৬০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৬ জুন, ২০২৩ / ৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (পনেরো)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
মনুস্মৃতি
● মনুস্মৃতিকে মানব ধর্মশাস্ত্র অথবা মনুর বিধান বলেও অভিহিত করা হয়। মনুস্মৃতি বিবস্বান্ ঋষির পুত্র বৈবস্বত মনুর রচনা বলে মনে করা হয়। মনুস্মৃতির ভাষা ও অন্যান্য নিদর্শন থেকে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে, পুরাণে উল্লিখিত একাধিক মনুর মধ্যে আলোচ্য মনু খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মানুষ। যদিও ভিন্নমতে মনুস্মৃতি প্রথম থেকে তৃতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত। ডঃ রাধাকৃষ্ণাণের মতে মনুস্মৃতিতে সামাজিক আচার ও ধর্মভাবনার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। তাই বলা যায় যে, মনুস্মৃতি হলো বিশ্বাসের ভিত্তিতে জনগণকে শাসন করার হাতিয়ার। প্রশ্নহীন বিশ্বাস দমনমূলক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। মনুস্মৃতি প্রণয়নের সময়ে যাযাবর পশুপালক জীবন থেকে কৃষিভিত্তিক জীবনে উত্তরণ ঘটেছিল। ছোটো ছোটো জনগোষ্ঠীগুলি উপজাতীয় ক্ষুদ্র রাজ্য গঠনে একত্রিত হচ্ছিল। আবার এক উপজাতীয় গোষ্ঠী অন্য উপজাতি দলকে পরাজিত করছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, জাতি বা বর্ণভেদের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলি উৎপাদনকারী জাতিগুলির উপর আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। স্মৃতি ও ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে মনু পুরোহিততন্ত্রের যুক্তিবাদ রচনা করেছিলেন। শোষণের মাধ্যমে বিকশিত বর্ণ। জাতিভেদ প্রথা ঈশ্বর বা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নামে বংশ পরম্পরায় প্রসারের মূল ভিত্তি তৈরি হয়েছিল।
● প্রসঙ্গত ‘মনুস্মৃতি’ এই নামকরণ পরবর্তীকালে। ‘মানব ধর্মশাস্ত্র’ নামেই প্রথমে এর পরিচিতি ছিল। ‘স্মৃতি’ শব্দটির অর্থ ‘যা স্মরণে রাখতে হয়’। একজন বা কয়েকজনের (কয়েক প্রজন্ম ধরেও হতে পারে) দ্বারা তা লিখিত। মনুস্মৃতিতে ১২টি অধ্যায় রয়েছে। ২,৬৯৪টি স্তবক (Stanzas) রয়েছে। এতে মহাজাগতিক বিষয় থেকে শুরু করে ধর্ম, সংস্কার, উপনয়ন, বিবাহ, আতিথেয়তা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া (Funerals rites), খাদ্য তালিকা, মহিলা ও স্ত্রীদের আচরণ, রাজাদের আইন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
● মহাভারতের শান্তিপর্বে মনুকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে - ভগবান বিষ্ণু এক সুমহান রাজা সৃষ্টি করেছিলেন। দেবতা ও ঋষিরা মিলে তাকে ধর্ম মেনে চলার শপথ গ্রহণ করিয়েছিলেন। সেই ধর্মের প্রতিজ্ঞা ছিল বর্ণব্যবস্থা লঙ্ঘন করা যাবে না এবং ব্রাহ্মণকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
● নারদ স্মৃতি মতে রাজা অক্ষম বা অদক্ষ হলেও প্রজারা নিষ্ঠাসহ রাজশাসন মেনে চলবে যেমন স্ত্রীরা অপদার্থ/অক্ষম স্বামীর সেবা করবে। রাজা হওয়া ঐশ্বরিক অনুমোদন যা ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রজাদের শাসন কর্তৃত্ব বজায় রাখে। কিন্তু রাজা ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়দের বিরুদ্ধাচারণ করলে তথাকথিত ঐশ্বরিক অনুমোদন তাকে উদ্ধার করবে না। স্মৃতি অনুসারে এমন ধরনের রাজা অবিলম্বে অপসারিত হবে। পৌরাণিক একটি গল্পে আছে যে, রাজা বেন ও তার স্ত্রী সুনীতা বৈশ্য ও শূদ্রদের পক্ষে কাজ করে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা মিলে সেই রাজাকে হত্যা করে। রাজা নহুর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিবাদ করে রাজ্য হারিয়ে অভিশপ্ত অতিকায় এক সাপের জীবন লাভ করেছিল। সুতরাং রাজক্ষমতা ধরে রাখার শর্ত হলো অন্যদের দমন করে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের স্বার্থ করা। মনু যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তা পদ্ধতির তীব্র বিরোধী ছিলেন। বেদ ও স্মৃতির প্রশ্নাতীত কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো যৌক্তিক অবস্থান, এমনকী কোনো ব্রাহ্মণ গ্রহণ করলেও, তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করার বিধান ছিল। নাস্তিক, যুক্তিবাদী, গবেষক বা স্বাধীনচেতা বস্তুবাদী যারা বেদ-এর কর্তৃত্ব সমর্থন করে না, মনুর মতে তারা অসামাজিক। মনু এই শ্রেণির মানুষদের তস্কর ও প্রতারক বলে ঘোষণা করেছিলেন। মনুবাদীদের এই অসহিষ্ণু মনোভাব বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে প্রায়শ দেখা যায়।
● আসলে, বেদ-এর সারকথাকে অবলম্বন করেই মনুর সমস্ত রচনা, মনুস্মৃতি। অনেক সময়ে মনুকে শ্রেষ্ঠ স্মৃতি লেখক বলে বর্ণনা করা হয়। মনুর মতে ধর্ম হলো, যা সর্বসময়ে শিক্ষিতরা অনুসরণ করেন, যে শিক্ষিতরা আনুগত্য ও বিদ্বেষ বর্জিত এবং হৃদয় যার সম্মতি দেয় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মনু চার (৪) ধরনের ধর্মের কথা বলেছেন। (১) বৈদিক আদেশ পালন, (২) স্মৃতির আদেশ পালন, (৩) ভালো ব্যক্তিদের প্রথাগত অনুশীলন অনুসরণ করা, (৪) এমন ধরনের কার্যের সম্পাদনা যা যিনি সম্পাদন করলেন তাকেও সন্তুষ্ট করে।
মনুস্মৃতি অনুযায়ী প্রতিটি বর্ণের নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে হয়। বর্ণ অনুসারে সেই কাজগুলি হলো -
● ব্রাহ্মণ - জ্ঞান চর্চা, শিক্ষাদান, যজ্ঞ সম্পাদন, দান গ্রহণ অন্যের পরিতুষ্টি।
● ক্ষত্রিয় - মানুষের সুরক্ষা ও পরিতুষ্টি, অধ্যয়ন এবং পার্থিব ভোগ বিলাস।
● বৈশ্য - ব্যবসা ও গবাদি পশু রক্ষণাবেক্ষণ, অধ্যয়ন, দান, ঋণ প্রদান ও কৃষিকাজ।
● শূদ্র - কামনা বাসনা বর্জিত হয়ে নিষ্ঠাসহ উপরের তিন বর্ণের সেবা করা।
এই চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার কোনরকম অবাধ্যতা গুরুতর সামাজিক অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য। মনুর মত অনুসারে, ঈশ্বর শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাস হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। দাসত্ব তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। সেইজন্য দাস কখনও স্বাধীন জীবন অর্জন করতে পারে না। সুযোগ থাকলেও শূদ্র কোনদিন ধনবান হতে পারে না। ধনবান শূদ্র ব্রাহ্মণের দুঃখের কারণ।
● প্রসঙ্গত, গৌতম স্মৃতির উল্লেখ করা প্রয়োজন। যিনি গৌতম স্মৃতি রচনা করেছেন তাঁরই রচনা ন্যায় সূত্র (যাকে অক্ষপদও বলা হয়), এবং ধর্মসূত্র। নিজের যুগে গৌতম ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ও দার্শনিক। গৌতম স্মৃতির বক্তব্য হলো - শূদ্রের বৈশিষ্ট্য হবে সততা, শালীনতা ও পবিত্রতা। উচ্চবর্ণের সেবা করেই তার জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।
● মনুস্মৃতির বক্তব্য, উচ্চবর্ণের ব্যবহৃত জুতো-ছাতা-পোশাকই নয়, উচ্চবর্ণের উচ্ছিষ্ট খেয়েই তাকে বাঁচতে হবে। শূদ্রের কানে বেদমন্ত্র গেলে গলন্ত সীসা ঢালতে হবে? বেদ পাঠ করলে জিভ কেটে ফেলতে হবে। ব্রাহ্মণের ছায়া স্পর্শ করলে শূদ্রের কঠোর শাস্তি পেতে হবে।
● মনুর মতে প্রদত্ত ঋণের সুদ সংগ্রহ নিচু বর্ণের বেশি হারে ও উঁচু বর্ণের কম হারে করা উচিত। অন্যায়ের শাস্তিদান বিষয়ে সমান অপরাধে উচ্চবর্ণের লঘু ও শূদ্রদের গুরুতর শাস্তিদানের বিধান দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণ সব বর্ণের মহিলাদের বিবাহ করতে পারে, কিন্তু নিচু বর্ণের মানুষ তার স্বগোত্র বা তার নিচু বর্ণের মহিলাদের বিবাহ করতে পারে। উচ্চবর্ণের পুরুষ নিম্নবর্ণে বিয়ে করলে সন্তানের উত্তরাধিকারের অধিকার থাকবে না। মনু ঘোষণা করেছিলেন, নারী শুধু সন্তানধারণ করবে, তাদের কোনো স্বাধীন সত্তা থাকবে না। নারী শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও বার্ধক্যে পুত্রের সম্পত্তি। নারী কখনও আত্মনির্ভর হবে না।
বিশেষকরে নজর দেওয়ার মতো বিষয় হলো, ভারতের গৃহীত আইন ও সংবিধান অনুসারে যা নিষিদ্ধ, অথচ যার কথা মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে - এমন বহু নির্দেশ আজও আমাদের সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। মনুস্মৃতির নানা ধরনের বিধিনিষেধ আজও মেহনতি মানুষের পরাধীনতার কারণ। শৃঙ্খলিত এই মানুষের মুক্তি আমাদের সামাজিক ও মতাদর্শগত দায়িত্ব।
মনুস্মৃতিতে যেভাবে ভারতীয় সমাজের পশ্চাদপদতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তার ফলে এই মনুস্মৃতির বিরোধিতা ব্যাপক রূপে আমাদের দেশে দেখা গেছে। বর্তমান ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যারা কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারকে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা করছে, তারা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও তৎপরতার সাথে ‘মনুস্মৃতি’-কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসতে চাইছে।
‘মনুস্মৃতি’র আলোচনায় একথা বিশেষকরে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পৃথিবীতে যতগুলো কথিত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার মধ্যে মনে হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ বা ‘মনুসংহিতা’। মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই মনুসংহিতা।
পুরাণ (মহাকাব্য)
পুরাণ কথার অর্থ - প্রাচীনকালে বহু বিষয়ে রচিত সাহিত্য কর্ম। পৌরাণিক কাহিনি পুরাণের অন্তর্গত। ১৮টি পুরাণ। মহাপুরাণও বলে। বিষ্ণু পুরাণ, নারদীয় পুরাণ, পদ্মপুরাণ, গরুড় পুরাণ, বরাহ পুরাণ, ভাগবৎ পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, কুর্মা পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ, শিব পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, ব্রহ্মবৈভর্ত্য পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, বামন পুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ। ১৮টি পুরাণ ছাড়াও ১৮টি উপ-পুরাণও রয়েছে।
● জনমনে পুরাণ বা মহাকাব্যের প্রভাব অপরিসীম। বেদ, ধর্মসূত্র বা উপনিষদ অভিজাত ও উচ্চ সম্প্রদায়ের জন্য, অন্যদিকে পৌরাণিক কাহিনি সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে। কয়েক হাজার বছর ধরে শূদ্রদের জ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ ছিল। পৌরাণিক কাহিনি প্রচারের মাধ্যমে শাসকশ্রেণি শাসিতদের অধীনে রাখার কাজটি চালিয়ে গেছে। পৌরাণিক কাহিনি মানে কাল্পনিক এক সুদীর্ঘ কাহিনি নির্মাণ যা দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচার করা যায়।
● লক্ষণীয় যে, পৌরাণিক দেবতা যেমন বিষ্ণু, লক্ষ্মী, সরস্বতী বা শিব বেদ বা উপনিষদে অনুপস্থিত। যজ্ঞ বা হোমে এই দেবতাদের নামে কোনো উৎসর্গ নেই। স্বভাবতই বিষ্ণুর অবতার রাম বা কৃষ্ণের খোঁজ বেদ, উপনিষদে মিলবে না। পুরাণের ভাষাও বৈদিক ভাষার চেয়ে তুলনামূলকভাবে আধুনিক। অনেক ঐতিহাসিকস্থানে খনন ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, পৌরাণিক কাহিনির কোনো সত্যতা নেই। বরং, বলা যেতেই পারে যে, পৌরাণিক কাহিনি স্থানীয় জনপ্রিয় গল্পের অতিরঞ্জিত সংস্করণ। পুরাণ নামটির মধ্যেই পৌরাণিক কাহিনির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
● একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, পুরাণ জনমনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দুর্বলের রক্ষা ও ত্রাণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং নৈতিক মূল্যবোধগুলি তুলে ধরতে ঈশ্বরের মর্ত্যে আগমন জনমনে নাটকীয় প্রভাব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, তা স্বীকার করতেই হবে।
(ক্রমশ)