ার সময়ে আইনের একটি ছোট্ট ফাঁকের সাহায্যে সাভারকর মুক্তি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ১৯৬৬ সালে গান্ধী হত্যা বিষয়ে গঠিত কাপুর কমিশন প্রায় চার বছর ধরে গান্ধীহত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত শতাধিক স্বাক্ষীকে ডেকেছিলেন ও অসংখ্য ডকুমেন্ট পরীক্ষা করেছিলেন। যে সব স্বাক্ষী লালকেল্লায় জাস্টিস আত্মাচরণের কোর্টে হাজির ছিলেন না, কিন্তু যারা মহাত্মার হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তথ্য-স্বাক্ষ্য দিতে সক্ষম, তাদের দেওয়া প্রচুর তথ্য-সাক্ষ্যকেও কাপুর কমিশন বিবেচনা করেছিল। কমিশন সাভারকরের দেহরক্ষী আপ্পা রামচন্দ্র কাসার ও তার সেক্রেটারি গজানন বিষ্ণু দামলের বিবৃতি রেকর্ড করেছিলেন – যা আত্মাচরণের কোর্টে হাজির করা হয়নি। কমিশন ১৯৪৮-র দিল্লি ও মুম্বাই পুলিশের তথ্যগুলিকে পুনরায় বিচার-বিবেচনা করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেনঃ All these facts taken together were destructive of any theory other than the conspiracy to murder by Savarkar and his group। অর্থাৎ কাপুর কমিশন যে সমস্ত তথ্য একত্রিত করেছিলেন সেগুলির ভিত্তিতে একমাত্র এই সিদ্ধান্তেই পৌছানো যায় যে, সাভারকর ও তাঁর গোষ্ঠীই গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। এছাড়া অন্য কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।‘অরগানাইজার’-এর উক্ত সংখ্যায় কাপুর কমিশনের রিপোর্টকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। সাভারকরের বিরোধীরা নাকি কাপুর কমিশনের একটি বাক্যকে আঁকড়ে ধরে সাভারকরকে গান্ধীহত্যায় যুক্ত করতে চান।

সাধারণভাবে কাপুর কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে আলোচনা দেখা বা শোনা যায়না। কাপুর কমিশনের রিপোর্ট দুখণ্ডে ছাপার আকারে পাওয়া যায়। (প্রকাশক হচ্ছেন Notion Press.com, Old Road, 38, New No. 6, McNichols Road, Chetpet, Chennai) গান্ধী হত্যা সম্পর্কে ১৯৬৪ সালে নতুন করে তথ্যানুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু করার ও কাপুর কমিশন গঠন করার প্রয়োজন হয়েছিল তা বোঝা দরকার। নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে গান্ধীহত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে অনেক বছর আম্বালা জেলে বন্দি ছিলেন। তিনি জেল থেকে ছাড়া পাবার পরে ১৯৬৪-র ১১ নভেম্বরের তাকে পুনরায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় গজানন বিশ্বনাথ কেটকর দাবি করেন, গান্ধীজিকে হত্যা করা হলে তার ফলাফল কী হবে সে সম্পর্কে নাথুরাম তার সঙ্গে আলোচনা করতেন। ১৪ নভেম্বর ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ অনুষ্ঠানের বিষয়টি সামনে আনে। কিন্তু কেটকরকে ১৯৪৮-এ গান্ধীহত্যার বিচারের সময়ে স্বাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়নি। সেইসময়ে ও সেইসূত্রে আরও জানা যায়, গান্ধীহত্যার বিষয়টি জানতেন এমন আরও অনেকে আছেন যাদের জাস্টিস আত্মাচরণের কোর্টে স্বাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়নি। উক্ত সভায় জি ভি কেটকার ঐসব দাবি করার পরে স্বভাবিকভাবেই দেশ জুড়ে আলোড়ন পড়েছিল। ২৯জন এম-পি এই বিষয়ে সোচ্চার হন। মনে রাখা দরকার, কেটকার ছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলকের নাতি ও ‘কেশরী’ পত্রিকার সম্পাদক। গান্ধীহত্যার পরে ‘কেশরী’–তে গডসেকে গ্লোরিফাই করা হচ্ছিল। তখন মহারাষ্ট্রের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বি জি খের ও মহারাষ্ট্র বিধানসভার কংগ্রেসের চিফ হুইপ নরহর বিষ্ণু গ্যাডগিল লিখিতভাবে বিষয়টি নেহরু ও প্যাটেলকে জানান। কেটকরকে এই অপরাধের জন্য ৩,০০০ টাকা ফাইন দিতে হয়েছিল ও তাঁকে জেল খাটতেও হয়েছিল। কেটকরের মতো ব্যক্তি এই দাবি করার পরে দেশজুড়ে যে আলোড়ন পড়েছিল তার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দা ১৯৬৬-র ২২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র মোস্ট উকিল গোপাল স্বরূপ পাঠক-এর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই গোপাল স্বরূপ পাঠককে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। তখন ১৯৬৬-র ২১ নভেম্বর থেকে বিচারক জীবনলাল কাপুর-এর নেতৃত্বে কমিশন কাজ শুরু করেনও তাঁর রিপোর্ট পেশ করা হয় ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯। সাভারকর প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৬৬-র ২৬ ফেব্রুয়ারি। স্বাভাবিকভাবেই কাপুর কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নতুন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু সম্ভব হয়নি।