৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
বঞ্চনার বিরুদ্ধে ইনসাফের দাবিতে ২০ সেপ্টেম্বর কলকাতা দেখবে যৌবনের সমুদ্র হিল্লোল
কলতান দাশগুপ্ত
আগামী ২০ সেপ্টেম্বর কলকাতার ধর্মতলা আবার উত্তাল হবে যৌবনের সমাবেশে। সবার জন্য শিক্ষা ও কাজের দাবিতে, রাজ্যজুড়ে ঘটে চলা দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং বাংলার অন্যতম প্রতিবাদী যুবক আনিস খানের খুনীদের শাস্তির দাবিতে গোটা রাজ্যের ছাত্র যুবরা কলকাতায় আসছে। যেখানে চোরেরা সভা করে, আনিস খুনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নেতারা সভা করে... আমাদের সভা ঠিক ওইখানেই হবে।
বাংলার প্রতিবাদী যৌবনের অন্যতম নাম আনিস খান। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনিস খান। সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সেনানী। এই আনিস খানই পিএসসি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক অন্যতম সংগঠক।
আজব রাজ্য চলছে। মধ্যরাতে কোনো কারণ ছাড়াই বাড়িতে ঢুকে যাবে পুলিশ। বাবাকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখবে কেউ, বাকিরা ঘরে ঢুকে খুঁজবে ছেলেকে। ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে খুন করা হবে আনিসকে। আনিস খুনের ৯ ঘণ্টা পর পুলিশ খোঁজখবর নেওয়া চালু করবে। ততক্ষণে তো খুনের অনেক প্রমাণ স্বাভাবিকভাবেই লোপাট হয়ে যাবার সম্ভাবনা। হাওড়ার গ্রামীণ পুলিশের সুপার প্রথম দিনই ঘোষণা করবেন যে, পুলিশের কেউ আনিসের বাড়ি যায়নি। এই ঘোষণার দুইদিনের মাথায় ২ জন সিভিক পুলিশ গ্রেপ্তার হবে। বাকি ২ জন সিভিক পুলিশ ফেরার। এই রাজ্যে একাংশের সিভিক পুলিশের মধ্যে এখন পুলিশ কম, তৃণমূলের মস্তান বেশি। নানান গাড়ি থেকে তোলা আদায়, হুমকি, ভোটের সময় ছাপ্পা... কাজের আর শেষ নেই! একদিকে আনিসের বাবা বলছেন, এই ঘটনার পিছনে তৃণমূলের বড়ো মাথা লুকিয়ে আছে। আবার গ্রেফতার হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ার বলছে, আমরা বলির পাঁঠা হলাম। সিভিক আর তৃণমূলের গুন্ডাদের মধ্যে তো সামান্য তফাত থাকবে! তৃণমূল গুন্ডারা কে কবে কোন পাড়ায় তোলা তুলতে যায়,কেউ জানে না। কিন্তু কোন সিভিক কবে কোন পাড়ায় কেন যাচ্ছে, তার খবরও থাকছেনা থানায়।
আনিস খুনের কিছুদিন পর ‘মাননীয়া’ বললেন, আনিস নাকি ওর ‘ফেভারিট’ ছেলে ছিল! তো সেই ফেভারিট ছেলের মৃত্যুর ২০০ দিন কেটে গেল, তদন্ত একচুলও এগোলো না! উলটে আনিস খুনের ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ওর খুড়তুতো ভাই সালমানের উপর প্রাণঘাতী হামলা হলো মধ্যরাতে। পাড়ায় সালমানের বাবা জালেম খানের উপর আক্রমণ হলো। পুলিশ নিশ্চুপ। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তৃণমূল রিজওয়ানুর কাণ্ডে যে পুলিশ অফিসারের অপসারণ চেয়েছিল, তৃণমূল সরকার আনিস খানের খুনের ঘটনার তদন্তে সেই পুলিশ অফিসারকেই দায়িত্ব দেয়। মাননীয়া রিজওয়ানুরের মা'কে নিয়ে ইনসাফের দাবিতে মিছিল করবেন। রিজওয়ানুরের ভাই রুকবানুর তৃণমূলের বিধায়ক হবেন। ওদিকে আনিস খান মুখ্যমন্ত্রীর তথাকথিত ‘ফেভারিট’ ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সিট-এর তদন্ত একচুলও এগোবে না। এই পুলিশই সব ছাত্রদের পড়াশোনার অধিকার ও সঠিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অধিকার চাইতে আসা সুদীপ্তকে রাস্তায় ফেলে মেরেছিল। সব বেকারের জন্য কাজ চাইতে কলকাতায় মিছিলে যাওয়া মইদুলকে রাস্তায় পিটিয়ে খুন করে এই পুলিশ। তৃণমূল নেতারা কলকাতার আলিপুর থানা ঘেরাও করলে অবশ্য এই বীর পুলিশেরাই টেবিলের তলায় আশ্রয় নেয়।
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না! তো রাজনীতিটা করবে কে? কৌস্তুভ রায় বাবু! কে এই কৌস্তুভ রায়? আদালতে আর্থিক তছরুপের মামলায় অভিযুক্ত জেলফেরত আসামি কৌস্তুভ রায়। একটি টিভি চ্যানেলের কর্ণধার কৌস্তুভ রায় কোন পরিচয়ে মধ্যরাতে আনিসের বাড়িতে গেলেন। সরকারের তরফে চাকরি, টাকা, পুলিশি নিরাপত্তার টোপ দেওয়ার উনি কে? দুর্নীতি ইস্যুতে পার্থবাবু আর অনুব্রতবাবু জেল হেপাজতে যাওয়ার পর মনের ভিতরে ভয় ঢুকে গেছে তৃণমূলের। তৃণমূল নেতারা ভয় কাটাতে বলছেন, এই তো ২ জন জেলে গেল। দুর্নীতির সাথে নাকি তৃণমূল আপস করেনা! পার্থ চ্যাটার্জি গ্রেপ্তার হওয়ার ৫ দিন পর মমতা ব্যানার্জি তাকে মন্ত্রীসভা থেকে এবং দলের বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়েছেন। কিন্তু মাননীয়া অনুব্রতবাবুকে এখনো ‘বীরের’ সম্মান দিতে চান। খবরে প্রকাশ অর্পিতা মুখার্জি নাকি ইডি-কে জানিয়েছেন যে পার্থ চ্যাটার্জি তার এবং আরেক মহিলার বাড়িকে কালো টাকা রাখার ‘মিনি ব্যাঙ্ক’ হিসেবে ব্যবহার করত। এদিকে টালিগঞ্জ এবং বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটের সেই ‘মিনি ব্যাঙ্ক’ থেকে উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি কালো টাকা, অন্যদিকে গার্ডেনরিচে ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কোটি টাকার পাহাড় তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির মুখোশ খুলে দিয়েছে। এই মাফিয়াচক্র পার্থ চ্যাটার্জি এতদিন শুধু তার পরিচিতদের নিয়ে চালিয়ে গেছেন এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ১০০ দিনের কাজের জবকার্ড যার নামেই থাকুক, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সংযোগ থাকবে এলাকার তৃণমূল নেতাদের কাছে। ৩-৪ মাস পর পর যে টাকা ঢুকবে, তার ৫-১০শতাংশ টাকা আসল প্রাপক পাবেন, বাকিটা চলে যাবে তৃণমূলের নেতাদের পেটে। মন্ত্রীসভার বা তৃণমূল কংগ্রেস দলের কোনো দায় নেই - এটা আজ কেউ বিশ্বাস করবে না। তৃণমূল গত ১১ বছর ধরে এই রাজ্যে দুর্নীতির যে মেশিন বসিয়েছে, পার্থ বা অনুব্রত সেই মেশিনের নাটবল্টু বড়োজোর হতে পারেন, আসল মেশিন রয়েছে কালীঘাটে।
মাননীয়া ভোটের সময়ে বলবেন, ‘‘যে গোরু দুধ দেয়, তার লাথিও খেতে হয়!’’ ওর একদিকে থাকবেন ভোটের সময়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়া সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। অন্যদিকে মোহন ভাগবতের জন্য ফল মিষ্টি পাঠাবেন যাতে পালটা উসকানি দেওয়া যায়। শোলে সিনেমার জেলার সাহেবের কথা মতো, ‘‘আধে ইধার যাও, আধে উধার যাও!’’ আসানসোলে উসকানিমূলক বক্তৃতা করবেন বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। ইমাম সাহেবের ছেলে শিবগাতুল্লাহকে খুন হতে হবে। আর এঘাট ওঘাট ঘুরে সেই বাবুল কালীঘাটে এসে ভিড়বেন, তৃণমূলের মন্ত্রী হবেন। একদিকে উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজের দলের সাংসদদের ভোটদানে বিরত রাখবেন। আর অন্যদিকে কয়লা পাচারের মামলা থেকে সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বাদ যাবে। এই সব আসলে স্রেফ জনগণকে ধাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা।
ঠিক যে চেষ্টা মাননীয়া করলেন গত ১২ সেপ্টেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। কতগুলি বেসরকারি, চুক্তিভিত্তিক চাকরির নিয়োগপত্র নিজের হাতে চাকরিপ্রার্থীদের হাতে তুলে দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ কেন বেসরকারি চাকরি নিয়ে মেতে উঠলেন? কারণ এই রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি পাহাড় ছুঁয়ে ফেলেছে। নিজের দলের ছোটো বড়ো নেতাদের কোটি কোটি টাকা লুঠের খবর রোজ আমাদের চোখের সামনে আসছে। মাননীয়া নিজেও হয়তো বুঝতে পারছেন যে, ঠিকঠাক তদন্ত হলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কালীঘাটে কেউটে বেরোবে। ২০১৩ সালে প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির খবর হয়। এই দুর্নীতিতে ভরা মেধা তালিকার থেকেই অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ের নিয়োগ হয়। নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাম ছাত্র যুবদের আন্দোলনের সেই শুরু। তারপর থেকে ক্রমাগত কখনো প্রাইমারি, কখনো আপার প্রাইমারি, এসএসসি, পিএসসি, কখনো বা শারীরশিক্ষা - কর্মশিক্ষার শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি নিয়ে লাগাতার আন্দোলন হয়েছে। ২০১৮ সালের স্লেট পরীক্ষার পর নিয়োগের কাজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। দুর্নীতি সন্দেহে আন্দোলন শুরু হয়। পরে জানা যায়, তৃণমূল নেতা পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি হয়েছে এই সময়ে। লাগাতার আন্দোলনের ফলে অবশ্য সম্প্রতি তার চাকরি চলে গেছে কোর্টের নির্দেশে। কোর্ট ও রাস্তার লড়াইতে বারংবার হেরে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের নির্মম আক্রমণ থেকে জেলযাত্রা, কিছুই বাকি রাখেনি এই সরকার। পাড়ায় পাড়ায় চাকরি দেওয়ার নাম করে সিন্ডিকেট খুলেছিলেন তৃণমূল নেতারা। প্রচুর টাকা লুঠে নিয়ে তাঁরা আজ কেউ তৃণমূলে আছেন, কেউ বা বিজেপি-তে চলে গেছেন। কিন্তু চোর এলাকা বদল করলেও চোরই থাকে।
কাজ পাওয়ার অধিকার হারাচ্ছে এই প্রজন্ম। হারাচ্ছে শিক্ষার অধিকারও। কোভিডের সময়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার কোনোপ্রকার alternative education support system গড়ে তুলতে পারেনি। ব্যাপক অংশের শিশু স্কুলছুট হয়েছে। এদের মধ্যেই কেউ কেউ শিশুপাচারের শিকার হচ্ছে। যে বাচ্চারা এখনো প্রাথমিক স্কুলে যাচ্ছে, তাদের জন্য মিড ডে মিলে খাবারের বরাদ্দ মাত্র ৪.৪৮ টাকা। কেন্দ্র, রাজ্য কেউই এই বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না। পুষ্টি ও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া একটা প্রজন্ম যাবে কোথায়? বাঁচবে কীভাবে?
এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে ইনসাফ চাইতেই ছাত্র যুবরা কলকাতার রাজপথে আসছে। সকলকে শিক্ষার অধিকার ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়ার অধিকার দিতে হবে। চোর চিটিংবাজ নেতাদের লুঠ করা অর্থ গরিব মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হবে। যখনই বামেরা রাস্তায় জানকবুল লড়াই দিচ্ছে, চোর নেতাদের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তারা একে একে নানান হাসপাতালে ভরতি হতে চাইছেন। আমরা বলেছি, চিন্তা নেই। করোনার সময়ে যখন তৃণমূল চাল চুরি করছিল, আর বিজেপি করোনা মহামারী কোন ধর্মের জন্য ছড়াল সেটা খুঁজছিল, সেই সময়ে রেড ভলান্টিয়াররা খাবার, ওষুধ, অক্সিজেন নিয়ে রাস্তায় ছিল। যে চোর নেতাদের শরীর খারাপ হচ্ছে, প্রয়োজনে তাদের কাছে রেড ভলান্টিয়াররা যাবে। চোর নেতাদের সুস্থ থাকতে হবে, কারণ জীবনের শেষ দিকের একটা বড়ো অংশ এই চোর নেতাদের জেলেই কাটাতে হবে।