৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭
দেশের আখচাষিদের প্রতি বঞ্চনা চলছেই
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
এবছরও বঞ্চিত করা হলো আখচাষিদের। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার কেউ কথা রাখলো না। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে আখ চাষিদের বকেয়া টাকা চিনিকল মালিকদের শোধ করতে বাধ্য করা হবে বলে মোদী-যোগী প্রতিশ্রুতি দিলেও আবার তাদের বঞ্চিত করা হলো। দেশের অন্যত্রও একই অভিজ্ঞতা আখ চাষিদের।
প্রায় পাঁচ কোটি চাষি জড়িত আখ চাষের সঙ্গে। দেশের ৫০ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রায় ১২থেকে ১৮ মাস ধরে আখ চাষ করে ফি-বছর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন আখ চাষিরা। কারণ ফলন বেশি হলে সমস্যা। আবার আখ চাষ হলে সে জমিতে কয়েক মরসুম অন্য ফসল ফলানো যায় না। আখ চাষিরা কার্যত বাধ্য হন লোকসানে হলেও আখ ফলাতে। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকলেও ফিবছর ফসল বেচে টাকা তৎক্ষণাৎ মেলেনা, বকেয়া পড়ে থাকে। চিনির দাম খুচরা বাজারে যতই বাড়ুক চাষিদের তার সুফল মেলে না । কিলো পিছু আয় উৎপাদন ব্যয়ের নিচে নেমে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। বেশি উৎপাদন হলেও রপ্তানির বাজার মন্দা। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের আখের দাম অনেক বেশি। যেমন ব্রাজিলের তুলনায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বেশি দর ভারতের আখের। তাই বাড়তি ফলনের থেকে ইথানল উৎপাদন করে অবস্থা সামাল দেওয়া হয়। চিনি আমদানি বন্ধ করেও সুফল মেলে না চাষিদের।
দেশের সরকারেরও উদ্বৃত্ত রপ্তানিতে নীতিনির্ধারণের কোনো উদ্যোগ নেই। এক কথায়, আখের দাম বেশি হবার পাশাপাশি চিনির দাম কম হলেই সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় চাষির ঘাড়ে। বকেয়া টাকার দায়ে ঋণগ্রস্ত চাষি যেতে বাধ্য হয় গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র কাজের সন্ধানে। যোগী-মোদী-কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী - সবাই সমান এক্ষেত্রে। মিল মালিকদের বেইল আউট প্যাকেজ দিতে কেন্দ্রীয় সরকারও উপুড় হস্ত হলেও চাষিদের জুটছে বঞ্চনা। বছরের পর বছর।
আখ এবং চিনি উৎপাদনের সঙ্গে প্রায় ৮০,০০০ কোটি টাকা যুক্ত। শুধু চাষ নয়, আখ উৎপাদন থেকে চিনি বস্তাজাত হওয়া পর্যন্ত ব্যাপক অংশের মানুষ সংগঠিত এবং অসংগঠিত ভাবে চিনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। সামান্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বেইল আউট প্যাকেজ হিসেবে ধরে দেওয়া তাই প্রসাধনী বদল ছাড়া আর কিছু নয়। ভুক্তভোগী চাষিরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিজেদের অগ্রাধিকার ঠিক করে নেন অনেক ক্ষেত্রেই। কারণ উৎপাদনের পরিমাণ চক্রাকারে পরিবর্তনশীল। যে বছর উৎপাদন বেশি হয় সে বছর চিনির দাম পড়ে যায়। চাষি তার বকেয়া পায় না। সরকার নির্বিকার থাকে। আর তার পরের বছর চাষি উৎপাদন কম করে লোকসান থেকে বাঁচার জন্য। তখনই অন্তর্দেশীয় উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় কম হবার জন্য সঙ্কট তৈরি হয়। দাম বাড়ে চিনির। চাষি সেবছর দাম তুলনায় বেশি পায়। খাতায়-কলমে দাম বেশি পাওয়ার পর পরবর্তী বছরে আবার চাষি বেশি চাষ করে এবং পরিণতি হয় আগের মতোই।
এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে সম্প্রতি নিয়োজিত সি রঙ্গরাজন কমিটি সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট জমা করে। সমস্ত উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট সুসংহত ব্যবস্থার মধ্যে আনার জন্য ওই কমিটি কতগুলি সুপারিশ করে। যেমন আখ চাষিদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবার কথা ন্যায্যমূল্য দেবার কথা এবং মিল মালিকদের সঙ্গে চাষিদের সম্পর্কে যে বিশ্বাসহীনতা এসেছে তা দূর করবার জন্য সরকারি উদ্যোগে দুই পক্ষকে নিয়ে বসার কথা এবং সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হলো ঠিক সময়ে চাষিদের দাম মিটিয়ে দিতে হবে বলা হয় সুপারিশে। সি রঙ্গরাজন কমিটির এই সুপারিশের পরেও অবশ্য অগ্রগতি বিশেষ কিছু হয়নি।
২০২০-২১ মরশুমে আখের লাভজনক দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার সম্প্রতি টন পিছু ২৮,৫০০ টাকা ধার্য করার কথা ঘোষণা করেছে। গত বছরে এই সরকার আখের দামের কোনো বৃদ্ধি করেনি। কিন্তু এ বছর মাত্র ১০০ টাকা বাড়িয়েছে। চাষের খরচ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার তুলনায় এই দর একেবারেই উপযুক্ত নয়। কার্যত এটা চাষিদের সঙ্গে নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, অপরিকল্পিত লকডাউন’র জেরে আখ চাষিরা দেশের অন্যান্য কৃষিজীবীদের মতোই প্রবল দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের এই দরবৃদ্ধির ঘোষণাকে কৃষকদের সংগঠন অল ইন্ডিয়া সুগারকেন ফারমার্স ফেডারেশন (এআইএসএফএফ)’র পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে নিন্দা করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে যে ১০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ দর রাখা হয়েছে সেটা আখ চাষিদের স্বার্থবিরোধী বলে ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। ১৯৮০-৮১ সালে এই ক্ষতিপূরণ দর ছিল ৮.৫ শতাংশ । ২০০৬-০৭ সালে ছিল ৯ শতাংশ এবং ২০০৯-১০ সালে ছিল ৯.৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে এটা বেঁধে দেওয়া হলো ১০ শতাংশে। সুগার মিল বা চিনিকল মালিকদের স্বার্থে এই বেঁধে দেওয়া দর চাষিদের খরচের প্রকৃত হারের তুলনায় অত্যন্ত কম।
সরকার কৃষকদের দাবি মানেনি একাধিক ক্ষেত্রে। চিনিকলের গেটে আখ বিক্রির ক্ষেত্রে চাষিদের দাবি ছিল টন পিছু ৩২,০০০ টাকা বা কেজিপিছু ৩২ টাকা। আবার চিনি থেকে উৎপাদিত গুড়ের ক্ষেত্রে টন পিছু ১২,০০০ টাকা দর নির্ধারিত করা হোক এইটাই দাবি ছিল আখ চাষিদের। কারণ, কোভিড অতিমারীর জন্য এই মুহূর্তে ইথানল স্যানিটাইজার তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাপকহারে লাভ করছে মিল মালিকরা। তাই চাহিদাও বেড়েছে। আর উপজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে বিপুল লাভ হলেও মিল মালিকরা চাষিদের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য নয়। ঋণগ্রস্ত চাষিদের অবস্থা তাই প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে।
প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ লাগু করতে বিজেপি সরকার দীর্ঘদিন ধরেই অরাজি। ওই কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছিল, ফসলের লাভজনক দরের ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয়ের ৫০ শতাংশ বেশি দর ধার্য করতে হবে। কিন্তু টন প্রতি ১০০ টাকা বৃদ্ধি, যার অর্থ হলো কিলোতে ১০ পয়সা বৃদ্ধি এটা চাষিদের প্রতি নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই মুহূর্তে চাষিদের কাছে চিনিকল মালিকদের দেনা প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। না কেন্দ্রীয় সরকার, না রাজ্য সরকার কেউই মিল মালিকদের বাধ্য করতে পারছে না দেনা শোধ করতে।
আখ চাষিদের সর্বভারতীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে চাষিদের জীবন জীবিকার সুরক্ষার স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি করা হয়েছে টন প্রতি ৫,০০০ টাকা আখের দরে বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হবে আখ চাষিদের বকেয়া মিটিয়ে।