E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭

২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করতে কলকাতায় শ্রমিক কনভেনশন


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের সংগঠিত হবার অধিকার। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ধর্মঘটের অধিকার। সঙ্কুচিত করা হচ্ছে কৃষকের অধিকার। ছাত্রের শিক্ষার অধিকার। আক্রমণ সর্বস্তরে। প্রতিবাদের সব পথ রুদ্ধ করার চেষ্টার পাশাপাশি দেশপ্রেমের বাগাড়ম্বর করে দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের কাছে দেশকে বিক্রি করে দেওয়ার আগ্রাসী পথে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন মোদী সরকার। তাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিকার বজায় রাখতে পাল্টা আঘাত হানতে জোটবদ্ধ শ্রমিকরা। জোটবদ্ধ প্রকৃত দেশপ্রেমিক শক্তি। এই প্রেক্ষিতেই আগামী ২৬ নভেম্বর দেশজুড়ে ডাকা ধর্মঘটকে সফল করতে ও তাতে শামিল হতে রাজ্যের সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে আহ্বান জানালো ১২ অক্টোবর কলকাতার শ্রমিক ভবনে অনুষ্ঠিত শ্রমিক কনভেনশন থেকে।

সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ এবং শিল্পভিত্তিক ফেডারেশনসহ অন্যান্য ইউনিয়নের ২ অক্টোবরের অনলাইন কনভেনশন থেকে সাতদফা নির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে ডাকা ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে এই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশন থেকে শ্রমিক কৃষক ও সাধারণ মানুষের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকারসমূহের ওপর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভয়ঙ্কর আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশবাসীকে ধর্মঘটে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। রাজ্য সরকার বাধা দিতে এলে ছেড়ে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন কনভেনশনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ।

শ্রমিক কনভেনশনে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর স্মরণে পুস্তক প্রকাশ করছেন বিমান বসু।

এদিনের কনভেনশন থেকে প্রয়াত শ্রমিক নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর স্মরণে একটি বই প্রকাশ করেন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসু।

কলকাতার এই কেন্দ্রীয় কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রাজ্যের আরও দু’টি জায়গায় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। ১৬ অক্টোবর উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে এবং ২০ অক্টোবর দক্ষিণবঙ্গের আসানসোলে। চলতি অক্টোবর মাসের মধ্যেই সারা রাজ্যের প্রতিটি জেলায় জেলাগতভাবে সব কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন কৃষক সভা ও খেতমজুর ইউনিয়নকে নিয়ে যৌথ কনভেনশন অনুষ্ঠিত করতে হবে।

কনভেনশন থেকে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, শিল্পক্ষেত্রে এবং প্রতিটি কাজের জায়গায় শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে অথবা যেখানে তা সম্ভব নয়, সেখানে অনলাইনে সবাইকে যুক্ত করে কনভেনশন করতে হবে।

কৃষক সংগঠন, খেতমজুর, ছাত্র-যুব ও মহিলাদের সংগঠনসহ সব অংশের মানুষকে এই ধর্মঘটের প্রতি সার্বিক সমর্থন জানানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের ওপর সরকারের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শ্রম কোডগুলির প্রতিকূলতা ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করতে হবে প্রতিটি সদস্যকে।

রাজ্যে উৎসব চললেও তার মধ্যে থেকেই প্রচারের সুযোগ খুঁজে নিতে হবে। ১ নভেম্বর থেকেই সর্বত্র নিবিড় প্রচার শুরু করতে হবে। আগামীদিনের আরও তীব্র আরও কঠিন দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে ২৬ নভেম্বরের সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট সফল করে তুলতে।

সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে যারা অন্য কোনো অনুমোদিত ইউনিয়নে বা সংগঠনে সঙ্ঘবদ্ধ অথবা যারা কোনো সংগঠনের আওতাভুক্ত নন তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের যাবতীয় জনবিরোধী শ্রমিকবিরোধী কৃষকবিরোধী এবং দেশবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশব্যাপী এই সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে হবে।

এদিনের রাজ্য কনভেনশনের প্রস্তাব পেশ করে সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু বলেন, অর্জিত অধিকার রক্ষার দাবিতে শ্রমিকরা এই ধর্মঘটে শামিল হবেন। তিনি বলেন, করোনা মহামারী মোকাবিলায় কেন্দ্র সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি করা, রাজ্য সরকারগুলির পাশে দাঁড়ানো, জনগণকে আর্থিক সহায়তা করা কোনও কিছুই এই সরকার করেনি। চলতি আর্থিক বছরে দেশের জিডিপি ২৪ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। অন্য দেশগুলি মহামারী মোকাবিলায় দেশের জিডিপি’র বড় অংশ খরচ করেছে আর্থিক প্যাকেজ হিসাবে। অথচ আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত সরকার উদাসীন। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অমানবিক অপরাধ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

তিনি বলেন, সঙ্ঘ পরিবারের পিছিয়ে থাকা অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শের নিরিখে সরকার চলেছে। মোদী করোনা মোকাবিলায় ঘণ্টা বাজানো, থালা বাজানো, আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর নিদান দিচ্ছেন, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি মাথা তুলছে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাঁচাতে যে মানুষ লড়ছে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ধর্মঘটে সমস্ত অংশের মানুষকে শামিল করে পালটা প্রত্যাঘাত হানতে হবে। পরাজিত করতে হবে এই শক্তিকে।

রাজ্য সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সার্বিক জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ধর্মঘট, কিন্তু এরাজ্যের তৃণমূল সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ভাঙতে যদি পুলিশ নামিয়ে ধর্মঘট ভাঙার চেষ্টা করে। শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে এর মোকাবিলা করবেন।

এদিনের কনভেনশনে প্রস্তাবের সমর্থনে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, আইএনটিইউসি’র পক্ষে কামারুজ্জামান কামার, এআইটিইউসি’র পক্ষে উজ্জ্বল চৌধুরি, টিউসিসি’র পক্ষে প্রবীর ব্যানার্জি, ইউটিইউসি’র পক্ষে দীপক সাহা, এআইসিসিটিইউ’র পক্ষে সৌরভ রায়চৌধুরি, এআইইউটিইউসি’র পক্ষে অশোক দাস, এইচএমএস’র পক্ষে বিসি পাল রায়, বিএসএনএল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের পক্ষে অনিমেষ মিত্র, বেফি’র পক্ষে অতনু দাশগুপ্ত, ইআরএমইউ’র পক্ষে অশোক গুহ, ১২ জুলাই কমিটির পক্ষে জনার্দন মজুমদার।

এদিন কনভেনশনের মঞ্চ থেকে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর স্মরণে সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির মুখপত্র শ্রমিক আন্দোলন পত্রিকার পক্ষ থেকে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে। ‘স্মরণে শ্যামল’ নামের এই বইটি এদিন কনভেনশন মঞ্চ থেকেই প্রকাশ করেন বিমান বসু। ৬ আগস্ট প্রয়াত শ্যামল চক্রবর্তী সম্পর্কে বিমান বসু বলেন, শ্যামল চক্রবর্তী শ্রমিক ঐক্যে বিশ্বাস করতেন। তিনি ১১৬টি গণসংগঠনকে নিয়ে বিপিএমও গঠন করেছিলেন আন্দোলনের মোহনা তৈরি করে গণআন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হলে আমাদেরও ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।

আগামী ২৬ নভেম্বর শ্রমিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে দেশ জুড়ে ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের প্রসঙ্গে বিমান বসু বলেন, শ্রমিকশ্রেণির বাঁচার স্বার্থে,দেশের স্বার্থে ডাকা ২৬ নভেম্বরের দেশজোড়া ধর্মঘটে বাধা এলে তার মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে আপনারা কোনো দুর্বলতা দেখাবেন না। প্রতিরোধের জন্য শ্রমিকদের কাছে আহ্বান জানিয়ে আন্দোলন এবং ধর্মঘট প্রসঙ্গে রাজ্যসরকারের বিরোধিতার বিষয়ে বিমান বসু বলেন, কারো কারো ধারণা আছে এ রাজ্যের তৃণমূলের অপশাসন থেকে মুক্তির জন্য বিজেপি’কে সাহায্য করা দরকার। আবার কারো কারো ধারণা আছে বিজেপি’কে রক্ষার জন্য তৃণমূলকে সাহায্য করা দরকার। দু’টোই সর্বনাশা ধারণা। এই ভ্রান্ত ধারণার শিকার কেউ হবেন না। এই দু’টো দলই জনবিরোধী এবং ওরা পরস্পরের সহযোগী। তাই উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

কনভেনশনে সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষ থেকে সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি সুভাষ মুখার্জি আহ্বান জানান, ধর্মঘট সফল করতে হবে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করতে হবে, ধর্মঘটেই বুঝিয়ে দিতে হবে দুই সরকারকে দেশ বিরোধী নীতি জনগণ মেনে নেবেন না। এরাজ্যের সরকার যদি পুলিশ নামিয়ে, ভাড়াটে দুষ্কৃতী বাহিনী নামিয়ে ধর্মঘট ভাঙতে চায় তাহলে রাস্তায় থেকে তার মোকাবিলা করেই ধর্মঘট সফল করতে হবে।

দাবিসমূহঃ

১) আয়করের আওতা বহির্ভূত প্রতিটি পরিবারকে জনপ্রতি প্রতি মাসে নগদ ৭,৫০০ হাজার টাকা দিতে হবে।
২) প্রতিটি অভাবগ্রস্ত পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য মাসে ১০ কেজি রেশন বিনামূল্যে দিতে হবে।
৩) এমজিএনরেগা প্রকল্পের পরিসর বৃদ্ধি করে গ্রামীণ এলাকায় বছরে ২০০ দিনের কাজ দিতে হবে। শহর এলাকায় কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৪) সমস্ত কৃষকবিরোধী আইন এবং শ্রমিকবিরোধী সকল কোড সমূহ বাতিল করতে হবে।
৫) রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্র সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি বেসরকারিকরণ করা বন্ধ করতে হবে এবং সরকারি উৎপাদন কেন্দ্রগুলি, যেমন রেলওয়ে, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি এবং বন্দর ইত্যাদি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
৬) সরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলির কর্মীদের চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগেই তাদের অবসর নিতে বাধ্য করার দানবীয় আইন বাতিল করতে হবে।
৭) সকলের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে, এনপিএস (ন্যাশনাল পেনশন স্কিম) বাতিল করে পুরনো পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ইপিএস (৯৫ এমপ্লয়িজ পেনশন স্কিম ১৯৯৫)-কে উন্নত করতে হবে।