৬০ বর্ষ ৬ সংখ্যা / ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৩০ ভাদ্র, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (এক)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
মানব সমাজের বিকাশের ধারাতেই মতাদর্শের আবির্ভাব ঘটেছে। মতাদর্শের অর্থ, যা মানুষকে ভাবায়, মানুষের কার্যধারা পরিচালনায় সাহায্য করে, সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে, অনুপ্রাণিত করে, চেতনাকে রূপান্তরিত করে, জ্ঞানকে প্রভাবিত করে। সভ্যতার বিকাশধারায় মানব সমাজে বহু মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, কোনো কোনো মতাদর্শ যেমন মানব সমাজের অগ্রগতির ধারাকে পুষ্ট করেছে, মানব সমাজের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, আবার কোনো কোনো মতাদর্শ মানব সভ্যতার বিকাশ ধারায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
মার্কসবাদও একটা মতাদর্শ। একে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ বলেও অভিহিত করা হয়। মহান সমাজবিজ্ঞানী ও আজীবন বিপ্লববাদী কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। মার্কস ও এঙ্গেলস - এই দুইজনের যৌথ ভূমিকার ফলেই মার্কসীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, দু’জনের ভূমিকায় মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেও এই মতবাদকে মার্কসবাদ বলে অভিহিত করা হয় কেন? উত্তর হলো, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর দাবি অনুসারে একে মার্কসবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এঙ্গেলস এই মতবাদ প্রতিষ্ঠায় নিজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করলেও, এ কথাই বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন যে, তিনি (এঙ্গেলস) না থাকলেও এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হতো, কিন্তু মার্কস না থাকলে এই মতবাদই প্রতিষ্ঠিত হতো না। তাই এই মতবাদকে মার্কসবাদ হিসাবে অভিহিত করা হোক - এটা ছিল ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ দাবি। বর্তমান সময়ে এই মতবাদকে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। মার্কস ও এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর মার্কসীয় মতবাদকে সমৃদ্ধ করলেন কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। একদিকে রুশ বিপ্লবী কার্যকলাপ পরিচালনার অভিজ্ঞতার দ্বারা লেনিন মতবাদকে আরও পুষ্ট করলেন। মার্কসবাদ-বিরোধীদের আক্রমণের প্রত্যুত্তরও মার্কসবাদকে আরও সমৃদ্ধ করলো।
মার্কসবাদের তিনটি উৎস
মার্কসীয় মতবাদ তো শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। সমকালীন পৃথিবীতে জ্ঞানের সার্বিক বিকাশকে অবলম্বন করেই এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মানব জ্ঞানের বিকাশই মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তৎকালীন পৃথিবীতে ইয়োরোপের জার্মানিতে দর্শন ও দর্শনচর্চার সর্বাধিক বিকাশ ঘটেছিল। সেই সময়ে ইংল্যান্ডে অর্থনীতি বিজ্ঞানের রূপ পরিগ্রহ করলো এবং ওই দেশেই অর্থনীতির শ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি দেশেই সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের মতবাদের সেরা বিকাশ ঘটেছিল। সেইজন্যই কমরেড লেনিন জার্মান দর্শন, ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ও ফরাসি সমাজতন্ত্রের তত্ত্বকে মার্কসবাদের তিনটি উৎস হিসাবে বর্ণনা করলেন। জ্ঞান রাজপথের (Highway of knowledge) থেকেই মার্কসবাদ সৃষ্টি হলো।
মার্কসবাদের তিনটি উপাদান
মার্কসবাদের তিনটি উপাদান। উপাদানগুলি হলো যথাক্রমে মার্কসীয় দর্শন, মার্কসীয় অর্থনীতি ও মার্কসীয় সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের তত্ত্ব। এই তিনটি উপাদান নিয়েই মার্কসবাদ। মার্কসবাদের তিনটি উৎস ও তিনটি উপাদান প্রবন্ধে ভি আই লেনিন এইভাবেই ব্যাখ্যা করলেন। তিনটি উপাদানকে ভিত্তি করে সার্বিক মতবাদ হিসাবেই মার্কসীয় মতবাদের প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
মার্কসীয় দর্শন
মার্কসীয় দর্শন ব্যতিরেকে মার্কসবাদকে আত্মস্থ করা যায় না। সমগ্র মতবাদের ভিত্তি হলো মার্কসীয় দর্শন। মার্কসবাদকে উপলব্ধির মধ্যে আনতে গেলে মার্কসীয় দর্শনকে বুঝতে হবে। মার্কসীয় দর্শন হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। আবার দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে মানব সমাজের বিকাশ ধারা বিশ্লেষণ করার জন্য প্রয়োগ করাকেই বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদই হলো মার্কসীয় দর্শন। দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মার্কসীয় দর্শন হলেও, বোঝার সুবিধার জন্য দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের চর্চা পৃথক পৃথকভাবে করা হয়। প্রথমে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের চর্চা করে তারপর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের চর্চা করা হয়।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
মার্কসীয় দর্শন প্রকৃতি জগৎ, মানব সমাজ ও মানব জীবনকে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিচার করে। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই হলো মার্কসীয় দর্শন।
দর্শন কী?
ইংরেজি শব্দ ‘ফিলোজফি’-র বাংলা অনুবাদ হলো ‘জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা’। Philos (ফিলস্) গ্রিক শব্দ, যার অর্থ জ্ঞান। Sophia-ও একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ভালোবাসা। ফিলোজফি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো দর্শন। সংস্কৃত ‘দৃশ্’ ধাতু থেকেই দর্শন শব্দটি এসেছে। দর্শনের অর্থ হলো দেখা। শুধু দেখা নয়, ভালো করে দেখা। শুধু ভালো করে দেখা। চারপাশকে ভালো করে দেখাই হলো দর্শন। প্রকৃত অর্থে প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তি নিজের চারপাশকে ভালো করে দেখে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে। নিজের চরপাশকে ভালো করে দেখাই যদি দর্শন হয়, তবে তো সমস্ত সচেতন মানুষই দার্শনিক। বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে তাই। প্রতিটি সচেতন মানুষের জীবনে জড়িয়ে রয়েছে দর্শন। সাধারণ মানুষের কাছে এই কথাটি কিন্তু অজানা। তাই আমরা বলতেই পারি যে, সাধারণ সচেতন মানুষ হলেন সচেতন দার্শনিক (সচেতন শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ শিশু, যাদের চিন্তার পরিপক্কতাই গড়ে ওঠেনি ও যাদের মস্তিষ্ক অপরিণত রয়ে গেছে, তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।) মার্কসবাদের লক্ষ্য হলো সাধারণ মানুষকে অচেতন থেকে সচেতন দার্শনিকে রূপান্তরিত করা। এটা লক্ষ করা যায়, সমাজে দর্শন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা বিরাজ করছে। অত্যন্ত দুরূহ, সাধারণ বোঝাপড়ার বাইরে একটা বিষয় হলো দর্শন। কিছু অসাধারণ মানুষ, যারা এই জগতে থেকেও এই জগতের মানুষ নন, তারা হলেন দার্শনিক। দর্শন তাদের চর্চার বিষয়। এই দর্শন ও দার্শনিক সম্পর্কে অযথা ভীতি এবং অমূলক ধারণা সমাজে বিরাজ করছে। দর্শন যে প্রতিটি মানুষের জীবনে বিরাজ করছে এই উপলব্ধির পরিবর্তে মানব সমাজ ও সাধারণ মানুষের সাথে দর্শনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বহুকাল ধরেই এটা বিরাজ করছে।
দর্শন ও মানব সমাজের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করা হয়েছে
দর্শন সম্পর্কে অযথা ভীতি তৈরি করা হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই ভীতি তৈরি হয়নি। দর্শনের সম্পর্কে সঠিক ধারণা যত গড়ে উঠবে, তার গ্রহণীয়তা তত বৃদ্ধি পাবে। দর্শনই মানব চিন্তাকে সঠিক ধারায় পরিচালনা করতে সক্ষম। সেইজন্যই যুগে যুগে শাসকরা মানব সমাজের সাথে দর্শনের একটা দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে। মানব চিন্তন প্রক্রিয়াকে সঠিক ধারায় পরিচালিত হওয়ার ক্ষেত্রে এইভাবে যুগে যুগে শাসকরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। মার্কসবাদীদের অর্থাৎ শোষণহীন সমাজ গড়ার সৈনিকদের এই প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে হবে। মানব সমাজ ও দর্শনের মধ্যে সঠিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
মানব সমাজে সুদীর্ঘকাল ধরে দর্শনের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রাচীন সভ্যতার দেশগুলিতে দর্শন ও দর্শনচর্চার অস্তিত্ব চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। মিশরীয় সভ্যতায় দর্শনের অস্তিত্ব ছিল। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাতেও দর্শনচর্চার শক্তিশালী অস্তিত্ব ছিল। মেসোপটেমিয়ার দর্শনচর্চাই প্রভাবিত করেছিল পরবর্তীকালে মাইলেসিয় ও গ্রিক দার্শনিকদের। প্রাচীন গ্রিসে দর্শনচর্চার যে ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল, সে সম্পর্কে আমরা সকলেই অভিহিত। থালেস, অ্যানক্সিমেন্ডার, ডেমোক্রিটাস, এপিকিউরাস সহ আরও বহু প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকদের নামের সাথে আমরা পরিচিত।
প্রাচীন যুগে চীনে দর্শনের শুধু চর্চাই হয়নি, দর্শনের বিকাশও ঘটেছিল। বর্তমানে চীনের সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রাচীন চীনের দর্শনচর্চার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই গবেষণাগুলি চলছে। আশা করা যায় ভবিষ্যতে প্রাচীন চীনের সমৃদ্ধ দর্শনচর্চার বহু কিছু আমাদের কাছে উপস্থিত হবে। যোশেফ নিডহ্যাম (Joseph Needham)-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী রচনা - সায়েন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন ইন চায়না (Science and Civilization in China)-তে নিডহ্যাম দেখিয়েছেন প্রাচীনকালে বিজ্ঞান, সভ্যতার সাথে সাথে দর্শনেরও বিকাশ ঘটেছিল ওই দেশে।
আমাদের ভারতেও প্রাচীনকালে দর্শনচর্চার বিকাশ ঘটেছিল। সিন্ধু সভ্যতার লিপি উদ্ধারে সাফল্য অর্জিত না হওয়ায় ওই সময়ে দর্শনচর্চা ও তার অগ্রগতিকে সঠিকভাবে এখনও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সিন্ধু সভ্যতায় নিশ্চিতভাবে দর্শনচর্চার বিকাশ ঘটেছিল। সিন্ধু সভ্যতায় যে উন্নত নগর পরিকল্পনার আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে, তা প্রমাণ করে সে যুগে দর্শনচর্চা নিশ্চিতভাবে ছিল ভারতে। পরবর্তীকালে ভারতে দর্শনচর্চার বিকাশ ঘটেছে। ডক্টর দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এ ব্যাপারে অসাধারণ গবেষণা করেছেন এবং তার ভিত্তিতে বিভিন্ন রচনাও আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। উপনিষদ, বেদান্ত, ন্যায় বৈশিষিকা, সাংখ্য, মীমাংসা, লোকায়ত, চার্বাক প্রভৃতি তো ভারতীয় দর্শন। এই সমস্ত দর্শন নিয়ে বহু গবেষণা চলছে। একথা বললে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হবে না যে, প্রাচীনকালে ভারতে দর্শনচর্চার যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে রোমেও দর্শনের বিকাশ ঘটে। প্রাচীন যুগের পর মধ্য যুগেও দর্শনচর্চা ও তার বিকাশ ঘটেছে। একথা পুনরায় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, মানব সভ্যতার প্রাচীনকাল থেকেই মানব সমাজে দর্শনের অস্তিত্ব রয়েছে।
(পরবর্তী সংখ্যায় শুরু হবে - ‘দর্শন কখনো শ্রেণি নিরপেক্ষ হয় না’)