৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
দুর্নীতির প্রশ্নে বিজেপি কী ধোয়া তুলসী পাতা?
সুপ্রতীপ রায়
১৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য বিজেপি’র নবান্ন অভিযান ছিল। ওদের স্লোগান ছিল, ‘‘চোর ধরো জেল ভরো’’। বামপন্থীদের দেওয়া স্লোগান বিজেপি চুরি করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে - দুর্নীতির প্রশ্নে বিজেপি’র আন্দোলন করার কোনো নৈতিক অধিকার আছে কী?
যদিও বিজেপি দল ও তাঁদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দুর্নীতির বিষয়ে অনেক চমক দেওয়া কথা বলেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পর মোদি তাঁর প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে জাতির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘‘না খাউঙ্গা,না খানে দুঙ্গা’’ অর্থাৎ নিজেও ঘুষ খাবো না, কাউকে ঘুষ খেতেও দেবো না। কিন্তু বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার ও ওদের পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি আসলে যে দুর্নীতি করছে তা বারেবারে প্রমাণিত হয়েছে।
গত আট বছরে দুর্নীতিগ্রস্তদের আশ্রয় দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে মোদি সরকার। মদ ব্যবসায়ী এবং কিংফিসার এয়ারলাইন্সের প্রধান বিজয় মালিয়াকে ব্যাঙ্কের বিপুল পরিমাণ দেনা পরিশোধ না করে দেশ থেকে পালাবার ব্যবস্থা করেছিল বিজেপি। ২০১৫- র ১২অক্টোবর প্রথম লুক-আউট নোটিশ জারি করে সিবিআই বলেছিল - দেশের বাইরে যেতে চাইলে মালিয়াকে যেন আটক করা হয়। এক মাসের মধ্যেই বিজয় মালিয়ার নামে জারি হওয়া নোটিশ বদলে দেয় সিবিআই। বলা হয়,বিপুল দেনা এড়িয়ে দেশ ছাড়তে চাইলে গ্রেপ্তার করা হবে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানালেই চলবে।
আর একজন হলেন ললিত মোদি। যিনি বিপুল পরিমাণ টাকা নয়ছয়ের সঙ্গে যুক্ত। ললিত মোদিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন বিজেপি নেত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ এবং রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। প্রয়াত সুষমার স্বামী, কন্যা এবং বসুন্ধরার ছেলে ললিত মোদির কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এমনকী ইন্টারপোলের তালিকা থেকেও বাদ দেওয়া হয় ললিতকে। প্রাক্তন ক্রিকেট কর্তা ও শিল্পপতি ললিত মোদি বিরাট অঙ্কের দুর্নীতির সঙ্গে অভিযুক্ত হয়েও ভারতীয় তদন্তকারীদের হাত এড়িয়ে বছরের পর বছর বিদেশে কাটাচ্ছেন। বেশির ভাগ সময় লন্ডনে কাটিয়েছেন। ইডি এবং সিবিআই তদন্তে ইচ্ছাকৃতভাবে শিথিলতা দেখিয়েছিল। ইডি-র অভিযোগ ছিল, ললিত নিজেই ১২৫ কোটি টাকা বেআইনি পথে সরিয়েছেন। কিন্তু ইন্টারপোলের কাছে ললিত দাবি করেছিলেন,ইডি সরকারিভাবে কোনো চার্জ গঠন করেনি। বিজেপি যে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের সহায়তা করে তার প্রমাণ মেলে ১০ মার্চ ’১৭ সংসদে এক প্রশ্নের উত্তর থেকে। ওইদিন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি নাম না করে বলেছিলেন, ললিত মোদি বা বিজয় মালিয়ার মতো লোকদের দেশে ফিরিয়ে আনবার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কথা চলছে।
ইডি-র কালো তালিকাভুক্ত অভিযুক্ত ললিত মোদিকে পর্তুগালে যাওয়ার ছাড়পত্র দিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ। আরও উল্লেখ্য, পলাতক অভিযুক্ত ক্রিকেট কর্তাকে আশ্রয় দিতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ২০১১ সালে গোপন হলফনামা দিয়েছিলেন রাজস্থানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া।
বৃহৎ করপোরেট ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নেওয়া এবং বকেয়া রেখে বিদেশে পালানোর ক্ষেত্রে মোদি সরকারের সহায়তা প্রদান এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। জনগণের বিপুল অর্থ লোপাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। বিজেপি পরিচালিত সরকার দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতি পরায়ণ সরকার। মেহুল চোকসি বা নীরব মোদি,বিজয় মালিয়া,নীতিন সন্দেসা সবার পিছনে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। প্রতিটি ক্ষেত্রে চুরি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে। নীরব মোদি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে ১৩,৭০০ কোটি টাকা চুরি করে বেপাত্তা হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর মামা মেহুল চোকসি। নীরব হংকংয়ে আর মেহুল পালিয়ে যান আ্যান্টিগা ও বারমুডায়। কেবল তাই নয় তারা সেখানকার নাগরিকত্বও পেয়ে যান। চোকসি’র নাগরিকত্বের আবেদনে মুম্বাই পুলিশের দেওয়া সার্টিফিকেটে লেখা হয়, ‘‘তাঁর বিরুদ্ধে ভারত সরকারের কোনো অভিযোগ নেই’’। এ অভিযোগ জোরালোভাবে ওঠে,মেহুল যাতে নাগরিকত্ব পান তার জন্য আ্যান্টিগোর প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। নীতিন সান্দেসারা পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ৪৭০০ কোটি টাকা লুট করে নাইজেরিয়াতে চলে যান। এই বিপুল পরিমাণ টাকা চুরি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে এবং এই চুরিগুলিতে সহায়তা করেছে মোদি সরকার।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের টাকা মানে দেশের জনগণের টাকা। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গর্ভনর রঘুরাম রাজন জানিয়েছিলেন,রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ধার নিয়ে সে ফেরত দিচ্ছে না। গোটা টাকাটাই সাধারণ মানুষের। এরকম লুট মোদি জামানায় সাধারণ ঘটনাতে পরিণত হয়েছে।
এটা বলা অসঙ্গত হবে না,লুট হচ্ছে সাধারণ মানুষের টাকা এবং তা লুট হচ্ছে বর্তমান বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। এই লুটের একটা ভাগ যে বিজেপি পাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। সোজা কথায় বৃহৎ ব্যবসায়ী ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে এক অপরাধমুলক অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে যাকে বলা হচ্ছে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা ধান্দার পুঁজিবাদ। বলা বাহুল্য বিজেপি ধান্দার ধনতন্ত্রের আগ্রাসী অনুসারী একটি রাজনৈতিক দল। তাই দুর্নীতি বিজেপি’র অঙ্গের ভূষণ।
ছত্তিশগড়ে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ছত্রিশ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ধান কেনা, মজুত করা, চাল বিতরণ পর্যন্ত নেতা-ঠিকাদার-মিল মালিক এবং অফিসার সবাই এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এও আমরা দেখেছি বিজেপি নেতা গিরিরাজ কিশোরের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণে হিসাব বহির্ভূত টাকা পাওয়া গিয়েছিল।
বিগত কয়েক বছরে সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে বেশ কিছু শিল্পপতিকে সাহায্য করা হয়েছে। যাদের অন্যতম আদানি গোষ্ঠী। ২০১৬ সালে অর্থ মন্ত্রক এবং এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। অভিযোগ-আমদানি করা কয়লা এবং উপকরণের দাম বাড়িয়ে দেখানো এবং সেই বাড়তি দামের বোঝা উপভোক্তাদের ঘাড়ে চাপানো। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। কিন্তু আদানি গোষ্ঠীর কিছু হয়নি। উলটে মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইডি আধিকারিকরা হেনস্থার শিকার হয়েছেন।
ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্সি আদানি গোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে ২০০৯ সালে কাস্টমস এক্সাইজ আ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স আ্যাপিলেট ট্রাইবুনাল সব অভিযোগ খারিজ করে দেয়। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা সেজ-এর নিয়মকানুন বদলে দেয়, যাতে আদানিদের লাভ হয়।
আইসিডিএস সেন্টারের খাদ্য কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত গুজরাটের বিজেপি সরকার। আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গুজরাট সরকার ২০১৪ সালে কিছু পছন্দসই কোম্পানিকে রান্না না করা খাবারের ঠিকাদারি দেয়। সরকারি রাজস্বের ক্ষতি হয় ৫০০ কোটি টাকা। গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন প্যাটেল ২০১০ সালে তাঁর আত্মীয়দের শতকরা ৯২ ভাগ কমদামে ৪২২ একর খাস জমি বিক্রয় করেন। এতে সরকারের ক্ষতি হয় ১৪৩.৫০ কোটি টাকা।
সাহারা ডায়েরিতে ২০১৪ সালে বিস্ফোরক তথ্য মিলেছে। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সাহারা গ্রুপের অফিসে আয়করের তল্লাশিতে নগদ ১৩৭ কোটি টাকা, বহু দলিল এবং স্পেডসিট বাজেয়াপ্ত করা হয়। এমনই একটি স্পেডসিটে দেখানো হয় ২০১৩-১৮তে ১১৫ কোটি টাকা জমা হয়েছে। একই সময়ে ১১৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। একটি এন্ট্রিতে লেখা ছিল নরেন্দ্র মোদি ৪০ কোটি টাকা পেয়েছেন।
পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে কলঙ্কিত বিজেপি। ২০১৫ সালে পানামায় মোকাস-ফেনসেকো ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস-এর বেশ কিছু নথি ফাঁস হয়ে যায়। তাতে দেখা যায় কর ফাঁকি দেবার জন্য বিদেশে ব্যাঙ্ক আ্যাকাউন্টে রয়েছে ৪৭৪ জন ভারতীয় ব্যক্তি ও কোম্পানির নাম। এই পানামা পেপার্স-এ যাদের নাম ছিল তাদের অন্যতম ছত্তিশগড়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংয়ের ছেলে অভিষেক সিং।
আর একটি বৃহৎ কেলেঙ্কারি প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারি। বারমুডা দ্বীপের আ্যাপেলবাই সংস্থা এবং সিঙ্গাপুরের এশিয়া সিটি সংস্থায় আর্থিক নথি ফাঁস হয়েছে প্যারাডাইস পেপার্স-এ। এই নথি থেকে জানা যায় কীভাবে করপোরেট সংস্থাগুলি তাদের টাকা বিদেশে পাচার করে কর ফাঁকি দেয়। কর ফাঁকি দিয়ে কলো টাকা পাচারকারীদের মধ্যে নাম আছে আম্বানি,আদানি সহ বিজেপি নেতা জয়ন্ত সিনহার নাম।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা কথা বলাতে পারদর্শী। ২০১৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি’র ১৫ মাসে এক পয়সার দুর্নীতি নেই’’। কিন্তু তখন ব্যাপম কেলেঙ্কারি নিয়ে গোটা দেশ উত্তাল। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একটি বৃহত্তম কেলেঙ্কারি। মধ্যপ্রদেশে মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভরতির দায়িত্বে থাকা ‘মধ্যপ্রদেশ ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল’ বা ‘ব্যাপম’-এর কাজকর্ম নিয়ে অভিযোগ অনেক আগে থেকেই। তবে কেলেঙ্কারির প্রকৃত ছবিটা সামনে আসে ২০১৩ সালে। ইন্দোরের চিকিৎসক আনন্দ রাইস ও গোয়ালিয়রের সমাজকর্মী আশিস চতুবের্দীর চেষ্টায় গ্রেফতার হন ওই রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মা সহ বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ায় রাজ্যপাল রামনরেশ যাদব ও তাঁর ছেলে শৈলেশেরও।
মোটা টাকার বিনিময়ে বেআইনিভাবে বহু প্রার্থীকে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ‘ব্যাপমে’র বিরুদ্ধে ওঠে। শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল নয়, ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরির পরীক্ষাতেও এই চক্র প্রভাব বিস্তার করেছিল। চক্রের মাথায় ছিলেন বিজেপি নেতারা।
অভিযুক্ত ও সাক্ষী মিলিয়ে গত কয়েক বছরে ব্যাপম দুর্নীতি মামলার সঙ্গে যুক্ত ২৪ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা সরকারিভাবে স্বীকার করা হলেও, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। ব্যাপম কেলেঙ্কারির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক অক্ষয় সিং খুন হন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির চাপে মধ্যপ্রদেশ পুলিশের কাছ থেকে এই কেলেঙ্কারির তদন্তভার চলে যায় সিবিআই-র হাতে। মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে সিবিআই মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহানকে ক্লিনচিট দেওয়াতে প্রমাণিত হয়েছে সিবিআই আরএসএস-র শাখাতে পরিণত হয়েছে। বলা বাহুল্য, কোনো আদালত চৌহানকে ক্লিনচিট দেয়নি।
ব্যাপম কেলেঙ্কারির ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের রহস্যজনক মৃত্যুর মিছিল যেভাবে বেড়েছে তা হলিউডের সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। সাংবাদিক অক্ষয় সিং, জব্বলপুর মেডিক্যাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মা, মহিলা সাব-ইন্সপেক্টর অনামিকা কুশওয়াহার অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। অনামিকার নিয়োগ ব্যাপমের মাধ্যমেই হয়েছিল। যদিও মৃত্যুগুলিকে বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার ‘স্বাভাবিক’ বলে দাবি করেছিল। কিন্তু প্রত্যেকটি মৃত্যুর সঙ্গে ব্যাপমের যোগ ছিল। কেউ ডাক্তারির ছাত্রী, কেউ কেলেঙ্কারিতে যুক্ত, কেউ সাক্ষী, কেউ রাজসাক্ষী, কেউ তদন্তকারী চিকিৎসক। কারও দেহ পাওয়া গিয়েছিল রেল লাইনের ধারে,কেউ মারা গিয়েছেন নিজের বাড়িতে পুড়ে, কেউ মারা গিয়েছেন জেলে অসুস্থ হয়ে। যেমন উজ্জয়িনীর কাছে রেললাইনের পাশে উদ্ধার হয়েছিল ডাক্তারি ছাত্রী নম্রতা ডামোরের মৃতদেহ। পুলিশের দাবি ছিল তিনি আত্মহত্যা করেছেন। নম্রতা ঘুষ দিয়ে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছিলেন বলে পুলিশের অভিযোগ। পুলিশের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পরিবারের অভিযোগ ছিল, ব্যাপম কাণ্ডে জড়িত কেউ খুন করিয়েছে তাদের মেয়েকে। নম্রতারই বাবার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক অক্ষয় সিং। হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। দিল্লির একটি হোটেল থেকে উদ্ধার হয় জব্বলপুরের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মেডিক্যাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মার দেহ। তাঁর আগে ওই কলেজেরই আর এক ডিন সাকল্পে রহস্যজনকভাবে আগুনে পুড়ে মারা যান।
বিজেপি অনেকদিন থেকে ওই রাজ্যে সরকার পরিচালনা করে আসছে। ২০০৯ সালে মেডিক্যাল কলেজে ভরতির সময়ই ‘ব্যাপম’-এর কাজকর্ম নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৩ সালে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলায় প্রকাশ্যে আসে এই কেলেঙ্কারি। তৈরি হয়েছিল ‘সিট’। ‘সিট’ ৩২৯২ মামলায় চার্জশিট পেশ করেছিল। এই মামলায় প্রায় ১,১০০টি জালিয়াতি ধরা পড়ে। মামলায় জড়িয়েছিলেন শিবরাজ সিং চৌহান, উমা ভারতী, বিজেপি নেতা সুধাংশু মিত্তাল, আরএসএস-র দুই জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সুরেশ সোনি ও প্রভাত ঝা। এছাড়া রাজ্যের বিজেপি’র বেশ কিছু সাংসদ ও মন্ত্রীর নাম যুক্ত। ব্যাপম কাণ্ডের রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি কেন? বিজেপি-কে বাঁচানোর জন্য সমস্ত ব্যবস্থা মোদি সরকার করেছে।
গত বছর কর্ণাটকের স্টেট কন্ট্রাক্টর আ্যাসোসিয়েশন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে একটি অভিযোগপত্র পাঠিয়েছিল। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, বেঙ্গালুরুতে যে কোনও নির্মাণকাজ শুরু করতে গেলে আগে টেন্ডারের মূল্যের ২৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ নির্বাচিত বিজেপি সদস্যদের দিতে হয়। গোয়ার এক বিজেপি বিধায়ক নিজের দলেরই পূর্ত বিভাগের মন্ত্রী সম্পর্কে অভিযোগ তুলে বলেছেন,তাঁর দপ্তরের প্রতিটি নিয়োগের জন্য ২৫-৩০ লাখ টাকা ঘুষ নেন। কর্ণাটক ও গোয়া দুটি রাজ্যই বিজেপি পরিচালিত।
মেঘালয়ের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক বলেছিলেন, তিনি জম্মু-কাশ্মীরের দায়িত্বভার নেওয়ার পর মোদি ঘনিষ্ঠ দেশের প্রথম সারির একটি শিল্পগোষ্ঠী এবং আরএসএস ঘনিষ্ঠ এক নেতার দু’টি ফাইল পাশ করানোর জন্য তাঁকে দেওয়া হয় এবং বলা হয় পাশ করালে ৩০০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হবে। যদিও সত্যপাল দু’টি ফাইলই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যপাল আরও অভিযোগ করে বলেছেন, গোয়ার গভর্নর থাকাকালীন বিজেপি সরকার কোভিড ত্রাণ তহবিলে বিরাট দুর্নীতি করেছে। এবিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। পুরস্কার হিসাবে তাঁকে শিলং এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জমি ও খনি কেলেঙ্কারিতে জড়িত ইয়েদুরাপ্পাকে চতুর্থ বার কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে। হিমন্ত বিশ্বশর্মা গুয়াহাটিতে জল সরবরাহ কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্ত। অভিযোগ-প্রকল্পটির কাজ পেতে আমেরিকান একটি কোম্পানির কাছ থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছেন। কিন্তু হিমন্ত যখন বিজেপি'তে যোগ দেন তখন মামলাটির ভার সিবিআই-কে দেওয়ার দাবি থেকে সরে আসে বিজেপি। হিমন্ত বিশ্বশর্মাই আসামে বিজেপি’র মুখ্যমন্ত্রী হন। তাঁর আমলে পিপিই-কিট কেনা নিয়ে দুর্নীতি এবং পুলিশে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আলোড়িত হয় রাজ্য। আবার মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ রানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকলেও বিজেপি’তে যোগ দেওয়া মাত্র তাঁকে রাজ্যসভায় দলের এমপি করে দেওয়া হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বৃহত্তম প্রতিরক্ষা কেলেঙ্কারি রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনা। যা মোদি আমলে ঘটেছ। ১২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি মোদি ক্ষমতায় আসার আগেই হয়েছিল। মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আগের পরিকল্পলা বাতিল করে ৩৬টি উড়তে প্রস্তুত রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনার বিষয়ে অগ্রসর হয় মোদি সরকার। ২০১৫ সালে মোদি প্যারিসে যাওয়ার পর উড়তে প্রস্তুত ১২৬টির বদলে ৩৬টি বিমান কেনার চুক্তি হয়। আর এই চুক্তিতে ভারতীয় আংশীদার হিসাবে যুক্ত করা হয় রিলায়েন্স গ্রুপকে। যদিও আগের চুক্তিতে ভারতীয় অংশীদার হিসাবে হ্যালের নাম ছিল।
কিন্তু কী কারণে আগের চুক্তিটি বাতিল করা হলো তার যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর মোদি সরকার দিতে পারেনি। কেন্দ্রের তরফে বলা হয়েছিল, হ্যাল-এর পরিকাঠামোগত দুর্বলতা থাকার কারণে হ্যাল ও দাউস -এর মধ্যে চুক্তি হয়নি। যদিও দাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মোদির ফ্রান্স সফরের দু’সপ্তাহ আগে চুক্তিটি ৯৫ শতাংশ সম্পূর্ণ ছিল ও হ্যালের সঙ্গে কাজের শরিকানা চুক্তি সই হয়েছিল।
এটা খুব পরিষ্কার হ্যালকে বিযুক্ত করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেডকে যুক্ত করা হয়। রিলায়েন্সের সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। মোদির সময় রাফাল যুদ্ধ বিমানের যে দাম স্থির হয় তা আগের চুক্তিতে নথিবদ্ধ দামের দ্বিগুণ। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশের প্রতিরক্ষার জন্য সরঞ্জাম কেনার বিষয়ে যুক্ত এটা অতীতে হয়নি।
দেশের গোটা আর্থিক ব্যবস্থাকেই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা পাকা করেছেন মোদি। ২০১৭-১৮ সালের আর্থিক বাজেট পেশ করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি রাজনৈতিক দলের অনুদান গ্রহণের প্রশ্নে নতুন নিয়ম ঘোষণা করে বলেন,নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক অনুদান নেওয়া যাবে। আর্থিক সীমা ২০০০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। নগদে লেনদেন বন্ধ করে আর্থিক অস্বচ্ছতা কমানোর নামে বেআইনি কাজ করার বৈধতা দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক দলকে করপোরেট সাহায্য করার দরজা খুলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। নতুন আইনে পছন্দের রাজনৈতিক দলকে যতখুশি অর্থ দেওয়া যাবে। কোন দলকে কত টাকা দেওয়া হবে তা সম্পূর্ণ গোপন রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। এই পদ্ধতি আসলে দুর্নীতির উৎসমুখকে খুলে দিয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি খরচ করেছিল কমপক্ষে ১০,০০০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-এ এই পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। বিজেপি আরও কয়েকগুণ অর্থ অবৈধ পথে রোজগারের ব্যবস্থা করেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে কোনো স্বচ্ছতা থাকবে না। আসলে নির্বাচনী বন্ডের নামে, করপোরেটদের চাঁদা দেবার ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়ে রাজনৈতিক দুর্নীতির নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে মোদি সরকার। এটা পরিষ্কার এই বন্ড ছাড়ার উদ্দেশ্য নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের পরে ঘোড়া কেনাবেচা করে জনগণের রায়কে অগ্রাহ্য করে সরকার গঠনের জন্য বিজেপি'র অর্থ শক্তির সংঘবদ্ধকরণ।
নোট বাতিলের মধ্যে দিয়ে কালো টাকা সাদা হয়েছে। কত টাকা জমা পড়ল তা জনগণকে জানানো হয়নি। আসলে প্রচুর জাল নোটকে বিধিসম্মত করা হয়েছে। বড়ো অঙ্কের নোট বাজেয়াপ্তের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হয়েছে উঁচু স্তরে দুর্নীতি রয়েই গেছে। দুর্নীতি দূর করার বদলে নোট বাতিলের পদক্ষেপে নতুন ধরনের এবং আরও বড়ো মাপের দুর্নীতি তৈরি হয়েছে।
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায় বিজেপি কখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য লড়াই একমাত্র বামপন্থীরাই লড়তে পারবে।