৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
৩১ আগস্ট বর্ধমানে জনগণের ক্ষোভ-যন্ত্রণাকে চাপা দিতেই দমন-পীড়নের পথ নিয়েছিল সরকার
পৃথা তা
বর্ধমানে গণ-আন্দোলনের শহিদ দিবসের দিন লালঝাণ্ডা আইন অমান্য-র ডাক দিয়েছিল। লাল ঝাণ্ডার পার্টির ডাকে গ্রাম শহর ঝেঁটিয়ে কাতারে কাতারে লোক এসেছিল। এসেছিল হিসাব চাইতে ৷ আর সেই আইন অমান্য করতে যে আইন আইনের রাস্তায় চলে, যা অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের বানের জলে ভেসে যাওয়া দেখতে পায় না। সেই আইন, যার সাহায্য নিয়ে কাতারে কাতারে বামপন্থী মানুষদের অকারণ মামলার মালা পরিয়ে বারবার কোর্টে দৌড় করানো হয়, ঘরছাড়া হয়ে থাকতে হয়। সেই আইন যেখানে পরিবর্তনের পর এতগুলো ‘সরকারি’ খুনের কোনো কিনারা হলো না। বর্ধমান সহ রাজ্যের কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করল, আজও পারলো না যে আইন তার বিচার করতে, তার বিরুদ্ধে।
পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার ক্ষতির খতিয়ান লম্বা। ঘর পুড়িয়ে, খেতের ফসল পুড়িয়ে, ধানের মরাই পুড়িয়ে, গবাদি পশু সমেত গোয়াল পুড়িয়ে একশেষ করেছে সরকারি ছাতার নিচে থাকা দল। একের পর এক কারখানার সাড়ে সর্বনাশ করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প শেষ করে দিয়েছে। কাটোয়া আর কালনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁত শিল্প ব্যাপক প্রসারিত হয়েছিল। কালনা অঞ্চলের দিকে মোটা সুতা মূলত গামছা চাদর বেডকভার পর্দা এসব, আর কাটোয়া অঞ্চলে হতো চিকন সুতা বা সরু সুতার কাজ। মূলত শাড়ি। ফুলিয়ার সাথে সাথে এই অঞ্চলের শাড়িরও কদর ছিল খুব গৃহস্থ ঘরে। স্বপন দেবনাথ মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর দায়িত্ব নিয়ে সবটা শেষ করে দিলেন। তাঁত শিল্পীরা এখন অনেকে বিড়ি শ্রমিক। আর অনেকে ‘মদন যেদিন গামছা বুনবে’র জেদ নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক।
আইনের কাছে বিচারের আশায় এখনো এরা সবাই বসে আছে।
জেলা জুড়ে এর মধ্যে ঘটে গেছে একের পর এক নারীঘটিত অপরাধ। ধর্ষণ খুন। নারী পাচার। দলে দলে বেড়েছে স্কুলছুট। কেতুগ্রাম, খণ্ডঘোষ, মঙ্গলকোট, রায়না বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অদ্ভুতভাবে বেড়ে গেছে শিশুশ্রমিক। মা ও শিশুদের তীব্র অপুষ্টি। গর্ভবতী মায়েদের জন্য গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো চিকিৎসা নেই, একটা রেগার কাজ, একটা জবকার্ড করার জন্য পায়ের শুকতলা ক্ষয় করেও ফল মেলে না, অথচ রাজ্যে দুর্গা পুজো করার অনুদান বেড়ে যায়, মন্ত্রীর বান্ধবী, সাঙ্গোপাঙ্গদের ঘর থেকে টাকার পাহাড় পাওয়া যায়।
বর্ধমান শহরের মধ্যে বাসস্ট্যান্ডের জমিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি, পৌরসভাকে কার্যত ঘুঘুর বাসাতে পরিণত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থনৈতিক তছরুপ, শহরের মধ্যে যান চলাচলের চরম অব্যবস্থা, নির্বাচন হতে না দেওয়া পৌরসভাতে, বিধায়কের দাগী আসামির মতো গলায় হুমকি দেওয়া বিপক্ষ দলকে, হাসপাতালকে কেন্দ্র করে ওষুধ দুর্নীতি ও অর্থের বিনিময়ে রোগী ভরতি করা ও নানা বেআইনি কাজের আখড়া গজিয়ে উঠেছে।
আইন গান্ধারী সেজে থাকে। চোখ বেধে ভালো স্ত্রী হতে গিয়ে একশোটা অপদার্থ লম্পট পুত্রের মা হতে হয়েছিল গান্ধারীকে। তবু রাষ্ট্র ধৃতরাষ্ট্র আর আইন গান্ধারী হয়ে থাকতে চায়।
তাই বর্ধমান রাস্তায় নেমেছিল। এত বঞ্চনা এত অপমানের হিসাব চাইতে। আশা করে আমরা বসেছিলাম না যে আমাদের গোলাপের তোড়া আর মিষ্টি নিয়ে অভিবাদন জানাবে পুলিশ। এটা চটকদারি দেখানোর আইন অমান্যও ছিল না যে থানায় গিয়ে কোল্ডড্রিংস খাওয়াবে পুলিশ।
আইন না মেনে টিয়ার শেল দিয়ে শুরু হলো ছত্রভঙ্গ করার কাজ। তারপর বেআইনিভাবে মার। শিশু কিশোর বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই।
কালনার মহিলা আন্দোলনের নেতা জনাদিকে গালে থাপ্পড় মারা হয়। ওই হাত চিনে রেখেছি আমরাও। কার্জন গেটের উল্টো দিকের বিধায়কের অফিসের ছাদ থেকে উড়ে এলো ইট পাটকেল, ফুলের টব মিছিলের লোকের মাথায়। মাথা ফাটল।
পেট্রোল পাম্পের মধ্যে মেরে ফাটিয়ে দেওয়া হলো জয়ন্ত ভট্টের পা। পাঁচটা স্টিচ পড়ল। পুরুষ পুলিশ অকথ্য মারল মেয়েদের। ২৩ জন মেয়েকে থানায় তুলে আনল, চুলের মুঠি ধরে। থানায় আনার পর চোয়াল ধরে হুমকি দিল অফিসার নীতু সিং। মহিলা থানায় এক কমরেড অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরেও, পায়ে ব্যাপক মারধরের পরেও ওষুধ বরফ মেলেনি। ফ্যান বন্ধ করে, এসি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে আত্রেয়ী চক্রবর্তী, ঘুপচি ঘরে ২৩ জনকে ভরে। ফুটেজ কী করে আরটিআই করে বার করতে হয়, ফুটেজ মুছতে চাইলে কী করতে হয় জানি আমরাও। অকথ্য গালিগালাজ আর বারংবার ধর্ষণের হুমকি দেয় পুরুষ পুলিশ আমাদের মেয়েদের থানার ভিতর ও বাইরে।
আর বন্দি হয়ে গেল আমাদের নেতা আভাস রায়চৌধুরী সহ অনির্বাণ, সৌরভ সরকার, সঞ্জয় মৃধা, সোমলাল সোরেন, সুজিত হেমব্রম, চন্দু বাগদি, মিহির রাজবংশী, রামলাল টুডু, বিনকাশেম শেখ সহ ৪১ জন সহযোদ্ধা। একের পর এক বেলের আবেদন খারিজ হতে লাগল। মামলা সাজানো হলো এমন কায়দায় যে, আগের মামলায় জামিন হলেও একটা কেসের জেরে ১৪ দিনই আটক থাকতে হয়। পাবলিক প্রসিকিউটাররা জেলা জজ কোর্টে এসে জামিন আটকায়, তারা সিজিএম-এ এসে জামিন আটকানোর মরিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেল।
এত কিছুর পরেও কমরেডরা ১৪ দিনের কারাবাসের শেষে সূর্যের আলো দেখেছেন। লড়াই আরও জোরদার। কী কারণে জেলে গেছি কী কারণে মার খেয়েছি সবটা স্পষ্ট আমাদের, তাই ছাতি ঠুকে বলতে পারি। পয়সা নিয়ে চাকরি না দেওয়ার মার খেয়ে, গোরু চুরি, কয়লা চুরির কেসে হাসপাতালে ছুটে গ্রেপ্তার হয়ে মুখ লুকিয়ে ঘোরার প্রয়োজন এখানে নেই। লড়াই সবে শুরু। লড়াইয়ের নেশা আছে।
যে আইন বিলকিসের অপরাধীদের ছেড়ে দেয় আর ফুল্লরা মণ্ডল, অজিত পান্ডে, সুশান্ত ঘোষকে পিষে দিতে উদ্যত হয় তাকে অমান্য করতে আমরা আবার যাব। জন আদালতেই হবে চূড়ান্ত বিচার।