E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭

কেন্দ্র-রাজ্যের জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাজ্যজুড়ে বামপন্থীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ


মেদিনীপুর শহরে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের সুবিশাল যৌথ মিছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ রুখতে জীবন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পাশাপাশি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মানুষমারা নীতির বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধের লড়াইয়ে শামিল রয়েছেন বামপন্থীরা। পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়া, পূর্ব বর্ধমানের রায়না থেকে মালদহের সামসি, হরিশ্চন্দ্রপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থেকে বারাসত, শিলিগুড়ি থেকে ঝাড়গ্রাম - সর্বত্র সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টের উদ্যোগে বিশাল বিশাল মিছিলে এখন উত্তাল রাজ্য। একইসঙ্গে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, গঙ্গারামপুর প্রভৃতি জায়গায় সিপিআই(এম)’র কর্মীসভাগুলিতেও প্রতিবাদের বার্তা ধ্বনিত হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রতিবাদী মিছিল, সভা-সমাবেশের পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান-বিক্ষোভ, অবরোধ ইত্যাদি নানা কর্মসূচিতে লালপতাকার প্লাবনে মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দৃপ্ত রূপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।

এই সমস্ত কর্মসূচিতে কেন্দ্রের নতুন কৃষি আইন, বেসরকারিকরণের উদ্যোগ, শ্রমিকবিরোধী আইন, নতুন শিক্ষা নীতি এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। একইসঙ্গে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শাসকদলের দুর্বৃত্তদের দ্বারা একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং এই জঘন্য কার্যকলাপকে আড়াল করতে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের মরিয়া চেষ্টা; এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন থেকে ভীমা কোরেগাঁও কাণ্ডে প্রতিবাদী সমাজকর্মীদের গ্রেপ্তার ও কড়া আইনের ধারা প্রয়োগ করার বিরুদ্ধেও বামপন্থীদের প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলি থেকে আওয়াজ উঠেছে।

বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ মারণ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিনা চিকিৎসার মৃত্যুর ঘটনা, এমনকি চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্য কর্মীদেরও উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এই ভয়াবহতার আবহে চিকিৎসামহল থেকে বিশেষজ্ঞ সমস্ত স্তর থেকে যখন বিপদের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কায় সরকার, প্রশাসন এমনকি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আরজি জানানো হচ্ছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত পুজো উদ্বোধনে। এদিকে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার গরিব সাধারণ মানুষ। লকডাউনের জেরে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের দূর্বিষহ অবস্থা, অসংখ্য মানুষ এখন রুজি-রোজগারহীন হয়ে বিপন্ন দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। গরিব-প্রান্তিক মানুষের দু’বেলা খাবারটুকুও জুটছে না। অথচ তৃণমূলের বিভিন্ন অঞ্চলের মাতব্বররা গরিব মানুষের প্রাপ্য রেশনের চাল, ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিপন্ন, অসহায়, অভুক্ত মানুষদের কথা ভাবার সময় নেই; আগামী বিধানসভা ভোটের কথা ভেবে তিনি মগ্ন নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায়। তিনি প্রতিটি পুজো কমিটিকে ৫০ হাজার টাকার অনুদান, পুরোহিত ভাতার ঘোষণা করেছেন, আগের মতো জেলায় জেলায় ঘুরে বিপুল অর্থ খরচ করে প্রশাসনিক বৈঠকের নামে ‘উন্নয়ন’-এর বার্তা আর প্রতিশ্রুতি বিলি করতে শুরু করেছেন।

জামুড়িয়ায় বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের মিছিলে জনপ্লাবন।

এদিকে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, বিজেপি’র সঙ্গে এলাকা দখলের লড়াইয়ের পরিণতিতে সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এ রাজ্যে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা যেন উত্তপ্রদেশকেও পাল্লা দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত শাসকদলের, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। উলটে গোটা ঘটনা ও অপরাধীদের আড়ালের চেষ্টা চলছে অবিরত। অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী, শাক-সবজি থেকে বাসভাড়া ক্রমশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলেও কোনো হেলদোল নেই রাজ্য সরকারের।

এমনই একটি অবস্থায় বিজেপি’র মতো একটি সাম্প্রদায়িক দল ঘোলাজলে মাছ ধরতে উদ্যত হচ্ছে। ওদেরও লক্ষ্য রাজ্যের শাসন-ক্ষমতা দখল করা।

এই পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনজীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য এবং রাজ্যের শান্তি-সুস্থিতি বজায় রাখার পাশাপাশি তৃণমূল-বিজেপি’র মতো জনস্বার্থবিরোধী দলকে প্রতিহত করতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়ে চলছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে লাল ঝান্ডার মিছিল, সমাবেশ। কোথাও কোথাও বামপন্থীদের সঙ্গে যৌথ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শামিল হচ্ছে কংগ্রেসও।

এই সমস্ত ইস্যু নিয়েই ১৪ অক্টোবর মেদিনীপুর শহরে বামফ্রন্ট ও সহযোগী দল এবং কংগ্রেসের ডাকা মহামিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। গ্রামগঞ্জ, শহরের অগণিত মানুষ, ছাত্র, যুব, শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণে স্থানীয় কলেজ ময়দানে জনপ্লাবন তৈরি হয়। এই মিছিলে অংশ নেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, জেলা সম্পাদক তরুণ রায়, কংগ্রেস নেতা সমীর রায় সহ সন্তোষ রানা, শক্তি ভট্টাচার্য, সুকুমার সিং, শৈলেন মাইতি প্রমুখ। মিছিলের সূচনায় সূর্য মিশ্র বলেছেন, তৃণমূল এবং বিজেপি দু’টোই মহামারীর মতো বিপদ। কেন্দ্র ও রাজ্যের এই দুই শাসকদলকে জনবিচ্ছিন্ন করার লড়াই এবার পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে পড়বে। মানুষ বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প দেখতে পাচ্ছেন। এদিন এই মিছিল দীর্ঘ চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে।

১২ অক্টোবর মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে সিপিআই(এম)’র ডাকে সুদীর্ঘ মিছিল।

এর আগে ১২ অক্টোবর মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর ও সামসিতে সিপিআই(এম)’র ডাকে দু’টি মহামিছিলে জনপ্লাবন তৈরি হয়। এদিন সকালে সামসিতে মহামিছিল শেষে রেগুলেটেড মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় বিশাল সমাবেশ হয়েছে। রতুয়া ১/১ ও ১/২, রতুয়া ২ ও মালতীপুর এরিয়া কমিটির ডাকে এই ‍‌মিছিল ও সমাবেশে লালঝান্ডা নিয়ে যোগদেন হাজার হাজার যুবক-যুবতী ও সাধারণ মানুষ। বিকালে হরিশ্চন্দ্রপুরে আরেকটি মহামিছিল শেষে স্থানীয় ভজমোহন প্রাইমারি স্কুলের পাশে বিশাল সমাবেশ হয়েছে। সিপিআই(এম)’র হরিশ্চন্দ্রপুর উত্তর, মধ্য, পূর্ব ও পশ্চিম এরিয়া কমিটির ডাকে এই মিছিল ও সমাবেশেও জনজোয়ার সৃষ্টি হয়। এই দু’টি সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। এই সভা দু’টিতেই মহম্মদ সেলিম বিজেপি-তৃণমূল যে ফারাকহীন তা উল্লেখ করে বলেন, ওরা চেষ্টা করছে নিজেদের পরস্পরের বিকল্প বলে দেখাতে। মানুষকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছে। আসলে এই দু’টি দলই শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী, কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষাকারী। শ্রমজীবী মানুষের পাশে রয়েছেন বামপন্থীরা। এছাড়াও হ‍‌রিশ্চন্দ্রপুরের সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির মালদহ জেলা কমিটির সম্পাদক অম্বর মিত্র, রাজ্য কমিটির সদস্য জামিল ফিরদৌস, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বিশ্বনাথ ঘোষ ও আরজাউল হক। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ পার্টি নেতা মনসুর রহমান। সামসির সভায় সভাপতিত্ব করেন অম্বর মিত্র।

১৩ অক্টোবর কালিয়াচকের ৩নং ব্লকের অন্তর্গত গঙ্গার ভাঙনকবলিত বিননগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা পরিদর্শন করেন মহম্মদ সেলিম সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ। এরপর দুপুরে বৈষ্ণবনগরের গোপালগঞ্জে এক বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন মহম্মদ সেলিম, অম্বর মিত্র, জামিল ফিরদৌস,আবুল হাসনাত খান, বিশ্বনাথ ঘোষ, মো‌য়াজ্জেম হোসেন, সুফল মণ্ডল প্রমুখ। এছাড়াও এদিন সন্ধ্যায় ইংরেজবাজারেও একটি সমাবেশ হয়েছে।

এদিকে ১১ অক্টোবর পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়া ও রূপনারায়ণপুর মহামিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে। এদিন সকালে জামুড়িয়ায় ‍‌মিছিলে ছিলেন কোলিয়ারি শ্রমিক, শিল্পতালুকের শ্রমিক, গ্রামের কৃষক, খেতমজুর, কাজ হারানো শ্রমিক, জবকার্ড-রেশনহীন-অন্ন সংস্থানহীন বিপন্ন মানুষ।

দামোদরপুর সিপিআই(এম) দপ্তর সংলগ্ন প্রান্তর থেকে শুরু হওয়া মিছিলে অংশ নেন সিপিআই(এম) নেতা বিবেক চৌধুরী, গোরাঙ্গ চ্যাটার্জি, মনোজ দত্ত সহ গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ‍‌মিছিল শেষে থানা মোড়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

রূপনারায়ণপুরে পার্টি দপ্তরের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়ে শেষ হয় ডাবর মোড়ে। ডাবর মোড়ে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্টিনেতা পার্থ মুখার্জি, সিপিআই নেতা নিমাই বাজপেয়ী, সিপিআই(এম) লিবারেশন নেতা প্রদীপ ব্যানার্জি প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন অশোক ব্যানার্জি।

১২ অক্টোবর তৃণমূলের দুর্নীতি, স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে এবং আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে প‍‌শ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর ২ ব্লকে দু’ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ ৮ কিলোমিটার পথে মিছিল সংগঠিত হয়। গোরাবাজার থেকে শুরু হয়ে এই মিছিল শেষ হয় খুকুরদহ বাজারে। চলার পথে ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে মিছিল। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে গ্রামাঞ্চল। মিছিলের সূচনায় বক্তব্য রাখেন পার্টিনেতা সুনীল অধিকারী। উপস্থিত ছিলেন শান্তনু চক্রবর্তী, রণজিৎ পাল, অজিত বড়াই প্রমুখ।

১৪ অক্টোবর আসানসোল ও রানিগঞ্জে বামপন্থী ও সহযোগী দল এবং কংগ্রেসের ডাকে দু’টি মহামিছিলে অংশ নেন অগণিত মানুষ।

এই কর্মসূচিগুলির পাশাপাশি শালবনী থানার সামনে, হাওড়া ও হুগলির বিভিন্ন স্থানে, কাঁচরাপাড়া পৌরসভার সামনে তৃণমূলের দুর্নীতি-স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে এবং ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান বিক্ষোভ হয়েছে। এছাড়া শিলিগুড়ি, ঝাড়গ্রাম, ডেবরা, হাবড়া, হরিপাল, সন্দেশখালি, তমলুকের মানিকতলা প্রভৃতি স্থানে মিছিল সংগঠিত হয়েছে।