৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭
বিহার মহাজোটে বামপন্থীরা একটি অদম্য শক্তি
অরুণ কুমার মিশ্র
মটিহানি (বেগুসরাই) কেন্দ্রে প্রচারে সিপিআই(এম) প্রার্থী রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিং।
বিহার বিধানসভা নির্বাচন এবার সাক্ষী থাকবে একদিকে আরজেডি, কংগ্রেস, সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই(এমএল)’র মহাজোট বন্ধনের সঙ্গে বিজেপি-জেডি(ইউ) জোটের সরাসরি লড়াইয়ের।
ছোটো যে দলগুলি যারা জাত এবং এ ধরনের স্বার্থসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা যে কোনো ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের জন্য এই দু’টি জোটের যেকোনো একটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পরিস্থিতি এখনো জমাট বাঁধেনি এবং এই এই আঁতাতগুলির প্রকৃতি সম্পর্কে শেষ কথা এখনো বলা বাকি। এলজেপি দল কিন্তু বিজেপি’র সঙ্গে তাদের সম্পর্ক না চুকিয়েই জেডি(ইউ)’র বিরুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তাতে মনে করা হচ্ছে, এটা নীতীশ কুমারের থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য বিজেপি’র অশুভ কর্মপরিকল্পনা বা তার বিস্তার কেটেছেঁটে ছোট করার জন্য। সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ যারা নিজেদেরকে দলিত এবং সমাজের প্রান্তিক অংশের ত্রাতা বলে প্রচার করে, বিভিন্ন জাতপাতভিত্তিক সংগঠন যারা প্রচার করছে যে প্রতিটি আসনে প্রার্থী দেবে, এদের অধিকাংশেরই খরচ জোগাচ্ছে বিজেপি। এদের মন্ত্রীসভায় স্থান দেবার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে বা কিনে নেওয়া হচ্ছে। এগুলো করা হচ্ছে গরিব এবং প্রান্তিক অংশের মানুষ যারা গ্রহীতার প্রান্তে রয়েছেন এবং গত ১৫ বছর ধরে বিজেপি-জেডি(ইউ) জোটের অপশাসনের তাদের ভাগ করে দেবার লক্ষ্য থেকে।
বিগত শেষ তিন বছরের শাসনকালে, নীতিশকুমার যখন জনাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন এবং বিজেপি’র সঙ্গে মিলিতভাবে যখন সরকার তৈরি করেছিলেন, তা বিহারের গণতন্ত্রের ইতিহাসে শুধুমাত্র একটি কালো দাগ নয়, এটা চিহ্নিত হয়ে আছে তাঁর দীর্ঘ শাসনকালে জঘন্যতম কাজ হিসেবে। নীতি আয়োগ এবং এনসিআরবি’র বিহার সংক্রান্ত সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট তথাকথিত উন্নয়ন এবং সুশাসনের অন্তঃসারশূন্যতাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দিয়েছে। ২০১৯ সালের স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার সূচকের যে তালিকা, যা ‘নীতি আয়োগ’ প্রকাশ করেছে, বিহার সেই তালিকায় একেবারে নিচে রয়ে গেছে।
বিহারে যারা প্রায়ই আসেন, তাঁরা উন্নততর রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার নির্মাণ, ব্রিজ প্রভৃতি সম্পর্কে বলেন এবং প্রভাবিত হন এই ধরনের উন্নয়নে। কিন্তু তাঁরা যদি বিহার সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বিভিন্ন সরকারি এবং প্রাইভেট এজেন্সির শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, অপুষ্টি, নিকাশি ব্যবস্থা, গৃহহীনতা এবং কৃষিজীবী মানুষের দুর্দশার সামগ্রিক রিপোর্টগুলি পড়ে দেখেন, তাহলেই বিজেপি-জেডি(ইউ) জোটের ১৫ বছরের শাসনের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব।
প্রতিবছরের বন্যার দরুন উত্তর বিহারে যে ধ্বংসলীলা চলে, তা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এটা নিয়ে একটা বিতর্ক চালু আছে যে, হিমালয়ের থেকে আসা নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, না কি তাদের প্রবাহকে অপ্রতিহতভাবে বইতে দেওয়া হবে। এর মাঝে পড়ে ওই বন্যাপ্রবণ এলাকার বসবাসকারী মানুষ প্রতিবারই বন্যার দরুন তাঁদের নিজস্ব সবকিছু খুইয়ে নতুন করে নিজের জীবনযাত্রা শুরু করতে বাধ্য হন। উত্তর বিহারে বন্যার সময় নদীর ভয়ঙ্কর প্লাবনের দরুন প্রতিবছরই সেখানকার যে মানুষ বাড়ি ও জমি থেকে উৎখাত হন, এই সরকার তাদের প্রকৃত নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
এনসিআরবি’র সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পণের দরুন হত্যা এবং খুনের তালিকায় দেশের মধ্যে বিহার দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। ২০১৬ সালে যেখানে ৯৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল পণজনিত কারণে, ২০১৭ সালে তা ১০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮১। একইভাবে খুনের ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে ২,৫৮১টি ঘটনা ঘটেছিল, যা ৯ শতাংশ বেড়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ২,৮০৩। তবে এই সংখ্যাগত তারতম্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
এই সমস্ত পরিসংখ্যান হিমশৈলের একটি চূড়ামাত্র। এই ধরনের আরও অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়নি। বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে খাপ পঞ্চায়েতের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে ব্যাঙের ছাতার মতো। জাতভিত্তিক পিতৃতন্ত্রের শাসনকে উপেক্ষা করে যে সমস্ত যুগল ভালোবেসে বিয়ে করেছেন তাদের বিরুদ্ধে এই খাপ পঞ্চায়েতগুলি বিশেষভাবে খড়্গহস্ত হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হওয়া মহিলারা বাধ্য হচ্ছেন যারা এই ধরনের জঘন্য অপরাধ করছে তাদের বিয়ে করতে। এক্ষেত্রে কোনো শাস্তি না দিয়ে বিজেপি-জেডি(ইউ) জমানা সামন্ততান্ত্রিক উপাদানসমূহকে উৎসাহিত করেছে এই ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্রে।
বিজেপি-জেডি(ইউ)’র এই ১৫ বছরের শাসনকালের শ্রমিকশ্রেণির কণ্ঠকে নির্মমভাবে অবদমিত করা হয়েছে। এরা কখনোই বিভিন্ন অংশের সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের উত্থাপিত দাবি-দাওয়া মীমাংসার জন্য গণতান্ত্রিক আলোচনায় অংশ নেননি।
অঙ্গনওয়াড়ি শ্রমিক এবং সহায়িকা, মিডডে মিল শ্রমিক, মমতা ইত্যাদি প্রকল্প শ্রমিকদের এই সরকার অবমাননা করেছে। সামান্য যে মজুরি তাঁরা পান তা কখনোই বাড়ানো হয়নি এবং কখনোই তা সঠিক সময়ে দেওয়া হয়নি।
শিক্ষকরা, যারা সমকাজে সমবেতন এর দাবিতে লড়াই করছেন তাদের সেই অধিকারকে অস্বীকার করেছে বর্তমান সরকার এবং নির্লজ্জের মতো সুপ্রিম কোর্টে বলেছে যে, অর্থের অভাব থাকার কারণে তারা এই দাবি পূরণ করতে পারবে না।
১১ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির অন্তঃসারশূন্যতা
বিহারের জনগণ দেখেছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের অমানবিক অবস্থা। ফিরে আসার পথে তারা প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের নিষ্ঠুর আক্রমণের সঙ্গে যুঝে খিদে এবং শরীরের জলশূন্যতা নিয়ে মারা গেছেন, এমনকি গর্ভবতী মহিলারা কিভাবে শিশুদের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। তারা নীতিশকুমার সরকারের অমানবিক চেহারা দেখেছেন যা চোখের সামনে মানুষের ট্র্যাজেডি দেখেও কিভাবে সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতা তাদের জন্মভূমিতে কিভাবে বিছিয়ে দিয়েছে।
এই ধরনের বেদনাদায়ক এবং জনবিরোধী রেকর্ডের অধিকারী বিজেপি-জেডি(ইউ) সরকারকে উপযুক্ত জবাব দেবেন আগামী নির্বাচনে বিহারের জনতা। তাই এই জোট মানুষকে জাতপাত এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে ভাগ করার জন্য সবরকমের কুৎসিত পরিকল্পনা করে বা ভোটারদের সার্বিকভাবে নিজেদের পক্ষে আনার জন্য কিনে নিতে চাইছে।
রাজ্যের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে এবং ২২ তম পার্টি কংগ্রেসের নির্দেশ মান্য করেই মহাজোটবন্ধনের জোটের সঙ্গে চুক্তি করে বিজেপি- জেডি(ইউ) জোটকে হারানো নিশ্চিত করতে এবং বিহার বিধানসভায় পার্টি প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে রাজ্য পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পার্টি নিম্নোলিখিত চারটি কেন্দ্রে মহাজোটবন্ধনের সঙ্গে জোট করে প্রার্থী দিয়েছে।
বিভূতিপুর (সমস্তিপুর) অজয় কুমার
মটিহানি (বেগুসরাই) রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিং
পিপরা (চম্পারন) রাজমঙ্গল প্রসাদ
মানঝি (মানঝি) সত্যেন্দ্র যাদব
পার্টি ইতিমধ্যেই প্রচার শুরু করে দিয়েছে এই সমস্ত কেন্দ্রগুলিতে এবং সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের প্রার্থীরা পার্টিকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ভোটারদের সঙ্গে দেখা করছেন নির্বাচন কমিশনের অতিমারী সংক্রান্ত নির্দেশিকা মেনে। আমাদের প্রার্থীদের নির্বাচন প্রক্রিয়া দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে। ৯ অক্টোবর মনোনয়ন দাখিল করা হয়েছে।
শিক্ষকদের কেন্দ্র এবং স্নাতকদের কেন্দ্রে নির্বাচন হবে ২২ অক্টোবর। আমাদের দু’টি কেন্দ্রের দুই প্রার্থী রামদেও রাই এবং অঞ্জনি কুমার সিং ইতিমধ্যেই তাঁদের মনোনয়ন জমা করেছেন এবং প্রচারে মগ্ন রয়েছেন। তাঁরা ভালই সাড়া পাচ্ছেন শিক্ষক এবং স্নাতকদের এই কেন্দ্রগুলিতে। আমরা ভালো ফলাফলের জন্য আশাবাদী।
গ্রাউন্ড রিপোর্ট বলছে বিহার আরও একবার তার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি প্রমাণ করবে এবং গেরুয়া ব্রিগেড এর জোয়ারকে বিপরীতমুখী করে দেবে। রাজ্যের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছেন। এবার তাঁদের পালা। জনসাধারণ বিপুল ভোটে এই জোটকে হারিয়ে কবর দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন বামপন্থীদের সমর্থনে বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকারকে বেছে নেবার জন্য।