৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
দেশপ্রেমের অভিনয় করছে মোদি সরকার
অর্ণব ভট্টাচার্য
দেশের মানুষের সামনে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক হিসেবে তুলে ধরার নিত্য নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করার ব্যাপারে সংঘ পরিবার ও তাদের ম্যাসকট নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির জুড়ি মেলা ভার। সম্প্রতি দিল্লির ‘রাজপথ’-এর নামকরণ করা হয়েছে ‘কর্তব্যপথ’। এই নতুন নামকরণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিয়েছেন যে, তাঁর দল ও সরকার ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের চিহ্ন দূর করতে বদ্ধপরিকর। এরই সাথে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ২৮ ফুট উঁচু একটি মূর্তি ইন্ডিয়া গেটের কাছে স্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং আরএসএস দাবি করেছে যে, এতকাল নেতাজিকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি, বর্তমান সরকার সেই কাজ করছে। ব্রিটিশ আমলের রাস্তার নাম পরিবর্তন হোক বা নেতাজির মূর্তি প্রতিষ্ঠা - এই সব কিছুরই লক্ষ্য আরএসএস এবং বিজেপি’র ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। বিশেষত স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে যে আবেগ দেশজুড়ে সঞ্চারিত হয়েছে তাকেই রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে চাইছে সংঘ পরিবার।
যেহেতু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস’র কোনো সদর্থক ভূমিকা নেই এবং তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে একমাত্র যোগসূত্র বিনায়ক দামোদর সাভারকরও শেষ পর্যন্ত মুচলেকা দিয়ে ব্রিটিশ ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সেহেতু সংঘ পরিবার নিজেদের দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই জন্যই ইতিহাসকে বিকৃত করে সাভারকরকে ‘বীর’ সাজানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু ইতিহাসে একের পর এক অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যা আরএসএস-কে ব্রিটিশ শাসকের তাঁবেদার বলেই প্রতিষ্ঠিত করে। আরএসএস’র সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর স্পষ্টভাবে একথা উল্লেখ করেন যে, কেবলমাত্র ‘হিন্দুজাতি’র গৌরবগাথা প্রচার ও তাদের পুনরুত্থানের লক্ষ্যে কাজ করাই জাতীয় কর্তব্য। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা তো দূরে থাক, এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণকে সংঘ পরিবার সময়ের অপচয় বলেই মনে করত। তাই ব্রিটিশ শাসকও হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল।
সর্বোপরি ব্রিটিশ শাসকের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক হয় হিন্দুত্ববাদী সাভারকরের ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ যা কিনা মুসলিম লিগের ‘দ্বিজাতিতত্ত্বে’র ভাবনাকে শক্তিশালী করে দেশভাগের পথ প্রশস্ত করে। এহেন আরএসএস এখন অখণ্ড ভারতের স্লোগান দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগ জাগিয়ে তুলতে চায় এবং নিজেদের দেশপ্রেমের ধ্বজাধারী হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে।
অথচ মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এমন কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে যা ব্রিটিশ ভারতে যে অত্যাচার-অবিচার হয়েছিল তাকে তুলে ধরার বদলে আড়াল করার কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে সরকারি উদ্যোগে যে সংস্কার হয়েছে তা উল্লেখ করা যায়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ও ডায়ারের নির্দেশে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তা এখনো ভারতবাসীর হৃদয়কে নাড়া দেয়। অথচ এই সরকারের আমলে জালিয়ানওয়ালাবাগে এমন সংস্কার করা হয়েছে যে তার ফলে শত শত বুলেটের দাগ ঢেকে গিয়েছে এবং সেই জায়গায় রংচঙে প্যানেল বসানো হয়েছে। বুলেটের যে চিহ্নগুলি ভারতবাসীর মনে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা জাগাতো সেগুলিকে সুচতুরভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। ঐতিহাসিক চমন লাল মন্তব্য করেছেন যে, গান্ধীজির সবরমতী আশ্রমেও সংস্কারের নাম করে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। আসলে মহাত্মা গান্ধীর অবমাননা সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ। গান্ধীজির রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি পুরোধা ছিলেন। গান্ধীজি আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক ভারতের স্বপ্ন লালন করেছেন। দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে তিনি মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন তার নজির মেলা ভার। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের জন্য তাকে ধর্মান্ধ, উগ্র হিন্দুত্ববাদী গডসের হাতে নিহত হতে হয়েছিল। যে আরএসএস-বিজেপি গান্ধীজির হত্যাকারী গডসে এবং গান্ধী হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী এবং ব্রিটিশের তল্পিবাহক সাভারকরের ভজনা করে, তারা এখন ঔপনিবেশিকতার জোয়াল ছুঁড়ে ফেলার ভান করছে।
আরেকটি ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, আরএসএস’র মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকায় মোদির ঔপনিবেশিক শাসনের চিহ্ন মুছে ফেলার নিদর্শন হিসেবে ২০১৫ সালে ঔরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে এপিজে আবদুল কালাম রোড করাকে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতে মুঘল শাসনকে ব্রিটিশ শাসনের সমতুল্য বলে প্রচার করার পেছনে এক কুটিল রাজনীতি ক্রিয়াশীল। ভারতের মাটিতে পাঠান-মোগল রাজত্বকে বরাবর বিদেশি শাসন বলে প্রচার করে সংঘ পরিবার। অথচ আর্য, শক, হুনদের মতোই মোঘল শাসক, তাদের বংশধর, তাদের সাথে আসা ভিনদেশিরা এদেশের জনসমষ্টিতে মিশে গিয়েছে। এদেশের সঙ্গীত, শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাষা ও খাদ্যাভাস সহ সামগ্রিক সমাজ জীবনে মুঘল শাসনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে, যা অস্বীকার করে এই সাম্প্রদায়িক শক্তি। কে না জানে যে, মোঘল-পাঠানরা ভারতের সম্পদ ব্রিটিশের মতো লুঠ করে ভিনদেশে পাঠায় নি, বরং তারা এই দেশের বৈচিত্র্যময় সমাজ-সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। অথচ তাদেরকে ব্রিটিশ শাসকের সাথে এক পঙক্তিতে বসিয়ে সংঘ পরিবার ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করতে চায় এবং মুসলমানদের সম্পর্কে বিদ্বেষের মনোভাব জাগিয়ে রাখতে চায়। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে যে বিদ্রোহীরা তাদের সর্বাধিনায়ক হিসেবে মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তাঁকে ব্রিটিশ শাসকরা পরবর্তীকালে নির্বাসিত করেছিল - এই সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্যকে ভুলিয়ে দিতে চায় আরএসএস। বিদেশি শাসন হিসেবে মধ্যযুগের মুসলমান শাসকদের সময়কালকে তুলে ধরার মাধ্যমে সংঘ পরিবার ভারতের ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনা করে তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে কার্যকর করবার চেষ্টা করছে। এর সাথে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে বিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এই ধরনের ইতিহাস বিকৃতি দেশের মানুষের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির হাত শক্ত করছে।
অন্যদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শনের মধ্যেও অসৎ উদ্দেশ্য আছে। একথা ঠিক যে, স্বাধীন ভারতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আজাদ হিন্দ ফৌজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা ও সদর্থক মূল্যায়নের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নেতাজির উত্তরাধিকার বহন করার কোনো যোগ্যতাই নেই সংঘ পরিবারের, কেননা নেতাজি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। ধর্মান্ধ হিন্দুদের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির দলবলের সাথে নেতাজির অনুগামীদের সংঘাত সর্বজনবিদিত। আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি সমস্ত ধর্মাবলম্বী সৈন্যের সমমর্যাদা নিশ্চিত করেন। যে উর্দু ভাষা নিয়ে সংঘ পরিবার নিকৃষ্ট রাজনীতি করেছে এবং এটিকে মুসলমানের ভাষা বলে চিহ্নিত করে হিন্দি আর উর্দুর বিবাদ বাধিয়েছে সেই উর্দু ভাষা ছিল নেতাজির অত্যন্ত প্রিয়। আজাদ হিন্দ ফৌজের স্লোগান(ইত্তেহাদ- ঐক্য, ইতমাদ- বিশ্বাস, কুরবানি- আত্মবলিদান) এই ভাষাতেই লেখা ছিল। মোদির পক্ষ থেকে নেতাজিকে সম্মান দেখানো আসলে নিছক আনুষ্ঠানিকতা, কেবল এক উপলক্ষ। আসল উদ্দেশ্য নেতাজির গৌরবের প্রভায় নিজেদের গৌরবান্বিত করা আর কার্যক্ষেত্রে নেতাজির অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে প্রতি পদক্ষেপে নস্যাৎ করে সাভারকর, দীনদয়াল উপাধ্যায় ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।
এবছর স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদি যে বক্তৃতা রেখেছেন সেখানেও তিনি ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাহবা কুড়িয়েছেন। তাহলে সর্বাগ্রে আমাদের দেশে যে পিনাল কোড বা দণ্ডবিধি রয়েছে সেখানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে মোদি সরকারের কী ভূমিকা তা জানা দরকার, কেননা তা ঔপনিবেশিক দণ্ডনীতির উত্তরাধিকার বহন করছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা যা রাজদ্রোহের দায়ে শত শত প্রতিবাদীর কণ্ঠরোধ করছে, যে ধারাকে সুপ্রিমকোর্ট ঔপনিবেশিক জমানার উত্তরাধিকার বলে সমালোচনা করেছে তাকে এখনো বিলুপ্ত করার কোনো কথা কী ভাবছে দেশের সরকার? বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই ধারাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে মানুষের প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই আইনের সুবাদে এখনো অনেক যুক্তিবাদী-প্রগতিশীল মানুষ বছরের পর বছর জেলের মধ্যে যন্ত্রণাদীর্ণ দিন কাটাচ্ছেন। একদিকে ঔপনিবেশিক দমননীতির এমন নির্মম প্রয়োগ, অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লোকদেখানো হুংকার - এই দ্বিচারিতাই আরএসএস-বিজেপি’র রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের আগে পর্যন্ত ভারতের দণ্ডবিধিতে ঔপনিবেশিক প্রভাবের আরেকটি নিন্দনীয় উদাহরণ ছিল ৩৭৭ ধারা যা সমলিঙ্গের সম্পর্ককে অপরাধ বলে চিহ্নিত করতো। উল্লেখ্য যে, ৩৭৭ ধারা অবলুপ্ত হওয়ার পর আরএসএস এই মর্মে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে যে, ‘‘ভারতীয় সমাজ এ ধরনের সম্পর্ক অনুমোদন করে না’’, যদিও ভারতের প্রাক্-ব্রিটিশ ইতিহাসে সমলিঙ্গের সম্পর্ক বা তৃতীয় লিঙ্গকে নিয়ে কোনো ছুঁৎমার্গ ছিল না। বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী তো এই ধারার অবলুপ্তিকে ‘হিন্দুত্ব বিরোধী’ বলে আখ্যা দেন।
সবশেষে যে প্রসঙ্গের অবতারণা না করলেই নয় তা ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ভারত সরকারের এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন ও জাতীয় পতাকাকে অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত। ব্রিটেনের রানির প্রতি ভারত সরকারের এই অচলা ভক্তি বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনকারী চেহারাকে উন্মোচিত করেছে। যে ব্রিটিশ শাসক ভারতের সম্পদ লুঠ করেছে, যারা আধুনিকতার উপাদান নিয়ে এসেছিল ভারতের উন্নতি করতে নয় শোষণের জালকে আরও বিস্তৃত করতে এবং শাসনের লৌহশৃঙ্খলকে শক্তিশালী করতে, যারা এদেশের বিপুল সম্পদ জনশিক্ষা-জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ব্যয় করেনি, যাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে গিয়ে হাজার হাজার দেশবাসী শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন - অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন সেই ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কাছে নতজানু হয়ে মোদি সরকার নিজের স্বরূপ চিনিয়েছে। এই সরকার যতই উঁচু দরের অভিনয় করুক না কেন মানুষ ক্রমশ বুঝতে পারছেন কারা এদেশে ‘দেশদ্রোহীর পতাকা’ বইছে। উপযুক্ত সময়ে তাদের বিচার হবে।