৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
রাজ্য পশ্চিমবঙ্গঃ আর্থিক দুর্নীতি, লুঠ, বিপর্যয়
ঈশিতা মুখার্জি
ইদানীংকালে পশ্চিমবঙ্গে আর্থিক দেওয়া নেওয়া নিয়ে আমাদের চোখ যে ঘটনাগুলির দিকে আটকে আছে সেগুলি হলো দুর্গাপুজোর সরকারি অনুদান, আর্থিক দুর্নীতি, মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা কোটি কোটি কালো টাকা উদ্ধার হওয়া, রাজ্য সরকারের ক্রমাগত ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া। যে কথাগুলি চোখের আড়ালে থাকছে তা হলো প্রতিদিন শ্রমজীবী মানুষ, কৃষকের আত্মহত্যা, রাজ্যের মানুষের দারিদ্র্য, অপুষ্টি, খাদ্যাভাব। যে কথা চোখের সামনে আসে, তার থেকেই রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে তা বোঝা যায়। রাজ্য ঋণগ্রস্ত। রাজ্যের আয়ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। রাজ্যে কাজ নেই। রাজ্যের আর্থিক হাল ভালো নয়। এই মুহূর্তে আর্থিক দিক দিয়ে আমাদের রাজ্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ রাজ্য বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে। এই রকম একটি রাজ্যে রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে দুর্গা পুজোর অনুদান দেবে বিভিন্ন ক্লাবকে। কিন্তু একইসঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা বহুদিন দেওয়া যাচ্ছে না। বহুদিন স্কুলের শিশুদের মিড-ডে-মিলে ডিম দেওয়া হচ্ছে না বলে শোনা যাচ্ছে। ওদিকে বেরিয়ে পড়ছে সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন, বিশেষ করে নির্বাচিত মন্ত্রী, বিধায়ক, পুরসভা, পঞ্চায়েতে দুর্নীতি এবং উদ্ধার হওয়া বিপুল কালো টাকা। এ রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো আর্থিক কেলেঙ্কারি হলো সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। সেই কেলেঙ্কারির আজ পর্যন্ত ন্যায়বিচার হলো না - ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ছাড় পেয়ে গেলেন, কিন্তু যে গরিব মেহনতি মানুষজন, যারা দিন আনি দিন খাই করে একটু একটু পয়সা জমিয়ে সবটুকু চিটফান্ড এজেন্টদের বিশ্বাস করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তারা তো এক পয়সাও ফেরত পাননি।
চারপাশ থেকে লুঠ হয়ে গেছে এ রাজ্যে। লুঠ শুরু হয়েছে ২০১১ সাল থেকেই। সারদা কেলেঙ্কারি থেকে সিন্ডিকেট রাজ - ২০১১ সালের কিছুদিন পরেই সামনে চলে এসেছিল। কয়েক বছর পুরনো হলেও আজ সেই পুরনো কথা মনে করতে হচ্ছে। তার কারণ আজ যখন টাকার পাহাড়, দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন মনে রাখতে হবে যে, এই দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষের থেকে লুঠ করেই এই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারে আসীন থেকে দলের নেতা নেত্রীরা সন্ত্রাস চালিয়ে গেছে।
প্রথমেই চলে আসি সারদা কেলেঙ্কারির কথায়। ২০১৫ সাল থেকেই এই চিটফান্ড কেলেঙ্কারির কথা সামনে আসে। কীভাবে হয় এই চিটফান্ডের লুঠ ? নয়া উদারীকরণ নীতির রমরমা এই ধরনের লুঠ সম্ভব করে তোলে। ১৯২০ সালে ইতালিতে চার্লস পঞ্জি নামে এক তেজারতি কারবারি এই ভাবে লুঠ করেন। সেই থেকে এই ধরনের লুঠকে ‘পঞ্জি’ লুঠ আখ্যা দেওয়া হয়। এটি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে একটি পিরামিডকৃত আকৃতি অথবা সমান্তরাল আকৃতি নিয়ে বিভিন্ন মানুষের আমানতকে যুক্ত করা হয়। একজনের থেকে আমানত নিয়ে অন্যজনের সুদ মেটানো হয়। এই ব্যবস্থা ততদিন টিকে থাকে যতদিন আরও বেশি বেশি মানুষকে এই ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা যায়। মানুষের এই আমানত দিয়ে কোনো ধরনের বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না, যেখান থেকে এই জমা আমানত থেকে মানুষকে সুদ দেওয়া যেতে পারে। সাধারণত সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেওয়া এই টাকা দিয়ে তাই দেখা যায় মিডিয়া বা গণমাধ্যম এবং বাড়িঘর তৈরিতে সংগৃহীত অর্থ ঢালা হয়। এখানেও আমরা একই ব্যবস্থা দেখেছি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল চালাতো সারদা গোষ্ঠী। অনেক অনেক তৃণমূল কগ্রেসের নেতা নেত্রীদের বহু বাড়িঘর। এই ব্যয় করা হয় একেবারে বিনা খরচে পুরোপুরি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের উপর ভরসা করে। সাধারণ মানুষ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ছেড়ে কিছু অনামি অখ্যাত এজেন্টদের বিশ্বাস করলেন কেন? নয়া উদারীকরণের অর্থনীতি তো ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার মূলে আঘাত করে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ধীরে ধীরে বেসরকারিকরণের দিকে গেছে। কোনো পরিবর্তনই হঠাৎ আসে নি। পদ্ধতি মেনে ধীরে ধীরে এই রূপান্তর ঘটানো হয়েছে। সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষের থেকে এই ব্যবস্থায় প্রথমেই ব্যাঙ্ক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পোস্ট অফিসে সুদের হার কমে গেছে ক্রমাগত, অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে প্রসারিত করে সরকারি ব্যাঙ্ক মানুষের কাছে পৌঁছায়নি, যদিও অতীতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এমন চিন্তা ছিল। এগুলিকে সরাসরি কারণ না বলা গেলেও এই ধরনের চিটফান্ড গড়ে ওঠার পেছনে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তার সুযোগ নিয়েছিল অসাধু মানুষ যারা এজেন্ট পাঠিয়ে গরিব মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের এই প্রকল্পে টাকা রাখতে বলেছিল। যারা বলেছিল তারা বেশিরভাগ ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত। এই ধরনের প্রকল্প ভেঙে যায় যখন মানুষ তাদের টাকা চাইতে শুরু করেন এবং তখনই এই কেলেঙ্কারি লোকের সামনে আসে। এই রকম প্রকল্প যে অন্য দেশে অন্য রাজ্যে হয়নি তা নয়। এই প্রকল্পের মাথারা শেষ পর্যন্ত জেলেই যায়। কিন্তু আমাদের এখানে এই মাথারা সবাই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নেত্রী অর্থাৎ সরকারি সহায়তায় এই অসাধু কারবার চলে। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে উইকিপেডিয়া (যদিও এই সূত্র নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র নয়) খুললে তারা কী বলছে জানার কৌতূহল কারুর থাকলে দেখা যায় যে, তারা বলছে যে, এটি একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যেখানে টাকার পরিমাণ ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ কোটি টাকা এবং ১ কোটি ৭০ লক্ষ আমানতকারীর টাকা গেছে এই প্রকল্পে। সিট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এই টাকার ৯৫ শতাংশই শেষ তিন বছরে সংগৃহীত হয় অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পরে। যদি এগুলো আনুমানিক পরিসংখ্যানও হয়, তাহলেও চিট ফান্ডে বঞ্চিতদের কাছ থেকে পাওয়া হিসেব এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি। অভিযুক্ত যারা জেলে ছিলেন তারা সবাই তৃণমূল কংগ্রেসের মাথা, কী প্রক্রিয়ায় তারা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখনো সেই দলেরই মাথা তা কেউ জানেন না। কিন্তু এই পরিমাণ কেলেঙ্কারি সারা পৃথিবীর পঞ্জি কেলেঙ্কারির মধ্যে বৃহত্তম। সারদা কোম্পানি একটি রেজিস্ট্রিকৃত কোম্পানি। তাই তারা সেবি-র (SEBI-Securities & Exchange Board of India) আইন মানতে বাধ্য। ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার সেবি-কে সারদার বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে চিঠি দেয় যে, তারা এই আইন মেনে কাজ করছে না। ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে বিধানসভায় এই কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে বামফ্রন্ট্রের বিধায়করা আক্রমণ এবং শারীরিক হেনস্থার মুখে পরেন। তৃণমূল কংগ্রেস কোনোভাবেই সারদা কোম্পানি নিয়ে, অন্যান্য এইরকম প্রকল্প নিয়ে কথা শুনতে নারাজ, কারণ এটা তাদের লুঠের জায়গা। সিপিআই(এম) এই বিষয়ে একটি স্মারকলিপিও ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে দিয়েছিল।
শুধু সারদা কেলেঙ্কারিতেই তারা থেমে থাকেনি। যত বছর এগিয়েছে একের পর এক কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে এবং কোনো রহস্যে অপরাধীরা সাজা পায় নি। পাড়ায় পাড়ায় সিন্ডিকেটরাজ সাধারণ মানুষের টাকা অবিরাম লুঠ করে গেছে। নারদ স্টিং অপারেশনে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রীদের টাকা নিতে দেখা গেছে। এগুলো কোনোটাই মিথ্যা নয়। দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আবার নির্লজ্জের মতো এই অপরাধীরাই মানুষের সামনে টিভির পর্দায় বড়ো গলায় কথা বলেছে। একদিকে সাধারণ মানুষের টাকা লুঠ হয়েছে, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নেত্রীরা টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এর পর শুরু হলো সরকারি চাকরি এমনকী স্কুল শিক্ষকের চাকরি বিক্রি করা। সেই উদ্ধার হওয়া টাকার পাহাড় এখন মানুষের চোখের সামনে। আপাদমস্তক মানুষের টাকা লুঠ করে নিজের পকেট ভরিয়েছে এরা - এটাই সত্য যারাই যা বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন। স্কুল থেকে শ্মশান - সর্বত্র মানুষের টাকা লুঠ হয়েছে।
এরকম একটি সরকার ঘোষণা করলো তারা দুর্গাপুজোয় অনুদান দেবে আয়োজক ক্লাবগুলিকে। এর পরিমাণ ২৫৮ কোটি টাকা। আদালত নির্দেশ দিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মীয় উৎসবে অনুদান দিতে পারে না কোনো সরকার; তাই এই টাকা কোর্টের নির্দেশে ব্যবহার করা হবে ছয়টি শর্ত সাপেক্ষে। জনকল্যাণে এই টাকা ব্যয় করতে হবে। এছাড়া বিদ্যুৎ এবং অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থার জন্য ছাড় দিয়ে রাজ্যের রাজস্ব ব্যয় হবে ৫০০ কোটি টাকা। ৪০,০২৮টি পুজো কমিটি প্রত্যেকে পাবে ৬০,০০০ টাকা করে। গত বছর তারা পেয়েছিল ৫০,০০০ টাকা করে। তাহলে সরকারি কর্মচারীদের, শিক্ষকদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া যায় না কেন? কেন অভুক্ত থাকবে মিড-ডে মিলের প্রাপকেরা? এই রাজ্যের সরকারি কর্মীরা কেন অন্য রাজ্যের কর্মীদের থেকে কম বেতন পাবেন? কোন যুক্তিতে সরকার এ সম্পর্কে কিছু জানায়নি। এত দানের মধ্যে রাজ্যের আর্থিক হাল-হকিকত কিন্তু বেশ খারাপ। গত জুলাই মাসে দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে ঝুঁকির কথা জানিয়েছিল তা হলো এই যে, রাজ্যের ঋণের বোঝা বিপুল এবং রাজস্ব আয়ের ৯০ শতাংশ চলে যায় ঋণশোধ এবং বেতন বাবদ। তাই জনকল্যাণ খাতে পড়ে থাকে মাত্র ১০ শতাংশ। সেই ১০ শতাংশ নিয়ে যদি এই ধরনের দান-খয়রাতি হয়, তাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এইসবে রাজ্য সরকার আর কোনোভাবেই ব্যয় করতে পারবে না। এতে ব্যয়ের ধরন নিয়ে খুব সন্দেহ প্রকাশ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তাই সরকারকে এলোপাথারি ব্যয় করে মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে হবে। সেটাই হচ্ছে এখন। এটা কোনোভাবেই সুস্থ আর্থিক ব্যবস্থা নয়। দুর্নীতি, মানুষকে লুঠ, জনকল্যাণে ব্যয় সংকোচন - এভাবেই চালাতে চাইছে রাজ্য সরকার। জনবিরোধী শুধু নয় এই নীতি, জনবিধ্বংসী। মানুষের দুর্ভোগ এবং নেতৃবৃন্দের ভোগ-এর মধ্যদিয়েই রাজ্যকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে এই সরকার।