E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭

সাভারকরের ব্রিটিশ-সহযোগকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা

গৌতম রায়


হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আত্মনিবেদিত লড়াইয়ের সাথী হিসেবে দেখাতে বহুদিন ধরেই সক্রিয়। এই কাজে সাভারকরের পাশাপাশি, আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে তুলে ধরতেও তারা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। সাভারকরের ব্রিটিশের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করার মুচলেকাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রতিপন্ন করাতে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী শীবাকীর্তনে মেতে উঠেছেন। এই শীবারবের অঙ্গ হিসেবেই হেডগেওয়ারের সঙ্গে অনুশীলন সমিতির অন্যতম ব্যক্তিত্ব ত্রৈলক্য মহারাজের ঘনিষ্ঠতার অনেক গল্পের অবতারণা আরএসএস করে। সেলুলার জেলে ত্রৈলক্য মহারাজের সহবন্দি ছিলেন সাভারকর। জেল জীবনের স্মৃতিচারণে সাভারকরের সম্বন্ধে একটি দু’টি কথা বললেও হেডগেওয়ার সম্পর্কে ত্রৈলক্য মহারাজ কখনোই কোনোরকম কিছু লেখেননি। তাই হেডগেওয়ারকে ব্রিটিশ বিরোধী যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরলে হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ যতটা প্রসার পাবে, যার জেরে ভোট রাজনীতিতে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র সুবিধা হবে, তার থেকে অনেক বেশি সুবিধা তারা পাবে সাভারকরকে গৌরবান্বিত করলে। তাই সেই সামাজিক প্রযুক্তির কাজে আরএসএস ইতিমধ্যেই বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে নামিয়ে দিয়েছে আনন্দবাজারের মতো সংবাদপত্রকে ব্যবহার করে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আরএসএস নিজেদের ব্রিটিশ তোষামোদকারীর ভূমিকা মুছতে সাভারকরকে তিনটি পর্যায়ে আগামীদিনে আরও জোরদারভাবে তুলে ধরবে। প্রথমটি হলো, সাভারকরকে কেবল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আপসহীন যোদ্ধা হিসেবে দেখিয়েই ক্ষান্ত হবে না আরএসএস। তারা সাভারকরকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তির নির্মাতা হিসেবে দেখাতে চায়। এই ক্ষেত্রে কার্ল মার্কসকে গুরুত্বহীন করে, ভারতে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে (১৮৫৭)’র রূপরেখার ভিতর দিয়ে জাতীয়তাবাদের, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার আদর্শগত ভিতের তাত্ত্বিক ক্ষেত্র যে সাভারকরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, হিন্দুত্ববাদীদের এই রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ইতিহাসের অনৈতিহাসিক উপস্থাপনের ভিতর দিয়ে তুলে ধরতে চায় আরএসএস।

দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো, আন্দামানের সেলুলাল জেলে বন্দি অবস্থায় একাধিক ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে লেখেন সাভারকর। সেই চিঠিগুলির সবক’টি পাওয়াও যায় না। সেইসব চিঠিতে ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষায় স্বাধীনতার আন্দোলনকে কার্যত পেছন থেকে ছুরি মারার যে অঙ্গীকার সাভারকর করেছিলেন, সেইসব কিছুকেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা কৌশল ছিল, এমন আজগুবি তত্ত্বের অবতারণা করে, গোয়েবলসের কায়দাতে সেই আজগুবি, ইতিহাস অনাশ্রিত তত্ত্বকে বার বার উচ্চারণ করে, সেই অসত্যকেই একটা সত্যের মোড়কে মানুষের সামনে তুলে ধরতে চায় গোটা হিন্দু, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির।

তৃতীয় পর্যায়টি হলো, মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার সঙ্গে সাভারকরের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক হিন্দুত্ববাদীরা চিরকালই অস্বীকার করে। আইনের মারপ্যাঁচে সূক্ষ্ম সুতোর ব্যবধানে গান্ধী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হননি সাভারকর। আইনের প্যাঁচপয়জারে গান্ধী হত্যার দায় থেকে সাভারকর মুক্ত হলেও, গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না, এটা সর্বস্তরের ভারতবাসীর কাছে অবিশ্বাস্য। তাই বিদ্যুৎ চক্রবর্তী চেষ্টা করেছেন গান্ধীজির মতাদর্শের সঙ্গে সাভারকরের মতাদর্শের গল্পের অবতারণা করে, আপাদমস্তক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মুসলমান বিদ্বেষী সাভারকরকে একদম মহাত্মা গান্ধীর সমতুল একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মেলে ধরতে। সাভারকরকে গান্ধীজির সমতুল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের দুই দিক দিয়ে লাভ। প্রথমটি হলো, সমতুল রাজনীতিতে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায় থেকে সাভারকরের মুক্ত থাকার ঘটনাটি ঘিরে দেশবাসীর ভিতরে একটা ইতিবাচক ধারণা জোরদারভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। ফলে গান্ধীহত্যার দায় থেকে সাভারকরকে মুক্ত করার কাজটি হিন্দুত্ববাদীদের কাছে অনেক বেশি পরিমাণে সহজসাধ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। অপর লাভটি হলো, জাতীয় আন্দোলনে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির ভিতরে কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো আড়ালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি যে সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে চলা শুরু করেছে, সেই পথচলাটি অনেক বেশি নিরাপদ হবে।

১৮৫৭’র মূল্যায়ন ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের চিন্তার ভিতরে প্রথম থেকেই প্রবল অনৈক্য। ১৯০৮ সালে মূল বইটি এই সম্পর্কে যখন সাভারকর লেখেন, তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। মারাঠী ভাষাতে মূল বইটি লেখা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৯৫৭-তে এই বিষয়ে যে বইটি লেখেন, সেটির মূল্যায়ন সাভারকরের মূল্যায়নের সম্পূর্ণ বিপরীত। ডঃ মজুমদারের অভিমত এ প্রসঙ্গে সর্বজনমান্য নয়। তা বলে সাভারকরকেও ১৮৫৭’র বিদ্রোহকে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে প্রথম মূল্যায়ন কর্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ইতিহাসের রাজনৈতিক উদ্দেশে বিকৃতকরণ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে ১৮৫৭’র সংগ্রামকে সাভারকরেরও অনেক আগে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন কার্ল মার্কস।

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যায়ন ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের ভিতর প্রচণ্ড স্ববিরোধ আছে। সেই স্ববিরোধকে হিন্দুত্ববাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর কার্যত চেপে রাখতে চায়। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদীদের চরম নেতিবাচক ভূমিকা এবং অবদানকে মানুষের কাছে আড়াল করার একটা উপক্রম হিসেবে ১৮৫৭ ঘিরে সাভারকরের অভিমতকে সামনে এনে আরএসএস, তাদের ঘরের লোক, তথা বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমতকে হেলায় অস্বীকার করে ডঃ মজুমদারকে অপমান করতেও দ্বিধা করে না।

সাভারকরের ১৮৫৭ ঘিরে মূল্যায়নের গোটা পরিসরে অপরিণতির ছাপের কথা অশোক মেহতার মতো চিন্তাবিদ খুব স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন। এই মূল্যায়নকে অশোক মেহতা কোনো অবস্থাতেই ‘ইতিহাস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। এটিকে তিনি ইশ্‌তিহার, অর্থাৎ, যে রাজনৈতিক চেতনাকে পরবর্তীতে সাভারকর প্রচার করেছেন, তারই একটা প্রস্তুতিপর্ব বলে বর্ণনা করেছিলেন (১৮৫৭: এ গ্রেট রেবেলিয়ান - অশোক মেহতা, হিন্দ কিতাবস, বম্বে, ১৯৪৬, পৃষ্ঠাঃ ৭)। মধু লিমায়ের মতো রাজনীতিকও ১৮৫৭ ঘিরে সাভারকরের মূল্যায়নের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।তিনি সাভারকরের পাণ্ডিত্যের অযোগ্যতা ঘিরেই শুধু সরব হননি, সাভারকরের অনৈতিহাসিক প্রবণতা ঘিরেও সোচ্চার হয়েছিলেন (দি টেলিগ্রাফ, ১৯৮৮ সালের ১২, ১৩ মার্চ, অশোক মেহতার লেখা প্রবন্ধ)।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ১৮৫৭ ঘিরে সাভারকরের মূল্যায়নের প্রশংসা করতে গিয়ে একটি বিষয় সম্পর্কে নীরব থেকেছেন।সংশ্লিষ্ট গ্রন্থে কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের স্বভাবসুলভ মুসলিম বিদ্বেষের পরিচয় নেই। বরঞ্চ দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান সমাজের ভূমিকার সপ্রশংস উল্লেখই সাভারকর করেছেন। যে হায়দার আলি, টিপু সুলতান সম্পর্কে অমর্যাদাকর কথা না বলে আরএসএস, বিজেপি আজ জলগ্রহণ করে না, সেই মানুষদের সম্পর্কে সাভারকর লিখেছিলেনঃ পরাধীন ভারতের বিপদ সম্পর্কে প্রথম অনুভূতি এসেছিল, পুনার নানা ফড়নবিশের এবং মহীশূরের হায়দার সাহেব (ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম - সাভারকর, পৃষ্ঠাঃ ১৩-১৪)।

হিন্দুত্ববাদীরা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’র প্রয়োগে মনোজগতে চিরদিন দ্বৈততায় ভরা চিন্তাধারাকেই প্রকাশ করে এসেছে। ১৮৫৭-র সংগ্রাম ঘিরে সাভারকর আর রমেশচন্দ্র মজুমদার, সঙ্ঘের দু’জন স্তম্ভের চিন্তাধারার ভিতরে যে আসমান জমিন ফারাক, সেটিকে কার্যত উহ্য রেখেই, হিন্দুত্ববাদীদের স্বাধীনতার বীর যোদ্ধা দেখাবার তাগিদেই এ বিষয়ে সাভারকরের মন্তব্যের খণ্ড অংশকে তুলে ধরছে হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা। বিশ্বভারতীর উপাচার্য, প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যায়নে সাভারকরের মন্তব্য ঘিরে তাঁকে কেবল স্বাধীনতাযোদ্ধাই নয়, ভারতের জাতীয় আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাতা হিসেবে মহাত্মা গান্ধীর সমতুল ব্যক্তিত্ব হিসেবে মেলে ধরেছেন। অথচ বিদ্যুৎ চক্রবর্তী একটিবারের জন্যেও উল্লেখ করেননি, হায়দার আলি, টিপু সুলতানকে ঘিরে সাভারকরের যে মূল্যায়ন, তা কোনো অবস্থাতেই তার অনুগামীরা একচুল অনুকরণ তো দূরের কথা, প্রত্যক্ষভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানের কথা প্রচার করে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে, নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাম্প্রদায়িকতা'র প্রচার এবং প্রয়োগের স্বার্থে অনৈতিহাসিকভাবে টিপু সুলতানকে মেলে ধরে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ায়।

মহাফেজখানার দলিল দস্তাবেজের ভিত্তিতে আন্দামানের সেলুলার জেলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর ব্রিটিশের অত্যাচারের বিবরণ ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছিলেন, ‘পেনাল স্টেলমেন্টস ইন আন্দামানস’ নামক মহাগ্রন্থে। সেখানে ত্রৈলক্য মহারাজ থেকে সতীশ পাকড়াশী, সুধাংশু দাশগুপ্ত-দের উপরে জেলের ভিতর ব্রিটিশের অত্যাচারের তথ্যনির্ভর বহু অত্যাচারের কথা লিখেছেন। তবে সাভারকর যে জেলে অত্যাচারিত হননি, বেশ রাজসুখেই ছিলেন, সেই সাক্ষ্য কিন্তু ডঃ মজুমদারের বই বা ত্রৈলক্য মহারাজের লেখা, ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ পড়লেই জানা যায়। সাভারকর সেলুলার জেলে সহবন্দিদের উপর ব্রিটিশের অত্যাচার সম্পর্কে এতটুকু সরব ছিলেন না, তার বিবরণ ত্রৈলক্য মহারাজ এই গ্রন্থে রেখে গেছেন। জেলে অব্যবস্থার বিরুদ্ধে বন্দিরা যেসব ধর্মঘট করেছেন, তার একটিতেও যে সাভারকর অংশ নেননি, ত্রৈলক্য মহারাজ তাও লিখে গেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর গ্রন্থে সাভারকরের স্তুতি করতে গিয়েও ত্রৈলক্য মহারাজের এই মূল্যায়নকে অস্বীকার করতে পারেন নি। পাঞ্জাবের বিপ্লবী পৃথ্বী সিং দু’সপ্তাহ ধরে জেলে ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে লড়াই চালান ত্রৈলক্য মহারাজ থেকে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (চন্দননগরের বিপ্লবী) তার বিবরণ রেখেছেন। এই সময়কালে জেলের ভিতরে সাভারকরের ভূমিকা কতটা ব্রিটিশ তোষামোদকারী ছিল, তা এইসব স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।

১৯১১ সালের ৪ জুলাই সেলুলার জেলে প্রথম আসার অল্প কয়েকদিনের মাথায় সাভারকর ব্রিটিশের কাছে যে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন, সেই আবেদনের বিষয়বস্তু এবং তারিখ কেন ব্রিটিশের নথিতে নেই, এই রহস্যের উন্মোচন ক্ষমাপ্রার্থনাকে ‘কৌশলে’র তত্ত্বে রূপ দেওয়া বিদ্যুৎ চক্রবর্তী এ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন নি। তবে, মাত্র দু’বছর পরে, ১৯১৩ সালের ২৪ নভেম্বর, আবার ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষার অঙ্গীকার করে সাভারকর যে চিঠিটি লিখেছিলেন, সেখানে তিনি নিজেই আগের ওই চিঠি লেখার কথা স্বীকার করেছেন। যদিও এই বার বার একই বিষয় ঘিরে চিঠি লেখার কথাটি বিদ্যুৎ চক্রবর্তী উল্লেখই করেন নি।

মুরলীমনোহর যোশী, বাজপেয়ী ক্যাবিনেটে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী থাকাকালীন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ (আইসিএইচআর) থেকে ‘টুওয়ার্ড ফ্রিডম’ নামক দু’খণ্ডের গ্রন্থ প্রকাশ ঘিরে বহু সমস্যা তৈরি করলেও, সেই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে (পৃষ্ঠাঃ ৪৫১), কেন সাভারকরের ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিটি প্রকাশ ঘিরে গ্রন্থদু’টির সম্পাদক বিশিষ্ঠ ঐতিহাসিক কে এন পানিক্কর এবং সুমিত সরকারের সাথে কোনো বিবাদে জড়াননি, তা বোঝা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নিবন্ধ থেকে। এই ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিটিকে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত প্রজন্মের কালের নিয়মে অপস্মৃতির পর, সেই চিঠিটিকে সাভারকরের তথা হিন্দুত্ববাদীদের তথাকথিত ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের একটা ‘কৌশল’ হিসেবে দেখানো ছিল আরএসএস’র মূল উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য সফল করতেই বিশ্বভারতীর উপাচার্য আনন্দবাজারের পাতায় (১০ অক্টোবর, ২০২০) সেই ক্ষমাভিক্ষার চিঠিটিকে সাভারকরের ব্রিটিশ বিরোধিতার কৌশল হিসেবে উপস্থাপিত করলেন। সাভারকর একাধিক মুচলেকা ব্রিটিশকে দিলেও, কোন্‌ মুচলেকাটি তাঁর তথাকথিত ‘কৌশল’ ছিল, সেটা অবশ্য বিদ্যুৎবাবু উল্লেখ করেননি। অনুমান করা যায়, যেহেতু সেই মুচলেকাটিকে তিনি, ‘যেটি আজ সহজেই পাওয়া যায়’ বলে উল্লেখ করেছেন, সেটি ১৯২৪ সালের ৬ জানুয়ারি লিখিত।

এই যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী পরিকল্পনা করে বাজপেয়ীর আমলে সাভারকরের ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার চিঠিটি প্রকাশ এবং শত সমালোচনা শুনেও সেই চিঠিটি ঘিরে সঙ্ঘের কৌশল কাউকে দীর্ঘদিন জানতে না দেওয়া, অবশেষে বিশ্বভারতীর মতো রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘরের লোক বসিয়ে, আনন্দবাজারের মতো পত্রিকাকে ব্যবহার করে, সেই ক্ষমা ভিক্ষা সম্পর্কে সঙ্ঘের মানসিকতার প্রকাশ - এটাই হলো, আরএসএস-এর সুদূর প্রসারী সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই সামাজিক প্রযুক্তির দিকটিকে ভালোভাবে অনুভব করেই আরএসএস, বিজেপি’র রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’র প্রসার এবং প্রয়োগে সাভারকরকে ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের নতুন উদ্যোগ সম্পর্কে সতর্কতা প্রয়োজন।

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দিদের উপর ব্রিঠিশের অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়ে মহাফেজখানার তথ্য এবং সাভারকরের বক্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দিলেও কখনোই সাভারকরের উপর ব্রিটিশের ন্যুনতম অত্যাচারের একটিও বিবরণ দিতে পারেন নি। বরঞ্চ, সেলুলার জেলে বন্দি হিসেবে অপর বন্দিদের থেকে সাভারকরের স্বাচ্ছন্দ্যের কথাই ডঃ মজুমদারের লেখার ভিতরে আছে (ডঃ মজুমদারের পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থের পৃষ্ঠাঃ ২০১-২০৩ এবং ২৩৪ পৃষ্ঠার পাদটীকা উৎসাহী পাঠক দেখুন)। সাভারকর যে সেলুলার জেলে থাকাকালীন বেশ কিছু সহবন্দিকে ব্রিটিশের সহযোগী করে তুলতে চেয়েছিলেন, তার স্পষ্ট সাক্ষ্য আছে ডঃ মজুমদারের গ্রন্থে (পৃষ্ঠাঃ ২৪৭-২৫০)।

ব্রিটিশের কাছে ক্ষমাভিক্ষাকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বর্ণনা করলেও, ১৯১৮ সালের মনফোর্ড সংস্কার( মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার) যখন সেলুলার জেলে বন্দি একজনও সমর্থন করেননি, তখন ব্রিটিশের সেই সংস্কারের ভূয়ষী প্রশংসা করে সেটির সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন সাভারকর।