৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
দুর্নীতি চুরি এবং লুটের তদন্ত, দোষীদের শাস্তির দাবিতে সিজিও দপ্তর অভিযানে শামিল হাজার হাজার মানুষ
ব্যর্থ সরকারি বাধা ও চক্রান্ত
সিজিও দপ্তর অভিযানের সমাবেশের একাংশ।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ চোরেদের জেলের বাইরে রাখা চলবে না। সব চোরদের ধরতে হবে। রাজ্যের গ্রাম-শহর জুড়ে দুর্নীতি বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে প্রশাসনকে বাধ্য করতে হবে বাকিদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিতে হবে। তৃণমূল বিজেপি দু’দলেরই দুর্নীতিগ্রস্তদের গ্রেপ্তার করতে হবে। লুটের টাকা মানুষকে ফেরত দিতে বাধ্য করতে হবে। আদালতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাস্তায় নামতে হবে। বিধান নগরের কেন্দ্রীয় সরকারের অফিস সিজিও কমপ্লেক্স অভিযানের সভায় একথা বলেন বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। সল্টলেকে এদিনের সভার আয়োজন করতে দিতে রাজি ছিল না পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু বামফ্রন্ট নেতৃত্ব সভা করার প্রশ্নে অনড় ছিলেন। পরিস্থিতি আঁচ করে এবং সুবিশাল জমায়েতের মেজাজ দেখে পুলিশ প্রকাশ্যে এদিন কোনো সঙ্ঘাতে যায়নি আয়োজকদের সাথে।
সিজিও অভিযানের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন বিমান বসু। মঞ্চে নেতৃবৃন্দ।
বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, এরাজ্যে কেলেঙ্কারি দুর্নীতির পাহাড় তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই তার খবর বেরোচ্ছে। আমরা দেখছি ইডি-সিবিআই এই সব কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করলেও তা বন্ধ করে দিচ্ছে শেষ মুহূর্তে। সারদা-নারদার মতো বহু মামলার আমরা শেষ দেখতে পাই না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। এই চুরির বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে আমাদের। কিন্তু পুলিশ আমাদের বাধা দিচ্ছে অগণতান্ত্রিকভাবে। আমাদের সভা রুখতে সিজিও কমপ্লেক্সের কাছে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এখানে তৃণমূল সরকার আমাদের সভা করতে দেবার অনুমতি দেয়নি, ছোটো মঞ্চ করতে বাধ্য করেছে। রাজ্যের তৃণমূল সরকার স্বৈরাচারের পথে হাটতে চাইছে। আমাদের এই অধিকার রক্ষার শপথ নিতে হবে। গ্রামে শহরে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমাদের মুখর হতে হবে। আমরা গণতন্ত্র হত্যা করতে দেব না।
বামফ্রন্টের ঘোষিত কর্মসূচিকে বানচাল করবার জন্য এদিন যাবতীয়-অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ করেছে রাজ্যের পুলিশ। মঞ্চ তৈরিতে বাধা দেওয়া সহ ডেকরেটরের কর্মীদের সরঞ্জাম সহ বিনা দোষে আটক করা ইত্যাদি একাধিক পদক্ষেপ করে পুলিশ বুঝিয়ে দিয়েছে তারা প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে চায়। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই বামফ্রন্ট নেতৃত্ব এদিন বিধাননগরের ন্যাশনাল বুক এজেন্সি এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় সভার আয়োজন করা হয়।
সিবিআই কমপ্লেক্স ঘেরাও অভিযানের এই সমাবেশ আয়োজিত হয় স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল বুক এজেন্সি সংলগ্ন চত্বরে। পুলিশ এদিন শুরু থেকেই তৎপর ছিল বামফ্রন্টের সভা ভেস্তে দেওয়ার জন্য। এদিন আগে থেকেই সিজিও কমপ্লেক্স চত্বরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় যেখানে বামফ্রন্ট আগেও সভা করেছে। কিছুদিন আগে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই পো-সাংসদ, সারদাখ্যাত কুনাল ঘোষ সহ তৃণমূলের নেতারাও সভা করেছে। সেখানে বামফ্রন্টকে সভা করতে না দিতে চক্রান্ত করে তৃণমূল সরকারের প্রশাসন। ডেকরেটরের কর্মীদের মালপত্রসহ তুলে নিয়ে যায় পুলিশ।
সভায় সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র রাজ্যের দুর্দশায় দিন কাটানো কর্মহীন মানুষের পাশাপাশি তৃণমূলের লুটের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী, আপনার চেয়ে কে বেশি জানেন কোন খানে কার টাকা কে রেখেছে? কে নিয়েছে? কত টাকা কালীঘাটে গেছে তার নিষ্পত্তি করতে হবে! এখানে যিনি টাকা নিয়ে ধরা পড়ছেন তৃণমূলের নেতা, তিনি বিজেপি-তে চলে যাচ্ছেন। আবার ওখান থেকেও এদিকে আসছেন। তৃণমূল এবং বিজেপি’র মধ্যে নেতাদের যাতায়াত লেগে আছে। আরএসএস তৃণমূল নেত্রীকে দুর্গা বলেছিল আর তিনি আরএসএস-কে দেশপ্রেমিক বলেছিলেন। এখন তিনি বলছেন আরএসএস খারাপ নয়। তাই দুই শক্তির মধ্যে পার্থক্য না করে দুই এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে মানুষকে একজোট করতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, এখানে যেমন চোরেদের সরকার চলছে, দিল্লিতে যারা সরকার চালাচ্ছেন তারা ডাকাত। তারা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেছে দিচ্ছেন, বিদেশি বিমান কেনার থেকে কমিশন নিচ্ছেন। রাজ্যের নেতাদের দলবদলের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, যে মানুষ তৃণমূল আর বিজেপি’র সঙ্গে আছেন তাঁরা চিরকাল ওখানে থাকবেন না। তৃণমূলের ওপর রাগে বহু মানুষ বিজেপি-কে সমর্থন করছে, আবার বিজেপি’র উপর রাগে বহু মানুষ তৃণমূলকে সমর্থন করছে। এই সাধারণ মানুষকে আমাদের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। তবেই তারা লালঝান্ডার পাশে আসবেন। লুটের টাকার পাই পয়সা আদায় করতে হবে, যাঁদের টাকা লুট হয়েছে তাঁদের ফেরত দিতে হবে। বিজেপি-কে পরাস্ত করতে হবে, বিচ্ছিন্ন করতে হবে। পরাস্ত করতে হবে তৃণমূলকে। মানুষ ইতিহাস তৈরি করেন। লড়াই ছাড়া পথ নেই।
সিজিও অভিযানের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন মহম্মদ সেলিম। মঞ্চে নেতৃবৃন্দ।
এদিনের সভার মুখ্য বক্তা সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সভাস্থল ঘিরে পুলিশের অসহযোগিতার চক্রান্তের প্রসঙ্গে শুরুতেই পুলিশকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পুলিশ এখানে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। আমরা সিবিআই-এর কাছে দুর্নীতি এবং চুরি ও লুটের তদন্তের দাবিতে অভিযান করছি। রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে নয়। পুলিশ কী চায়? ওরা কী চায় যে আমরা মিছিলের মুখটা অভিযানের মুখটা বিধান নগর কমিশনারেটের দপ্তর অভিমুখে ঘুরিয়ে দিই? এই সভার মঞ্চের মাপ পুলিশ ঠিক করে দিতে পারে, কিন্তু জমায়েতের মাপ ঠিক করব আমরা।
রাজ্যের চুরি এবং দুর্নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চোরেদের শুধু জেলে ভরলেই হবে না, শিক্ষক নিয়োগের টাকা, তোলাবাজির টাকা সব টাকা ফেরত দিতে হবে। তৃণমূল নেত্রী দোলা সেন বলেছিলেন ২৫ পার্সেন্ট টাকা নিয়ে ৭৫ পার্সেন্ট টাকা জমা দিতে হবে। তাই মনে রাখবেন, যা বেরিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় তা মাত্র চার আনা। বাকি ১২ আনাও বের করতে হবে। ১৬ আনা উশুল করতে হবে। কেউ নিস্তার পাবে না।
বাগুইআটির দুই কিশোরের অপহরণ ও মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলার পুলিশ উর্দি ছেড়ে এখন তৃণমূলের দালালি করছে। যদি উর্দিধারী পুলিশ হতো তাহলে দুটি তরতাজা ছোটো ছেলে অতনু এবং অভিষেককে বাঁচাতে পারতো। এই পুলিশ ওদের অপহরণের ডায়েরি নেয়নি। কোনো এমএলএ-এমপি বাগুইআটির ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, এমনকী দেহ উদ্ধারের খবর তার বাবা-মায়েদের দেয়নি।
মুখ্যমন্ত্রীর কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি বলেন, দুর্নীতি একা একা হয় না। দুষ্কৃতী লাগে। উনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফোন করে বিডিও-এসডিও-দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এমন জাহির করেন, কিন্তু আসলে উনি অনুব্রতদের মতো দুষ্কৃতীদের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন। উনি বিজেপি’র বিরুদ্ধে বলেন কিন্তু উনি প্রথম গুজরাট গণহত্যার পর ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলেন, আর এখন উনি পাঞ্জাবি সেলাই করছেন মোদি-মোহন ভাগবতকে পাঠাবেন বলে। কারণ উনি জানেন ইডি-সিবিআই চলে মোদি শাহদের কথায়।
তিনি বলেন, হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী, রাজবংশী, মহিলা-পুরুষ, হিন্দিভাষী-উর্দুভাষী - মানুষকে এরকম নানাভাবে আলাদা দ্বীপে ঠেলে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করেছে বিজেপি-তৃণমূলের রাজনীতি। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের একজোট হতে হবে, আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে।
সিপিআই নেতা স্বপন ব্যানার্জি বলেন, রাজ্যে তৃণমূলের শাসনে মানুষের জীবন জীবিকা বিপন্ন, নিরাপত্তা নেই। মুখ্যমন্ত্রী গোরু চোরকে বীরের মতো সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন, আর আরএসএস গান্ধীজির হত্যাকারীকে বীর বলেছে। এদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কি প্রত্যাশা করা যেতে পারে! এরাজ্যে আইনের শাসন নেই। পুলিশের একটা বড়ো অংশ তৃণমূলের দলদাস।
এদিনের সভা ঘিরে পুলিশি জটিলতার প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) নেতা পলাশ দাশ বলেন, মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কিন্তু দুর্নীতি বিরোধী সভা করা যাবে না বলছে প্রশাসন। প্রশাসনের অনুমতির এই বাহানা উড়িয়েই এদিন সভা আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু মঞ্চের মাপ পুলিশ বারবার পরিদর্শনে এসে ছোটো করতে বাধ্য করে। এমনকী মঞ্চের পেছনে ব্যাকড্রপ লাগাতে দেওয়া হবে না বলেও তারা হুমকি দিয়েছিল। এসব করার জন্য পুলিশকে প্রশ্ন করি, মঞ্চ ছয় ইঞ্চি ছোটো করলে কি অনুব্রত মণ্ডল ছাড়া পাবে বা অভিষেক ব্যানার্জির গা থেকে কয়লার কেলেঙ্কারির অভিযোগের দাগ মুছে যাবে? পুলিশ তার কোনো উত্তর দিতে পারেনি।
এদিনের সভায় বক্তব্য রাখেন আরএসপি নেতা অশোক ঘোষ এবং ফরওয়ার্ড ব্লক নেত্রী ডলি রায়। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বলশেভিক পার্টির নেতা প্রবীর ঘোষ এবং মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা জয় হিন্দ সিং প্রমুখ।