৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭
আনন্দদেববাবুর সঙ্গে শেষ কুড়ি বছর
তপন মিশ্র
১৯৯৯ সালে অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময়ে রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশশিক্ষাকে স্নাতকস্তরে অবশ্য পাঠ্য হিসাবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০০ সাল থেকে পড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যসূচি ঠিক করেছে, কিন্তু একটি মহাবিদ্যালয়ের কোন্ বিভাগ কী পড়াবে এনিয়ে বিভিন্ন মহাবিদ্যালয়ের টিচার্স কমনরুম খুব গরম। পরিবেশশিক্ষা বিজ্ঞানের বিষয়, তাই বিজ্ঞান বিভাগগুলিকে দায়িত্ব নিতে হবে। অন্য এক মতও ছিল। সবাইকে ভাগ করে পড়াতে হবে। বিজ্ঞান, কলা এবং বাণিজ্য - সমস্ত বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি পড়াতে হবে, পরীক্ষা নিতে হবে ইত্যাদি। সেই সময়ে পরিবেশবিদ্যা বিষয়ে মহাবিদ্যালয়গুলিতে কোনো বিভাগ বা অধ্যাপক ছিল না। ঠিক হলো, প্রথমে কয়েকটি বড়ো মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা শুরু করতে হবে। আমি যেখানে যুক্ত ছিলাম সেই মহাবিদ্যালয়ের উপর প্রথম দায়িত্ব পড়ল আলোচনা সংগঠিত করার। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল, কীভাবে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে এগোনো হবে তার একটা মানচিত্র হাজির করা। বেশ কয়েকটি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সেই আলোচনাসভায় যোগ দেন। উপাচার্যও সেই সভায় এসে উপস্থিত। কোন্ বিভাগ কী পড়াবেন বলার পর শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। পণ্ডিতদের বিতর্ক বলে কথা। বেশ কিছু সময় বিতর্ক হতে দিয়ে আলোচনা শুরু করলেন উপাচার্য। ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে যা বললেন তার সারমর্ম হলোঃ “আমরা ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ করতে চাইছিনা। আমাদের এখন চাহিদা হলো পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি। তাই যে কোনো আধাপককে পরিবেশের যেকোনো বিষয় পড়ানোর মতো ব্যবস্থা মহাবিদ্যালয়গুলিতে তৈরি করতে হবে।” এই দৃঢ়তা সভার মোড় ঘুরিয়ে দিল। তারপর আলোচনায় ঠিক হলো যে, পরিবেশবিদ্যা সবার পড়ানোর বিষয় কীভাবে হবে তার প্রস্তুতি নিতে হবে। এখনকার মতো কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার অবস্থা তখন ছিল না। কিন্তু এক্ষেত্রে একদিকে দৃঢ়তা এবং অন্যদিকে উপস্থাপনের দক্ষতা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম যা ছিল বিরল। গুণ কেবল সেই মানুষের মধ্যে দেখা যায় যিনি পঠনপাঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পোষণ করেন।
আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে যা দিয়ে বোঝা যাবে কতটা স্থিতধী ছিলেন অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। বাংলার আর একজন স্বল্প আলোচিত বিখ্যাত মানুষ ছিলেন ডঃ অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন আনন্দদেববাবুর স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্র। অজিতবাবু মেদিনীপুরের আরাবাড়িতে গ্রামবাসীদের সংগঠিত করে ভারতে প্রথম অরণ্য সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন। তখন ১৯৭৪-৭৫ সাল। অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মেদিনীপুরে অরণ্য গবেষণা (Sylviculture) বিভাগের আধিকারিক (ডিএফও)। সেই সময়ে অজিতবাবু অতি-বামপন্থীদের গোপনে সাহায্য করতেন। গ্রামের মানুষকে সংগঠিত করার কাজ একজন আমলার হবে এটা এদেশে খুব কম ক্ষেত্রেই যায়। ফলে যা হবার তাই হলো। তাঁকে চাকরি ছেড়ে বিদেশ যেতে হলো। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর অরণ্যরক্ষার উদ্যোগ আরও বিকশিত হয়। ফলে পরিবেশরক্ষার আন্তর্জাতিক সন্মান “পল গেটি” পুরস্কার পায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অজিতবাবু দেশে ফেরার পর আবার যৌথ বন পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে গবষণায় যুক্ত হন। আমি তাঁর সঙ্গী। অজিতবাবু বামপন্থী শিক্ষক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের গুণগ্রাহী ছিলেন। অজিতবাবুর অনুরোধে আমি উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলাম। যেদিন বিকালে সাক্ষাতের সময় সেদিন সকাল থেকে প্রায় সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দপ্তরে ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছিল। শুনলাম শিক্ষাকর্মীরা ডেপুটেশন দিচ্ছেন। সবশেষে আমরা যখন উপাচার্যের ঘরে ঢুকলাম তখন টেবিলের কাঁচ ভাঙা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসবাবপত্র ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও আমদের সঙ্গে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কথা হলো। বিচলিত হওয়ার বা অবসাদের কোনো লক্ষণ নেই। ঠিক এমনটাই দেখেছিলাম যখন তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়।
“দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ”-এর চেয়ারম্যান হিসাবে সমুদ্রবিজ্ঞানী আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের দূরদর্শিতা ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের। যখন সেই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাঙ্ককে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য নথি তৈরি হচ্ছে তখন একজন গবেষক হিসাবে বিজ্ঞানের গবেষণার ফসলের প্রয়োগ কীভাবে করতে হয় তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কেবল ভূতত্ত্ব বা সমুদ্রবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ হিসাবে নয়, বাস্তুতন্ত্রে সমস্ত শাখার গবেষকদের এই কাজে লাগিয়ে ছিলেন। একজন গবেষক সংগঠক কেমন হওয়া উচিত তা তাঁর কাছ থেকেই শিখতে হয়। এমন একজন অত্যন্ত যুক্তিবাদী, দৃঢ়চেতা মানুষকে যতো দেখেছি ততোই অবাক হয়েছি। তাঁর সামনে যেই থাকুন না কেন, কোনো ধরনের সমালোচনা এড়িয়ে যেতে চাইতেন না। একজন সংগঠক হিসাবে এডুকেশনিস্ট ফোরাম তৈরি করার মুখ্য উদ্যোগ তাঁরই ছিল। প্রত্যেককে নিজেদের খরচে জেলায় জেলায় আক্রান্তদের পাশে সংগঠিতভাবে দাঁড়াতে উৎসাহিত করার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। মহামারীর ছোবলে এমন একজন মানুষ হারিয়ে গেলেন যাঁর অভাব আমাদের চিরদিন অনুভূত হবে। আগামীদিনে চলার পথে এই অনুভূতি আমাদের তাগিদ হয়ে উঠবে, এটাই কাম্য।