৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
সর্বাত্মক লড়াইয়ের প্রস্তুতি গড়ে তুলুন
লুটের নয়, জনগণের পঞ্চায়েত চাই
অমিয় পাত্র
গড়বেতার ফতেসিংপুর-এ সিপিআই(এম)’র বিক্ষোভ মিছিল। রয়েছেন সুশান্ত ঘোষ।
পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৮ সালে যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তারই এক ভয়াবহ চেহারা আজকের শাসক দল পরিচালিত পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলি। ১৯৭৮-এর আগেও ত্রিস্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েত ছিল - অঞ্চল পঞ্চায়েত, আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদ। মূল পার্থক্য হলো - ১৯৭৮-পরবর্তী পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। মহিলা সহ সমাজের সকল অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, রূপায়ণ এবং এই প্রক্রিয়ায় জনগণের পরামর্শ গ্রহণের পদক্ষেপ গ্রহণ চালু হয়। সারাদেশ এমনকী বিদেশেও জনগণের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের কর্মকাণ্ড প্রশংসিত হয়। এই বিকেন্দ্রিত পঞ্চায়েত সংবিধানস্বীকৃত ব্যবস্থার মান্যতা অর্জন করে। সারাদেশে এই ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা প্রসারিত হয়।
পঞ্চায়েতের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রক্রিয়া চক্রাকার। গ্রাম সংসদের সভায় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ, জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পনা রূপায়ণ, সমষ্টিগতভাবে প্রকল্পের সুবিধাভোগ, সমষ্টিগতভাবে প্রকল্পের মূল্যায়ন এবং সাফল্য বা ত্রুটি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে পরের বছরের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ - এভাবেই পঞ্চায়েত পরিচালনার ভাবনা বিবেচনায় রেখে গ্রাম সংসদ স্তরে গ্রাম উন্নয়ন কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্য এই কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন, এটাই বিধান ছিল, এখনো সেই নিয়ম আছে কিন্তু মানা হয়না। পঞ্চায়েত এখন আর জনগণের প্রতিষ্ঠান নয়, শাসকদলের অনুগামী একটি চক্রের লুঠপাট বা অবৈধ অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্র। দলের নেতা, নির্বাচিত সদস্য, কর্মকর্তা, দপ্তর কর্মী, সরকারি আধিকারিক এবং গুন্ডা-মস্তানরা এই লুটেরা চক্রের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭৮-২০২২ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অনেক প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব পঞ্চায়েতের উপর বর্তেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়া হচ্ছে পঞ্চায়েত এলাকায়। ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনার বরাদ্দ ছাড়াও প্রায় ২৫ টি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের উপভোক্তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থ ব্যয়ে পঞ্চায়েতের হস্তক্ষেপের সুযোগ বেড়েছে। সেই সুযোগকে ব্যবহার করেই এরা সর্বত্র দুর্নীতির রমরমা কায়েম করেছে। বিগত এক দশক এভাবেই চলছে। দুর্নীতির ব্যাপ্তি এতটাই বেড়েছে যা অনেকক্ষেত্রে তাদের পক্ষে আড়াল করা সম্ভব হচ্ছে না। পঞ্চায়েতে ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক বেহিসেবি লুটের কারণে গরিব, শ্রমজীবীদের প্রায় ৮ মাস কোনো কাজ নেই। প্রায় ২,৬০০ কোটি টাকা মজুরি বাবদ বাকি। দেশের একমাত্র রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ রেগার বরাদ্দ পেলনা। কারণ এ রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলি প্রকল্পের নির্দেশিকা অনুযায়ী কাজ করেনি, কোনো সোশ্যাল অডিট হয়নি, বেশিরভাগ প্রকল্পের অস্তিত্ব নেই। বরাদ্দ অর্থের পুরোটাই লুট হয়েছে। গরিব শ্রমজীবীদের জন্য বরাদ্দ অর্থ লুট হয়েছে এটা কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকার সম্পূর্ণ অবহিত, কিন্তু আজ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি দুটো দলই জনবিরোধী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এরা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে ভুগছেন লক্ষ লক্ষ কর্মহীন মানুষ। আট মাস অপেক্ষায় আছেন কবে কাজ চালু হবে। লুটেরাদের পঞ্চায়েত নির্বিকার। এধরনের অজস্র দুর্নীতি ও বেনিয়মের নজির সৃষ্টি করে চলেছে প্রায় প্রতিটি পঞ্চায়েত। মানুষ এর প্রতিকার চায়।
ত্রিস্তরের পঞ্চায়েত সাধারণ নির্বাচন ২০২৩ সালের গোড়ারদিকে অনুষ্ঠিত হতে পারে। শাসকদল এবং রাজ্য প্রশাসনের সেই লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন পেশ থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই শাসকদলের আশ্রিত গুন্ডা-মস্তান ও পুলিশের জুলুম ভোট প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। নির্বাচনের প্রচার পর্বে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গঠনের ডাক দেন। গত একদশকে দলবদলের রাজনীতি, জুলুম, লুটপাট, চুরি দুর্নীতিতে যুক্ত শাসকদল পুরনো কায়দায় ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাবে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি ভোটারদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে বিশেষত গরিব বা শ্রমজীবীদের বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে অল্প কয়েকটি এলাকা ছাড়া শাসকের সন্ত্রাস প্রতিরোধে পার্টির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখা যায়নি। এটা যে ভুল পথ ছিল তা মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। জনগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো - বিজেপি-র প্রতীকে বা নির্দল হিসাবে যাঁরা জয়ী হয়েছিলেন তাঁদের বেশিরভাগ তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। ‘আগে রাম, পরে বাম’- এই আওয়াজ তোলা হয়েছিল পার্টির শ্রেণিভিত্তিকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যেই। এটা ছিল আরএসএস-র সংগঠিত প্রচার। এই সময়ে গরিব ও সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ অংশের মানুষের ঐক্য যত দুর্বল হয়েছে ততই আর্থিক এবং সামাজিক নিপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্প্রতি যেভাবে এক এক করে দুর্নীতিবাজদের কুকীর্তি প্রকাশ্যে আসছে, যেভাবে সোনাদানা, জমি-বাড়ি-গাড়ি, টাকার পাহাড়ের দৃশ্য জনগণ দেখছেন দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটেনি। রাজ্যজুড়ে কাজের হাহাকার। প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হয়েছেন। হুহু করে বাড়ছে খাদ্য পণ্যের দাম। ফসলের দাম নেই অথচ নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দরদাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সবক্ষেত্রে নিয়োগ বন্ধ। স্কুলে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষক নেই। বহু স্কুল শিক্ষক শূন্য। এই সরকারের আমলে যেসব নিয়োগ হয়েছে সবক্ষেত্রেই দুর্নীতি, টাকার লেনদেন হয়েছে। রাজ্যের আর্থিক সংকটে সরকারি পরিষেবার অবস্থা বেহাল। এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। বর্তমানে জনমত শাসক দলের বিরুদ্ধে। ক্রমাগত মানুষের সমর্থন বামপন্থীদের অনুকূলে আসার উপাদান তৈরি হচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সেটা নির্ধারণের সময় এসেছে।
১। গ্রাম/বুথ এলাকার পরিস্থিতির বাস্তব অবস্থা জানতে হবে। বুথ এলাকায় কী সমস্যা রয়েছে, সেই সমস্যা নিরসনের কী কী সম্ভাবনা আছে সেটা চিহ্নিত করতে হবে। আমরা যা জানি সেটা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয়। এলাকার মানুষ কী ভাবছেন সেটা জানতে তাদের কাছেই যেতে হবে। আন্তরিকভাবে মেলামেশা ছাড়া সব তথ্য সঠিকভাবে জানা সম্ভব হবেনা। একাজের জন্য বারে বারে যেতে হবে। গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি কর্মীর প্রতিদিনের কাজ হলো গ্রামে, বস্তিতে, পাড়ায় যাওয়া।
২) মানুষের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এলাকার মানুষের সমস্যা বা চাহিদা ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলার ইস্যুগুলি চিহ্নিত করতে হবে। যেমন - খাদ্য, কাজ, মজুরি, শিক্ষা, আবাস, সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, নিকাশি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষোভ। উপর থেকে আন্দোলনের ইস্যু ঠিক করে চাপিয়ে দেওয়া নয়, মানুষ যাতে মনে করেন এই লড়াই আমার জন্য, এই দাবি আমার কথাই বলছে, সেভাবেই লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
৩) তৃণমূল এবং বিজেপি পরিচালিত প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় ভুরি ভুরি দুর্নীতির ঘটনা আছে। সেগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনে তথ্য জানার আইনের সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। এমজিএনরেগা (MGNREGA)-র ওয়েবসাইট থেকেও অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব। সেসব তথ্য প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। স্ব-সহায়ক(এসএইচজি) গ্রুপের মহিলা সহ সমস্ত শ্রমজীবী মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দাবি আদায়ে এবং দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে এরা একটা শক্তি যারা বড়ো ভূমিকা নিতে পারে।
৪) পঞ্চায়েতের কাজের যাবতীয় হিসাব গ্রাম সংসদের সভায় পেশ করার বিধান আছে। প্রতি নভেম্বর মাস হিসাব পেশ করার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে। সর্বত্র আওয়াজ তুলতে হবে - 'হিসাব চাই, হিসাব দাও, নইলে চেয়ার ছেড়ে দাও’। হিসাব না পেলে নভেম্বর মাসের পর গ্রাম পঞ্চায়েত অবরুদ্ধ হবে। গ্রাম সংসদের সভায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমদের নেতৃত্বের যারা সংসদ এলাকায় বসবাস করেন তাঁদের এই সভায় উপস্থিত থেকে দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব, বঞ্চনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হবে। এই প্রস্তুতি এখনই শুরু করতে হবে।
৫) রেগায় কাজের অধিকার আইনসিদ্ধ। কাজের দাবি জানানোর ৭ দিনের মধ্যে কাজ না দিলে আদালতে অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে। সব পঞ্চায়েতে কাজের দাবি জানিয়ে ৪ক ফর্ম জমা দিয়ে রসিদ নিতে হবে। কোনো কোনো প্রধান প্রাপ্তিস্বীকার করছেন না। এটা মেনে নেওয়া যায়না। রসিদ আদায় করাটাই এই পর্বে একটা লড়াই।
৬) নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে ভোটার তালিকা প্রস্তুতি, ত্রিস্তরের আসনের সীমানা চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজ শুরু করেছে। বুথে বুথে একাজ চলছে। সব এলাকায় পার্টি এ বিষয়ে তৎপর নয়। নির্বাচনী সংগ্রামের অংশ হিসাবে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধিতে আনতে হবে।