৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ স্মরণে
কমিউনিস্টরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে বলিষ্ঠতার সাথে রক্ষা করছে
সীতারাম ইয়েচুরি
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে আমরা পৌঁছে গিয়েছি। করোনা অতিমারীর প্রকোপ, দীর্ঘসময় ধরে দেশজুড়ে লকডাউন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিভিন্ন বিধিনিষেধ ইত্যাদি কারণে এই শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠান যথাযথভাবে করার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটেছে। এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ডিজিটাল প্লাটফর্মকে ব্যবহার করে আমাদের পার্টি বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছে, যেখানে গত ১০০ বছরে দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়েছে।
জাতীয়স্তরে আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা
আমরা দেখেছি যে, স্বাধীনতার আগে কমিউনিস্টরা কিভাবে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন এবং অসংখ্য বিপ্লবীর আত্মত্যাগ ও মৃত্যুবরণের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ইতিহাস বিবর্তিত হয়েছে। পরবর্তীকালেও এই ধরনের নানা উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। এছাড়া জনসাধারণের জীবনের প্রকৃত সমস্যাগুলিকে জাতীয়পর্যায়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই বিষয়গুলির মধ্যে ভারতের বৈচিত্র্যকে স্বীকার করা এবং তারই সূত্র ধরে দেশের বিভিন্ন ভাষার সমমর্যাদাদানের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে দেশে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আন্দোলন শুরু হলে সেক্ষেত্রেও কমিউনিস্টরা অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে যে জমির লড়াই হয়েছে তা ভূমিসংস্কারকে আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ের ইস্যুতে পরিণত করে। এছাড়া সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভারতের কমিউনিস্টদের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির ক্রমাগত সংঘাতের মধ্যে থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতের ধারণার জন্ম হয়েছে।
মূলধারার কংগ্রেসের ভাবনা ছিল এই যে, ভারতের স্বাধীনতার পর দেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক। কমিউনিস্টরা এই ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আরও বলে যে, দেশ যদি পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয় তাহলে এই ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বজায় রাখা যাবে না। অর্থাৎ কমিউনিস্টরা ভেবেছিল যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করবার পর প্রত্যেক ভারতীয়কে আর্থ-সামাজিকভাবে স্বাধীন হতে হবে যা কিনা একমাত্র সমাজতন্ত্রেই সম্ভব। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন তারা, যারা মনে করেছিলেন যে, ভারত স্বাধীন হলে তার চরিত্র নির্ধারিত হবে নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচিতির নিরিখে। এই দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুসলিম লিগের ইসলামিক রাষ্ট্র এবং আরএসএস’র হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে। দেশভাগের ফলে প্রথমোক্ত দাবি উত্থাপনকারীরা সফল হয়েছিল। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পেছনে ব্রিটিশ শাসকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মদত ছিল এবং এর পরিণতিস্বরূপ যা যা ঘটেছে তা এখনও পর্যন্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে চলেছে। অন্যদিকে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি যারা করেছিল তারা স্বাধীনতার সময়ে সফল না হওয়ায় পরবর্তীকালে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে তীব্র অসহিষ্ণু, ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করবার জন্য যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। একথা স্পষ্ট যে, আমাদের দেশের বর্তমান মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যে এই তিনটি দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাতেরই ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র
কমিউনিস্টরা বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতের যে ধারণা পোষণ করেন তার মূলে এই ভাবনার স্বীকৃতি রয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র বিচ্ছিন্ন এবং স্বতন্ত্র কোনো বৈশিষ্ট্য নয়, বরং ভারতের বাস্তবতা অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। বৈচিত্র্যময় ভারতের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা করা ও সমান অধিকার দেওয়া, বিশেষত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। একইভাবে গণতান্ত্রিক এবং নাগরিক অধিকার ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা স্থায়ী হতে পারেনা। বস্তুত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাম্যের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা একটি প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া রূপায়িত হতে পারেনা। কমিউনিস্টরা অতীতে যেমন, বর্তমানেও তেমনি এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এসেছে।
১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর মানবেন্দ্রনাথ রায় সেই সময়ে যে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হচ্ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে এই বক্তব্য রাখেন যে, সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে বড়ো প্রতিষেধক জাত ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য। গত ১০০ বছর ধরে কমিউনিস্টরা শ্রমজীবী মানুষের এই ঐক্য গড়ে তোলার কাজ করে চলেছেন। ১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিটি অধিবেশনে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে একটি ইশ্তিহার প্রকাশ করে জানানো হতো যে, জাতীয় পর্যায়ে কি ধরনের ইস্যুতে আন্দোলন করা উচিত বলে তারা মনে করেন (গয়া, আমেদাবাদ সহ কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে কমিউনিস্টরা অংশগ্রহণ করেছেন)। এই সমস্ত অধিবেশনের মধ্যে ১৯২৬ সালে গুয়াহাটি অধিবেশনে বিশেষভাবে সেই সময়ে ঘটমান ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি তার ইশ্তিহারে বক্তব্য পেশ করে। শ্রমজীবীদের ঐক্য নিশ্চিত করবার জন্য কংগ্রেসের সেই অধিবেশনে আহ্বান জানিয়ে কমিউনিস্টরা বলেনঃ
গত কয়েক বছরে আমাদের দেশ যেভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়েছে তারফলে অনেকেই ভীষণভাবে মর্মাহত হয়েছেন। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু এখানেও জনগণের পার্টি একটি সমাধান সূত্র বার করেছে। উচ্চশ্রেণির লোকেরা যখন তাদের অধিকার ও সুযোগসুবিধা নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে তখন দুই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের মধ্যে একটি জায়গায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে। তা হলো শোষণ। হিন্দু ও মুসলমান শ্রমিকরা একই কারখানায় নিজেদের ঘাম ঝরায়।হিন্দু-মুসলমান চাষি একই জমিতে কাজ করে এবং একইভাবে জমিদার, মহাজন ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের হাতে শোষিত হয়। একজন মুসলিম শ্রমিককে একজন মুসলিম মালিক বেশি মজুরি দেন না। একইভাবে একজন হিন্দু জমিদার তার হিন্দুপ্রজাদের কাছ থেকে মুসলমান প্রজাদের তুলনায় কম খাজনা নেননা। এই একই নিয়ম শোষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির (অর্থাৎ ছোটোখাটো বুদ্ধিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কারিগর প্রমুখ) ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময়ই খাটে। সমাজের ৯৮ শতাংশ মানুষ যারা এভাবে শোষণের বন্ধনে আবদ্ধ তাদের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এই অংশের মানুষকে অর্থনৈতিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করুন, এদের সকলের সাধারণ শত্রু শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে সাহসী নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করুন,তা’হলেই দেখবেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর কূটকৌশল ব্যর্থ করা যাবে। কিন্তু এটা আমরা সকলেই জানি, এই কাজ রাতারাতি হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ জাতীয় আন্দোলনকে ক্যান্সারের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে প্রতিহত করতে গেলে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
ধর্মনিরপেক্ষতা
কমিউনিস্টদের নীতিগত অবস্থান এই যে, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ। অর্থাৎ রাষ্ট্র যেমন একদিকে ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাসকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে অবিচল থাকবে তেমনি কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করবে না। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার পর কার্যক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞাকে সংকুচিত করে একে সবধর্মের সমতা বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি পক্ষপাতের মনোভাব নিহিত আছে। ভারতের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলিকে উৎসাহ জুগিয়েছে এই নীতি।
তাই কমিউনিস্টদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে রক্ষা করা কেবলমাত্র ভারতের অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদকে রক্ষা করা এবং সেই সূত্রে দেশের সংবিধানকে কেবল রক্ষা করা নয়, কেবলমাত্র সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা এবং সাংবিধানিকভাবে তাদের প্রাপ্য সমতার অধিকার যা কিনা গণতন্ত্রের নির্যাস তা নিশ্চিত করা নয়, তাদের কাছে এর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব এখানেই যে - ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি শোষিত মানুষের ঐক্য শক্তিশালী করে যা কিনা ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। সাম্প্রদায়িকতা এই ঐক্যকে বিনষ্ট করছে এবং ভারতের ইতিহাসকে পশ্চাৎপদতা ও প্রগতিবিরোধী পথে পরিচালিত করতে চাইছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম
আরএসএস এবং বিজেপি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের উপর যে আঘাত হানছে সে সম্পর্কে সিপিআই(এম)’র ২০০০সালের পার্টি কর্মসূচিতে বলা হয়েছেঃ ‘‘সাম্প্রদায়িক এবং ফ্যাসিবাদী আরএসএসে’র নেতৃত্বাধীন জোট কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের সাম্প্রদায়িকীকরণের সুপরিকল্পিত প্রয়াস চলছে’’ (৫.৭ অনুচ্ছেদ)। এরপর পার্টি কর্মসূচিতে এ প্রসঙ্গে পার্টির দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ ‘‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তির ওপর ফ্যাসিবাদী প্রবণতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাকে সর্বস্তরে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে হবে’’ (৫.৮ অনুচ্ছেদ)। বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে দেশের সাংবিধানিক কাঠামো যে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয় তাকে উল্লেখ করে পার্টি কর্মসূচিতে বলা হয়েছেঃ ‘‘ভারতীয় জনতা পার্টি এক প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল যা বিভেদকামী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সম্মিলন মঞ্চ, অন্যধর্মের প্রতি ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব যার প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের ভিত্তি। বিজেপি কোনো সাধারণ বুর্জোয়া পার্টি নয় কেননা তা ফ্যাসিবাদী আরএসএস দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।বিজেপি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন আরএসএস রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রবেশাধিকার পায়। হিন্দুত্বের মতাদর্শ হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুনরুত্থানবাদকে উৎসাহিত করে এবং ভারতের সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে’’ (৭.১৪ অনুচ্ছেদ)।
কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক জোট
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে বলেছিল যে, ভারতে কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তি জোটবদ্ধ হয়েছে এবং তারা সাম্রাজ্যবাদের অনুগত সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। পরবর্তী ঘটনাক্রম এই বিশ্লেষণের যথার্থতা প্রমাণ করে যা কিনা কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছে।
পলিট ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্টে এ কথা বারে বারে উল্লেখিত হয়েছে যে, করোনা অতিমারীর সময়ে নানারকম বিধিনিষেধের সুযোগ নিয়ে আরএসএস/বিজেপি/মোদী সরকার ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোকে পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য সার্বিক আক্রমণ চালাচ্ছে। এই সময়ে অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে নয়া-উদারবাদী সংস্কার করা হচ্ছে যেমন ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ হচ্ছে, জাতীয় সম্পদের লুণ্ঠন চলছে, কৃষিকে বন্ধক রেখে নতুন কৃষিবিলগুলি চালু করা হয়েছে। এর সাথে শ্রমিকশ্রেণি, কৃষকসমাজ ও অন্যান্য মেহনতি জনগণের উপরে তীব্র আক্রমণ সংঘটিত করা হচ্ছে; তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজ চলছে এবং মুসলিমদের আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে; প্রতিবাদ হলেই তাকে দেশবিরোধী বলে চিহ্নিত করে স্বৈরাচারী আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিবাদীদের ব্যাপকহারে জেলবন্দি করা হচ্ছে; গণতান্ত্রিক, মানবিক ও নাগরিক অধিকার ভীষণভাবে আক্রান্ত হচ্ছে ইত্যাদি। জনগণের ঐক্যের শক্তি দিয়ে এই আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।
এজন্য এ কথা অনুভব করা প্রয়োজন যে, নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই কোনো আলাদা বিষয় নয় বরং দেশরক্ষার জন্য এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষার জন্য ভারতীয় জনগণের যে সংযুক্ত সংগ্রাম তারই দুই অঙ্গ। আজকের প্রেক্ষাপটে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র রক্ষা করার যে লড়াই চলছে তা দেশের সংবিধান রক্ষা করা এবং সংবিধান জনগণকে যে সমস্ত অধিকার দিয়েছে সেগুলি কেবল রক্ষা করাই নয় সেগুলিকে বাস্তবায়িত করার সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গত এক বছর যাবৎ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্যাপনের যে কাজ আমরা করছি তা যেন ভারত ও তার শ্রমজীবী মানুষকে রক্ষা করার সংগ্রামকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের সংকল্পকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। ভারতকে যখন মোদী সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দাসানুদাসে পরিণত করছে তখন এই সংগ্রাম পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আমাদের বৈপ্লবিক উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে সেগুলিকে পরাস্ত করবার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করাই হচ্ছে এই সময়ের দাবি।
(ভাষান্তরঃ অর্ণব ভট্টাচার্য)