৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
‘ভিআইপি’দের জেলখানা
শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস দলের কিছু মন্ত্রী, নেতা সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের বাড়িসহ অন্যত্র সব সার্চ করে কোটি কোটি নগদ টাকা উদ্ধার হয়েছে। পরপর সম্পত্তির হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। গত ১১ বছরে তৃণমূলের শাসনে এদের এত বৈভব কীভাবে বাড়লো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকী এদের প্রভাবিত মিডিয়াও এদের অন্যায়, ব্যাভিচার, অপরাধকে আড়াল করতে পারছে না। তারপরেও এদের মুখ্যমন্ত্রী ও কিছু নেতা এই অপরাধের সপক্ষে যে নর্দমার ভাষায় কথা বলছেন, তা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ও রুচির পরিপন্থী। যাঁরা জেলে আছেন, তাঁরা দিনে কতগুলি ওষুধ সেবন করেন, সকালে-দুপুরে-বিকালে-রাতে কি খাচ্ছেন, কখন ভগবানকে ডাকছেন - এসব এখন মিডিয়ার দৈনন্দিন চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলে এরা সত্যিই ভিআইপি-র আদরে আছেন।
এখন জেলখানার গালভরা নাম হয়েছে সংশোধনাগার। কত সংশোধন হয়, সেসব গবেষণার বিষয়। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। বিচারে কী হবে তা পরে জানা যাবে। অনেকগুলি বিষয়ের তদন্ত চলছে। তার ফল এখনও শূন্য। এগুলিও কী আস্তে আস্তে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাবে - ভবিষ্যৎ বলবে। বিজেপি আর তৃণমূলের গট-আপ-গেম - কী দাঁড়াবে দেখা যাক।
এখন এরা জেলখানায় বহাল তবিয়তে আছেন, বলা যায় রাজার হালে আছেন। বিপরীত চিত্রটা একবার দেখা যাক। সম্প্রতি গত ৩১ আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহিদ দিবসে পূর্ব বর্ধমান জেলায় শান্তিপূর্ণ আইন অমান্যকারীদের উপর যে বর্বরোচিত হামলা হলো, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পার্র্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, যুব ফেডারেশনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় নেতা আভাস রায়চৌধুরি, ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী পৃথা তা সহ অনেককে গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা হলো। অনেকের পুলিশ হেপাজত দু’বার করে হয়েছে। চোর ডাকাতের মতো কোমড়ে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেমারিতে রাতের অন্ধকারে শিক্ষক-মহাশয়কে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এরা কিন্তু কেউ ভিআইপি’র মর্যাদা পাননি। এরা কীভাবে আছেন, কী খাচ্ছেন, এসব সংবাদপত্রের পাতায় স্বাভাবিকভাবেই স্থান পাবে না। আর তৃণমূলের যাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। জেলে তারা কোন্ শ্রেণির বন্দির মর্যাদা পাবেন, তা আদালত স্থির করে দেয়। নিশ্চয়ই ভিআইপি’র মর্যাদা নয়।
আর একটু পুরনো দিনের কথায় ফিরে আসা যাক। স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে অহিংস, সহিংস, শ্রমিক, কৃষক আন্দোলনের সংগঠকরা বারে বারে গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকের যৌবন কেটেছে আন্দামানের কালাপানির দেশে, হিজলি, দেওলির বন্দিশিবিরে। এরা অত্যাচারিত হয়েছেন, ভিআইপি’র মর্যাদা পাননি। দেশবাসীর কাছে পেয়েছেন বিপুল সম্মান ও ভালোবাসা।
স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসী শাসনে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি হয়েছে। পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ সহ অনেকে বারে বারে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জেলখানায় রাজবন্দির মর্যাদার দাবিতে অনশন হয়েছে, অসম লড়াই হয়েছে। অনেকে জেলের মধ্যে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন। তারপর আন্দোলনের চাপে সরকার রাজবন্দির মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এখনকার মতো ভিআইপি ব্যবস্থা নয়।
ফিরে যাই ৬২ সালের দিনগুলিতে। ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে। আমরা সীমান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসার কথা বলেছি। তার জন্য আমাদের চীনপন্থী, দেশদ্রোহী অপরাধে বিনাবিচারে জেলে পোরা হয়েছে (ভারত রক্ষা আইনের ৩০ ধারা)। মুজফ্ফর আহ্মদ, যিনি ব্রিটিশ রাজত্বে বার বার গ্রেপ্তার হয়েছেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত - ব্রিটিশ আমলে অনেকবার জেলে গেছেন, গণেশ ঘোষ - আন্দামান ফেরত বিপ্লবী, হরেকৃষ্ণ কোঙার - ১৪ বছর বয়সে আন্দামানে জেলে ছিলেন, বিরোধী দলের নেতা জ্যোতি বসু সহ অনেককে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছিল। তৃণমূলীদের মতো জেলে তাঁদের ভিআইপি সুযোগ দেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা বলি। ১৯৬৪ সালে পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের পরে পরেই দেশব্যাপী এক হাজারের মতো পার্টির নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশ্যই বিনা বিচারে, ভারত রক্ষা আইনের ৩০ ধারায়। পুরুলিয়া জেলে আমাদের সাথে বন্দি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, আন্দামান ফেরত বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশি। কলকাতা থেকে অনেক দূরে। তিনি ভিআইপি মর্যাদা পাননি। ওই জেলেই কমিউনিস্ট নেতা কমল সরকারকে একা বন্দি করে রাখা হয়েছিল। দমদম জেলে বন্দি ছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিনয় চৌধুরি, হরেকৃষ্ণ কোঙার সহ অনেকে। সেল থেকে নেমে বাইরে শৌচাগার, খোলা জায়গায় স্নানের ব্যবস্থা। ইন্টারভিউয়ের সময় আইবি অফিসার পাশে বসে থাকবেন। প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু, সমর মুখার্জি, আবদুল হালিম, নরেশ দাশগুপ্ত, সুকুমার সেনগুপ্ত, নট ও নাট্যকার উৎপল দত্ত, জোছন ঘোষদস্তিদার, প্রশান্ত শূর, রবীন মুখার্জি, এসইউসি নেতা সুবোধ ব্যানার্জি প্রমুখ। তাঁরা সকলে প্রায় ৫ মিনিট হেঁটে শৌচাগারে যেতেন, বিরাট চৌবাচ্চায় সকলে মিলে স্নান করতেন। তাঁদের কোনো ভিআইপি সুযোগ ছিল না। জেলমন্ত্রী জগন্নাথ কোলে মহাশয় জেল পরিদর্শনে এসে জ্যোতিবাবুর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে আরও কি দরকার জানতে চাইলে জ্যোতিবাবু বলেন যে, আমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। জেলে যাতে বন্দিরা মানবিক ব্যবহার পান সেই দাবিই তিনি করেছিলেন।
১৯৭০ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের পর বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিনয় কোঙারকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্ধমান থানা থেকে কংগ্রেসী মস্তানদের দাবিতে তাঁকে কোমরে দড়ি পরিয়ে খোলা লরিতে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ছিল না কোনও বিশেষ সুযোগ। আর এখন এই রাজত্বে বিরোধীদের সম্মান ও মর্যাদা তো ধূলায় লুণ্ঠিত। আর ঘৃণ্য অপরাধ করে তৃণমূলীরা জেলে আছেন বহাল তবিয়তে, জামাই আদরে। শেষ বিচার মানুষই করবেন।