E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১০ম সংখ্যা / ১৬ অক্টোবর ২০২০ / ২৯ আশ্বিন ১৪২৭

কোয়াডের (চতুর্দেশীয় জোটের) খপ্পরে

প্রকাশ কারাত


৬ অক্টোবর টোকিওতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রে‍‌লিয়া এবং ভারত - এই চারটি দেশকে নিয়ে মন্ত্রীপর্যায়ে একটি চতুর্দেশীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই চতুর্দেশীয় গোষ্ঠী যা কোয়াড (চতুর্ভুজ) নামে পরিচিত, সেটি চীনকে লক্ষ্য করে একটি সামরিক জোটের আকার নিচ্ছে।

বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সেপ্টেম্বর মাসে বলেছেন, ভারত কোনো ‘জোট ব্যবস্থার’ অংশ হবে না। কিন্তু, ‘কোয়াড’কে ঘিরে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে তার সাথে ‍‌বিদেশমন্ত্রীর ঘোষণা মিলছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক কৌশলগত জোট যেভাবে গড়ে উঠছে তার সামগ্রিক অভিমুখ সম্পর্কে মোদী সরকার যথেষ্ট লুকোছাপা এবং দু’মুখো কথার আশ্রয় নিয়ে চ‍‌‍‌লেছে।

কোনো কোনো ধারাভাষ্যকার মনে করছেন, কোয়াডের অংশ হয়ে তারসাথে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে পড়ার ভারতের যে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে, তা হলো লাদাখে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদে জড়িয়ে পড়ার ফল। তাঁদের মতে, চীনের সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা জোটে যোগ দিতে ভারত বাধ্য। কার্যত, সামরিক কৌশল বিশেষজ্ঞ এবং মার্কিন সমর্থক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকেই ওই মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু এই ব্যাখ্যার মধ্যে কোনো সত্যি নেই। লাদাখে সাম্প্রতিক বিবাদ শুরুর অনেক আগেই ভারত চতুর্ভুজীয় জোটের পূর্ণ অংশীদার হবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামার দি‍‌ল্লি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ‘‘এশীয়-প্রশান্তমহাসাগরীয় এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলের জন্য যুক্ত সামরিক কৌশলগত দূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি’’ নামে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই যৌথ বিবৃতির মধ্যে দিয়ে তখনই ভারত ওই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক কৌশলের পুরোপুরিভাবে সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। ওই বিবৃতির অভিমুখ তখনই স্পষ্টভাবে বোঝা গিয়েছিল, কারণ তাতে বলা হয়েছিল - ‘‘সমগ্র অঞ্চলব্যাপী, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং নৌ চলাচলের ও আকাশপথে বিমান চলাচলের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার গুরুত্বকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানাচ্ছি।’’ ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব লিওন পানেত্তার ভাষায় ওবামা শাসনে এশিয়ায় মার্কিন ঘাঁটির একটি ‘খুঁটি’ হলো ভারত।

কোয়াড (চতুর্দেশীয় জোট) গড়ে তোলার চেষ্টার ইতিহাস এর আগেও খুঁজে পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের উদ্যোগে কোয়াড (চতুর্দেশীয় জোট) গড়ার প্রথম চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু চীন ওই উদ্যোগে আপত্তি জানালে এবং ভারত সহ অন্যান্য অংশীদার দেশগুলিকে রাজনৈতিক বার্তা পাঠালে সেই পরিকল্পনা তখন থমকে গিয়েছিল। অস্ট্রে‍‌লিয়ার নতুন সরকার এবং মনমোহন সিংয়ের সরকার ওই উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে আসে।

কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোট গঠনের উদ্যোগ আবার শুরু হয় ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে যখন ম্যানিলায় আসিয়ান (ASEAN) শীর্ষবৈঠকে যোগ দিতে এসে ওই চার দেশের নেতারা পৃথকভাবে মিলিত হয়েছিলেন এবং নতুন করে উদ্যোগ শুরু করার সিদ্ধান্ত করেছিলেন। ইতিমধ্যে, ওই চার দেশেই দক্ষিণপন্থী সরকার গড়ে উঠেছিল এবং তাদের প্রত্যেকেরই চীনের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে কোনো আদর্শগত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। আসিয়ান শীর্ষবৈঠকের পরেই ওই উল্লেখিত চারদেশের যে বৈঠক হয়েছিল সেখানে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের এক যুগ্মসচিব উপস্থিত ছি‍‌লেন।

মার্কিন চাপে কোয়াড মঞ্চকে মন্ত্রীপর্যায়ের স্তরে উন্নীত করা হয়েছিল এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক চলাকালীন সময়েই আলাদা করে ওই চারদেশের প্রথম মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এশীয়-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং সামরিক কশলগত প্রভাব বৃদ্ধিকে ঠেকাতেই যে ওই অংশীদারিত্ব গড়ে উঠেছিল তাতে কোনো ধোঁয়াশা ছিল না। ‘‘স্বাধীন এবং অবাধ ইন্দো-প্রশান্তমহাসাগরীয়’’ অঞ্চল গড়ে তোলার‍‌ যে কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলতে শুরু করেছিল, সেটাই ছিল কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোটকে পুনরুজ্জীবিত করার ভিত্তি।

মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আগে ২৫ সেপ্টেম্বর চারদেশের বিদেশমন্ত্রকের অফিসাররা আলোচনায় বসেছিলেন। তাঁদের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে - বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং সামরিকক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে চীনের ক্রমাগত বিবাদ বৃদ্ধির কারণেই কোয়াডকে নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বৈঠকের পর যে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল তাতে জানা যায়, ‘পঞ্চম প্রজন্ম (৫-জি) অন্তর্জাল বিন্যাসের জন্য কিভাবে বিশ্বস্ত বিক্রেতাদের সাহায্য এবং ব্যবহার করা যায়’ - বিশেষভাবে সেই বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। আমেরিকার স্পষ্ট কর্মসূচিই ছিল হুয়াবেই থেকে ৫-জি প্রযুক্তি রপ্তানির পথ বন্ধ করা; সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। আলোচনার অন্যান্য বিষয় ছিলঃ সন্ত্রাসরোধ, সাইবার ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিষয় এবং ওই অঞ্চলে উন্নত গুণমানের পরিকাঠামো নির্মাণ।

ট্রাম্প প্রশাসন আশা করে ভারতকে এই জোটে টেনে আনতে পার‍‌লে এশীয়-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা জোট গড়ে তোলা সুনিশ্চিত হবে; এটা নিশ্চিত করতেই এই অঞ্চলের নতুন নামকরণ হয়েছে ইন্দো-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-প্রশান্তমহাসাগরীয় কম্যান্ড নাম পরিবর্তন করে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইন্দো-প্রশান্তমহাসাগরীয় কম্যান্ড নামকরণ হয় তখন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে ভারত সরকার এক প্রবীণ সামরিক অফিসারকে পাঠিয়েছিল।

সামরিক জোটের কাঠামো কেমন হবে তা’ও ঠিক করে ফেলা হয়েছিল। ২০১৬ সালেই ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লজিস্টিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে‍‌ছিল; যার নাম দেওয়া হয়েছিল লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমোরান্ডাম অব এগ্রিমেন্ট (LEMOA)। এই চুক্তি করা হয়েছে যাতে দু’দেশের সামরিক বাহিনী মেরামতি, জ্বালানি ভর্তি, এবং পরিষেবার জন্য একে অপরের দেশের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে। জোট শরিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির যে নাম ব্যবহার করে তা হলো - অধিগ্রহণ এবং পারস্পরিক পরিষেবা চুক্তি। বাস্তব হলো কোয়াডকে (চতুর্দেশীয় জোটকে) যদি চারটি দেশের মধ্যেকার পূর্ণাঙ্গ সহযোগী হয়ে উঠতে হয়, তবে ভারতকে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হয়ে থাকলে চলবে না; অস্ট্রে‍‌লিয়া এবং জাপানের সঙ্গেও একইভাবে লজিস্টিক (সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের) চুক্তি করতে হবে। লাদাখে গত মে মাসে বিবাদ দেখা দেবার অনেক আগেই এইসব আলোচনা সেরে ফেলা হয়েছে। জুন মাসেই ভারত অ‍‌স্ট্রেলিয়ার সাথে চলাচল এবং সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার সম্পর্কিত লজিস্টিকস সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার ফলে দুই দেশই মেরামতি ও সরবরাহের জন্য একে অপরের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে।

৯ জুন ভারত জাপানের সঙ্গে একইরকম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির মোদ্দা বিষয়টি হলো, ভারত ও জাপানের সেনাবাহিনীর আত্মরক্ষক সেনারা সরবরাহ এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে পরস্পর সহযোগিতা করবে। এইসব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই ভারত কোয়াডের (চতুর্দেশীয় জোটের) অন্য তিন শরিকের সঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে; এই চুক্তি হলো সামরিক চলাচলের ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং শরিকদের মধ্যে পারস্পরিক কাজের সুবিধা বৃদ্ধি।

এতকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পরেও যদি বলা হয় ভারত কোনো সামরিক জোটের বা জোটব্যবস্থার অংশীদার হবে না, তা’হলে সেটি হবে মানুষকে বোকা বানাবার দক্ষ কারসাজি। এই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ট্রাম্পের ভারত সফরের সময়েই যে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতেই চতুর্দেশীয় মঞ্চকে শক্তিশালী করে তোলার কথা বলা হয়েছে।

কোয়াড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী সুবিধা চায় তা খুবই স্পষ্ট। ৩১ আগস্ট মার্কিন-ভারত সামরিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব মঞ্চের সভায় মার্কিন বিদেশ উপসচিব স্টিফেন বাইগান মার্কিন পরিকল্পনা খোলাখুলি প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো, এইভাবে এশিয়ায় ন্যাটো (NATO) তৈরি করা। অর্থাৎ, এশিয়ার বুকে ন্যাটোর মতো জোট তৈরি করা।

স্টিফেন বাইগান আরও বলেছিলেন, ‘‘ইন্দো-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে বাস্তবে কোনো বহুপক্ষীয় শক্তিশালী কাঠামোর বড়োই অভাব। ন্যাটো (NATO) বা ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতাও তাদের নেই। আমার মনে হয়, এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলিও যথেষ্ট সর্বব্যাপক নয়; সেই কারণেই একটা সময়ে নিশ্চিন্তভাবেই আমন্ত্রণ আসবে যাতে সেখানেও এইরকম একটা কাঠামো গড়ে তোলা যায়। মনে রাখবেন, যখন ন্যাটো গড়ে উঠেছিল তখনও তুলনামূলকভাবে খুবই সীমিত আশা পোষণ করা হয়েছিল, প্রাথমিক অবস্থায় অনেক‍‌ দেশই ন্যাটোর সদস্যভুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল।’’

বাইগান অবশ্য বলেছিলেন, এইরকম প্রশান্তমহাসাগরীয় ন্যাটো গড়ে উঠতে পারে, যদি ওই অঞ্চলের দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই ওই বিষয়ে একইরকমভাবে আগ্রহী এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

ওই বৈঠকেই বাইগান জানিয়েছিলেন, কোয়াডের মন্ত্রীপর্যায়ের পরবর্তী বৈঠক আগামী শরতে নতুন দি‍‌ল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে; কিন্তু ভারত সরকার তখনও পর্যন্ত ওই বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছুই জানায়নি। বাইগান যখন প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন কোয়াডের পরবর্তী মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠক অক্টোবর মাসে দিল্লিতে অনু‍‌ষ্ঠিত হবে, একমাত্র তখনই ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ওই বৈঠক স্থির হওয়ার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই বৈঠকের স্থান পরিবর্তিত হয়ে টোকিওতে স্থির হয়েছিল। মোদী সরকারের মনোভাবের পরিবর্তনই কি এর কারণ?

টোকিওতে কোয়াডের বৈঠকের উদ্বোধনী ভাষণে মার্কিন ‍বিদেশসচিব মাইক পম্পিও বলেছি‍‌লেন, ‘‘‍‌কোয়াডের শরিক হিসাবে আমি মনে করি বর্তমান সময়টা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) শোষণ, দুর্নীতি এবং গা-জোয়ারি থেকে আমা‍দের জনগণ ও শরিকদের রক্ষা করতে সহযোগিতায় মিলিত হয়েছি।’’

বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর যে কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিলেন, সেই কথা আমাদের প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল ‍‌বিপিন রাওয়াত প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন। তিনি ৩ সেপ্টেম্বর বলেছেন, ভারত বিশ্বাস করে ভারত মহাসাগর এবং তার চারপাশের সমুদ্রগুলিতে ‘‘অবাধ নৌ-বাহিনী চলাচল সুনিশ্চিত করতে কোয়াড একটি খুব ভালো বন্দোবস্ত হয়ে উঠবে।’’ এটি কার্যকর করতে হলে বর্তমানের চলতি যৌথ মহড়ায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এর জন্য দরকার নৌ-বাহিনীগুলির যৌথ সক্রিয় কার্যক্রম।

২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা কাঠামো চুক্তি প্রথম স্বাক্ষর হবার পর থেকেই, ক্রমে ক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে এবং আমাদের বিভিন্ন সেনাবাহিনীর নানা অংশের সর্বোচ্চস্তরের কর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক জোট গড়ার প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন।

ঠিক ওবামার আমলের ‘এশিয়ার ঘাঁটি’র মতোই কোয়াড চীনকে ঘিরে ফেলার লক্ষ্যে একটি সামরিক কৌশলগত পরিকল্পনা পূরণ করতে চলেছে। এই সামরিক কৌশলগত পরিকল্পনার সঙ্গী হয়ে ভারতের কিছু লাভ হবে না। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থসমূহের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরের কোনো সম্পর্ক নেই। তা সত্ত্বেও, কেন ভারতীয় নৌ-বাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন এবং জাপানি নৌ-বাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায় যোগ দেবে? লক্ষ্য করার ব্যাপার, চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিবাদ প্রশ্নে কিন্তু কোয়াডের কোনো শরিক দেশই ভারতকে সামরিক সমর্থন দেবার কথা বলছে না। দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলবর্তী এবং আসিয়ানভুক্ত আঞ্চলিক দেশসমূহ যারা দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে বিবাদে সত্যিসত্যিই উদ্বিগ্ন তারা কিন্তু কেউই এই মার্কিন-অনুপ্রাণিত কোয়াডে যোগ দিতে ইচ্ছুক নয়। এই দেশসমূহের কেউই চীন-বিরোধী কোনো গোষ্ঠীতে যোগ দিতে চায় না কারণ, তারা জানে এতে তাদের দেশের কোনো স্বার্থসিদ্ধি হবে না। ওই অঞ্চলের একটি বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইন্দোনেশিয়া - যারা দক্ষিণ চীন সাগরকে নিয়ে বিবাদে যুক্ত হয়ে আছে, তারাও ওই চীন-বিরোধী উদ্যোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে।

যে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পথে যেতে চাইছে, ঠিক সেই সময়েই মোদী সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দহরম-মহরম বাড়াচ্ছে; এর ফলে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর অবনত পরিস্থিতির উপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গত ছয় মাসের ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, সীমান্ত-প্রশ্নে চীন যে অবস্থান নিয়েছে, তার পিছনেও রয়েছে জম্মু এবং কাশ্মীরের মর্যাদা পরিবর্তনে ভারতের গৃহীত পদক্ষেপ এবং চীনের বিরুদ্ধে সামরিক কৌশল গ্রহণে ভারত-মার্কিন জোটের কাছাকাছি আসার ঘটনা।

জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য ভারতের প্রয়োজন হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার শরিকদের চীন-বিরোধী কোনো জোট বা গোষ্ঠ‍ীতে যোগ না দিয়ে সীমান্তের চলতি বিবাদ মীমাংসার জন্য চীনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী না হয়েও এই সমস্যা মোকাবিলার সম্পদ ও সক্ষমতা ভারতের আছে।

চীনের তরফেও এ কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে দেখা দরকার, ভারতকে আমেরিকার দিকে ঠেলে দিয়ে তার স্বার্থই বা কতদূর রক্ষিত হবে! প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (LAC) - যা খুবই অস্পষ্ট এবং দু’দেশের অস্থায়ী সীমান্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, সেখানে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এশিয়ার দুই মহান প্রতিবেশী দেশের স্বার্থকেই ক্ষুণ্ণ করবে; আমাদের এই গ্রহের সমগ্র মানবসমাজের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য একুশ শতকে এই দুই মহান প্রতিবেশী দেশকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের দায়িত্ব নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বের মোট জনসমষ্টির এক-তৃতীয়াংশ এই দুই দে‍‌শেই বসবাস করে।