E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ স্মরণে

সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রামে কমিউনিস্টদের অবদান

বি‍‌ ভি রাঘভুলু


সেই শুরুর দিনগুলি থেকেই সামাজিক ন্যায়ের জন্য লড়াই কমিউনিস্টদের কাছে সবসময়েই বিপ্লবী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থেকেছে। নীতি এবং অনুশীলন এই উভয়ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের একশ’ বছর তারই সাক্ষ্য বহন করছে। মতাদর্শগত বিচ্যুতি, শাসকশ্রেণিসমূহের নিপীড়ন মাঝেমাঝেই কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনে তার প্রভাবও পড়েছিল; একইভাবে সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রামও বহু চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন হয়েছে। এইসব কারণ সত্ত্বেও ন্যায়সঙ্গতভাবে এটা বলাই যায় যে, সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কমিউনিস্টদের অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকাকে কখনই ছোটো করে দেখা যাবে না এবং এই সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ অন্যান্যদের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ লিখেছেনঃ ‘‘সমাজতন্ত্রী-কমিউনিস্ট আন্দোলনের শুরুর দিনগুলিতে (কেরালায়) উচ্চবর্ণীয় হিন্দু মাতব্বরদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত হিন্দু, সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টানদের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা উচ্চে তুলে ধরতে কমিউনিস্টরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ...জাত-পাত এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে জনগণের বামপন্থী অংশই দৃঢ়চেতা যোদ্ধা ছিলেন। তারাই ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অটল‍‌ সম্পদ।’’

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে জাত-বৈষম্য এবং সামাজিক নিপীড়নের প্রশ্নে চারটি মূল দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছিল। আরএসএস ছিল কট্টর সামন্তবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিনিধি। মনু ধর্মশাস্ত্রই ছিল এদের চলার দিগ্‌দর্শন। তারা মনে করত, বর্ণব্যবস্থা একটা মহৎ সামাজিক ব্যবস্থা যা ‘প্রাচীন ভারতের স্বর্ণযুগ’ থেকে চলে আসছে। এই কারণেই তারা যেকোনো ধরনের সমাজ সংস্কারমূলক সংগ্রামের বিরোধী ছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরেও, আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক শাখা প্রথমে জনসংঘ ও পরে বিজেপি, সেই একই মনুধর্ম অনুসরণ করে যাচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থে মনুধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সামাজিক-প্রযুক্তি প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে চলেছে।

গান্ধীজি, যিনি ছিলেন জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোতের নেতৃত্বে, তিনিও চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার একজন গুণমুগ্ধ ছিলেন। যদিও তিনি ছিলেন অস্পৃশ্যতা এবং অন্যান্য এই ধরনের পশ্চাদমুখী বিষয়ের বিরোধী। তিনি এর দূরীকরণে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে তাঁর গঠনমূলক কাজকর্মকে অঙ্গীভূত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। জাতপাতব্যবস্থার দূরীকরণের তীব্র বাসনা গান্ধীজির ছিল না, পরিবর্তে, তিনি চেয়েছিলেন নিম্নবর্ণের মানুষদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ করতে এবং কংগ্রেসের বোঝাপড়াকে তিনি এই অভিমুখেই চালনা করতে উদ্যোগী ছিলেন। এমনকি স্বাধীনতার পরেও এই বোঝাপড়া শাসকশ্রেণিসমূহের মধ্যে বিরাজমান। জাতপাতব্যবস্থার দূরীকরণের বদলে শুধুমাত্র সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্বের সুযোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে এই বর্ণগুলির মধ্যে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করার দিকেই তারা ব্যস্ত থেকেছে।

এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে বিপ্লবী ধারার প্রতিনিধিত্ব করতেন ডক্টর বি আর আম্বেদকর। তিনি বলেছিলেন যে, এই জাতপাতব্যবস্থার অধীনে স্বাধীনতা ও সমতা সম্ভব নয়; তাই তাঁর ঘোষিত লক্ষ্য ছিল এই জাতপাতব্যবস্থার নির্মূলীকরণ। দলিতদের উপর চালু থাকা অস্পৃশ্যতার রীতিগুলির বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর লক্ষ্য খুবই বৈপ্লবিক হওয়া সত্ত্বেও সংরক্ষণ, প্রতিনিধিত্ব এবং ধর্মীয় রূপান্তরের যে পথ তিনি নির্বাচন করেছিলেন তা জাতপাতব্যবস্থার নির্মূলীকরণের উপায় দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল। যারা এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বলে নিজেদের দাবি করেন তাদের মধ্যে অনেকেই এমনকি আম্বেদকরের এই বৈপ্লবিক ভাবনাকেও বহন করে চলেন না। শাসকশ্রেণির পার্টিগুলির প্রস্তাবিত উদারবাদী সমাধানের মধ্যেই তাঁরা নিজেদের আবদ্ধ করে রেখেছেন।

একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই, যারা তাদের লক্ষ্য হিসেবে জাতপাতব্যবস্থার দূরীকরণই শুধু ঘোষণা করেনি, একইসাথে এই লক্ষ্য অর্জন করতে সঠিক পথ দেখিয়েছে। এই একশ’ বছরে ওই লক্ষ্য অর্জনে পার্টি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি এটা অনুভব করেছিল যে, জাতপাতব্যবস্থার, বর্ণবৈষম্যের বিভিন্ন রূপের এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানোর পাশাপাশি একইসাথে আশু সুরাহার জন্য সংগ্রামও চালিয়ে যেতে হবে। পার্টি এটাও বলেছে যে, এই সংগ্রাম যা হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। এবং এই জন্যই সামন্তবাদী শোষণ ও জোতদার-উচ্চবর্ণের মানুষদের শক্তির উৎস এবং তারা যেখান থেকে শক্তি আহরণ করে সেই জমির কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে জাতপাতব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারি, এইসব লক্ষ্যকে বাস্তবে রূ‍পায়িত করতে কমিউনিস্টদের কাজ কী কঠিন।

১৯৩০ সালে তৈরি ‘ড্রাফট প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন’কে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছিলঃ ‘‘দাসত্ব, জাতপাতব্যবস্থা এবং সমস্ত ধরনের (সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি) জাতপাতগত অসমতার সম্পূর্ণ বিলোপের জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি লড়াই করবে। শ্রমজীবী অস্পৃশ্য এবং দেশের সমস্ত শোষিতের সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত সমতার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি লড়াই করবে।’’

কমিউনিস্টরা মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়। কোর্টের সামনে তাঁদের যে সাধারণ বিবৃতি ছিল তাতে তাঁরা জাতপাতব্যবস্থাকে ধিক্কার জানায়। কিভাবে জাতপাতব্যবস্থা আমাদের গ্রামগুলিতে আধিপত্য কায়েম করেছে তাও তাঁরা ব্যাখ্যা করেন। জাতপাতগত নিপীড়নের অবলুপ্তির জন্য কৃষিবিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁরা বলেছিলেন। ভগৎ সিং যিনি ইতিমধ্যেই সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন, ১৯২৯ সালে অস্পৃশ্যতা এবং জাতপাতব্যবস্থার দূরীকরণের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে একটা প্রবন্ধ লেখেন। দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনী কেন্দ্রের প্রস্তাবকে তিনি সমর্থন করেছিলেন, যা নিয়ে সে সময়ে বিতর্ক হয়েছিল।

সমাজ সংস্কার আন্দোলন কমিউনিস্টদের দৈনন্দিন কাজকর্মের সবসময়ে অংশ থেকেছে; তাদের ওইসব আন্দোলনেও সবসময়ে অংশ থেকেছে জাতপাত এবং লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অন্ধ্রপ্রদেশের পি সুন্দরাইয়া; কেরালার এ কে গোপালন, কৃষ্ণ পিল্লাই এবং ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ; তামিলনাড়ুর পি রামমূর্তি, জীভানন্দন এবং শ্রীনিবাস রাও; মহারাষ্ট্রের এস ভি পারুলেকার, বি টি রণদিভে এবং আর সি মোরে প্রমুখের জীবন জাতপাতগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের পথ প্রবর্তকের কাজকে চিত্রায়িত করেছে। শুধু এই নেতৃত্বরাই নন, সে যুগের প্রায় সব কমিউনিস্টের জীবনই জাতপাতগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রামে বিজড়িত ছিল। তাঁদের রাজনীতির যাত্রাপথ মহিলাদের প্রতি বৈষম্য ও জাতপাতব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং সমাজ সংস্কারের জন্য সংগ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল; তাঁরা এইসব সংগ্রামের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরেছিলেন এবং ফলস্বরূপ সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষিত হন ও কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন।

কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবাবলি আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, সমাজ সংস্কারের জন্য কমিউনিস্টদের কাজ কতটা বহুধাবিস্তৃত ছিল।

অন্ধ্র অঞ্চলে এই সম্পর্কিত একটি কাজের পর্যালোচনায় সেই সময়কার এক রিপোর্টে বলা হচ্ছেঃ ‘‘কমিউনিস্ট পার্টি অস্পৃশ্যতার পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। পার্টি সদস্যরা অস্পৃশ্যদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খায়, তাঁদের সঙ্গে বসবাস করে এবং তাঁদের দুঃখ আনন্দের অংশীদার হয়। যদিও শ্রেণিসংগ্রামের মূলগত ধর্মই হলো এইরকম যে, তা অস্পৃশ্য এবং যাঁরা অস্পৃশ্য নয় সবাইকে এক পতাকা তলে একত্রিত করে। বিবাহ অনুষ্ঠানগুলির সরলীকরণ করা হয়েছে ...অসবর্ণ বিবাহ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করা হয়েছে এবং পার্টি সদস্যরা সর্বদাই এইসব কাজে সামনের সারিতে রয়েছে।’’ ওই যুগে এই ধরনের কর্মসূচিকে দেশজুড়ে পরিচালনা করা হয়েছে।

জাতপাতের বেড়াকে ভাঙা এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সে যুগের প্রত্যেকটা সংগ্রামের বিশেষ করে কৃষিসংগ্রামগুলির মূল উপাদান ছিল। যদি আমরা এই সংগ্রামগুলির সময়ে নির্মিত হওয়া সাহিত্য, গানগুলি এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক ধারাগুলিকে বিশ্লেষণ করি তাহলে বুঝতে পারব কিভাবে জনগণের মধ্যে জাতপাত-বিরোধী সচেতনতা তৈরি হয়েছিল।

তেভাগা, পুন্নাপ্রা-ভায়ালার, গৌরবজনক তেলেঙ্গানা সশস্ত্র সংগ্রাম প্রভৃতির মতো কৃষিসংগ্রামগুলিতে জনগণ জাতপাত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং একসাথে লড়াই করেছিল। তেলেঙ্গানা সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছেঃ ‘‘গ্রামগুলিতে জাতপাতের ভেদাভেদ গভীরে প্রোথিত ছিল। সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সমস্ত জনগণ তাদের জাতপাতের ভেদাভেদ এবং ধর্মবিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে যৌথভাবে কাজ করতে, লড়াই করতে বাধ্য হয়েছিল। এবং এরপর অস্পৃশ্যতার ক্ষতিকর দিকের সাথে লড়াই করা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। গেরিলা বাহিনীতে সমতা এবং পারস্পরিক সম্মানের বিষয়টি কঠোরভাবে মানা হতো। এবং এই অনুশীলনই জনগণের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।’’

অস্পৃশ্যতা এবং জাতপাতগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত শিক্ষার উপর ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে জোর দেওয়া হয়ঃ ‘‘জনগণের ঐক্যকে ভেঙে দেওয়ার বুর্জোয়াদের প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করেই অস্পৃশ্যদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বৈষম্যকে অবশ্যই ধিক্কার জানাতে হবে। এবং জনগণের অধিকারের জন্য সাধারণ সংগ্রামের অংশ হিসেবে তাঁদের ন্যায্য দাবির পক্ষে অবশ্যই লড়াই চালাতে হবে।’’ এমনকি স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও জাতপাতব্যবস্থার অবসানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের লক্ষ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। যদিও প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক, মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক বিষয়সমূহ এই সিদ্ধান্তসমূহের রূপায়ণ ও নীতিসমূহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছিল। তবে দ্রুত তা’কাটিয়ে জাতপাতবিরোধী এবং অন্যান্য সমাজ সংস্কারমূলক কার্যক্রমে পার্টি ফের জোর দেওয়ায় তা আবার গুরুত্ব অর্জন করে।

১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচিতে অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের ভেদাভেদ, মহিলাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির প্রতি অপর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রভৃতির বিরুদ্ধে লড়াইকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সংগ্রামের অংশ হিসেবেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল।

তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং কিছু হিন্দিভাষী রাজ্যে অস্পৃশ্যতা, জাতপাতগত ভেদাভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও কার্যক্রম এই সব লক্ষ্যের প্রতি কমিউনিস্টদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতাকেই প্রদর্শিত করছে। ভূমিসংস্কারের রূপায়ণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরার কমিউনিস্ট সরকারগুলির গৃহীত কর্মসূচি সামন্তবাদী নিপীড়নের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল; সুনিশ্চিত করেছিল আত্মসম্মান এবং উচ্চবর্ণের আধিপত্যবাদের সামনে দলিত ও পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মাথা তুলে দাঁড়াতে শক্তি জুগিয়েছিল।

এই একশ’ বছরে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে এবং পিছিয়ে-পড়া অংশের মানুষদের আত্মসম্মানের জন্য বহু সংগ্রাম হওয়া সত্ত্বেও জাতপাতব্যবস্থার ভিতকে ধ্বংস করার কাজ এখনো শেষ হয়নি। এমনকি পুরনো সামন্তবাদী সম্পর্কগুলি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও বর্ধনশীল পুঁজিবাদী শ্রেণিগুলি এখনো জাতপাতব্যবস্থা বজায় রাখতে চায়। শোষণ বৃদ্ধি করতে, মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে এবং তাদের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিকে পুষ্ট করতে এই জাতপাতব্যবস্থা পুঁজিবাদীদের প্রয়োজন। এইসব কারণের জন্যই বর্তমান সময়ে সমগ্র পুঁজিবাদীব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে জাতপাতব্যবস্থার দূরীকরণের সংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এইজন্যই জাতপাতগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাময়িক সুরাহার জন্য সমাজ সংস্কার, সংরক্ষণ, প্রতিনিধিত্ব ও কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণের সংগ্রামের সাথেই এখনো পর্যন্ত অসম্পূর্ণ থাকা কাজ - জমির কেন্দ্রীভবন ভাঙার এবং পুঁজিবাদী শক্তিসমূহকে পরাস্ত করা যা জাতপাতব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখাকে সুনিশ্চিত করে তার জন্য আমাদের সংগ্রাম গড়ে তোলা জরুরি।

প্রতিষ্ঠার সময় থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন যে পথ দেখিয়েছে তা এখনও প্রাসঙ্গিক। সাময়িক সুরাহা এবং সমাজ সংস্কারের পদক্ষেপ জরুরি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কৃষিবিপ্লব এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই পারে জাতপাতব্যবস্থার সম্পূর্ণ অবসান ঘটাতে। একশ’ বছরের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতাকেই প্রমাণ করছে।


(ভাষান্তরঃ শংকর মুখার্জি)