E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮

কৃষক আন্দোলনের বিজয়োৎসব দেশজুড়ে

সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে কীনা নজর রাখা হবে


বিজয়োৎসবে শামিল কৃষকরা।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার ও অন্যান্য দাবি আদায়ে সফল হওয়ার মধ্যদিয়ে কৃষক আন্দোলন দেশের গণআন্দোলনে এক নয়া ইতিহাস রচনা করল। এই জয় উদযাপনে ১১ ডিসেম্বর দেশজুড়ে বিজয়োৎসবে শামিল হলেন কৃষকরা। ওইদিন থেকেই সিঙ্ঘু, গাজিপুর, টিকরি, শাহজাহানপুর প্রভৃতি আন্দোলনের কেন্দ্রগুলি থেকে কৃষকদের ‘ঘর ওয়াপসি’ - নিজ নিজ গ্রামে ফেরা শুরু হয়। এ-এক অন্য ধরনের ঘর ওয়াপসি। জাতীয় সড়ক জুড়ে ট্রাক ট্রাক্টর ট্রলির ‘ফতেহ’ অর্থাৎ বিজয় মিছিলে ভাংরার তালে তালে বাজির রোশনাইতে ঘরে ফেলা। গত বছরের ২৬ নভেম্বর থেকে টানা ৩৭৮ দিনের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ে জিতে গ্রামে ফেরা। ৭১৫ জনের শহিদিবরণ, বহু রক্তঝরা আঘাতের বিনিময়ে অর্জিত এই জয়ের মুকুট মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরা। প্রসঙ্গত, পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে কৃষকরা যেদিন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন সেদিন ছিল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা সারা ভারত ধর্মঘট।

আন্দোলনে ঐতিহাসিক জয় হাসিল করে কৃষকদের ঘরে ফেরার এই উৎসবে সংযুক্ত কৃষক মোর্চার অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথেই শামিল হন সারা ভারত কৃষক সভার নেতৃবৃন্দও। ওইদিন টিকরি সীমান্তে উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা, ইন্দরজিৎ সহ নেতৃবৃন্দ। এর আগে ১০ ডিসেম্বর হান্নান মোল্লা সহ এআইকেএস নেতৃবৃন্দ শাহজাহানপুরে যান কৃষকদের অভিনন্দন জানাতে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতা রাকেশ টিকায়েত ১৫ ডিসেম্বর গাজিপুর সীমান্ত থেকে তাঁর সমর্থকদের নিয়ে ঘরে ফেরেন। চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াতের দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং ১০ ডিসেম্বর তাঁর শেষকৃত্যের জন্য কৃষকরা বিজয় মিছিলের কর্মসূচি স্থির করেন ১১ ডিসেম্বর। দিল্লি সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় সড়কের ওপর যেখানে কৃষকরা গত এক বছর ধরে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তাঁবু, শামিয়ানা প্রভৃতি অস্থায়ী কাঠামো তৈরি করে বসেছিলেন, সেসব পরিষ্কার করেই ঘরে ফিরেছেন কৃষকরা।

ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের চাপে করপোরেটমুখী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ১৯ নভেম্বর ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা জানিয়ে দেয়, সংসদে কৃষি আইন প্রত্যাহার এবং অন্যান্য ছয় দফা দাবির যতক্ষণ না গ্রহণযোগ্য মীমাংসা হচ্ছে, আন্দোলন চালিয়ে যাবে কৃষকরা। ২৯ নভেম্বর সংসদে বিল এনে করপোরেটমুখী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্র। কিন্তু অন্যান্য দাবির বিষয়ে কেন্দ্র নিশ্চুপ থাকায় কৃষকরা রাস্তাতেই বসে থাকেন। শেষে দীর্ঘ টালবাহানার পর ৯ ডিসেম্বর কেন্দ্র চিঠি দিয়ে সংযুক্ত কৃষক মোর্চাকে জানিয়ে দেয় , তারা কৃষকদের সমস্ত দাবির প্রতি সম্মতি জানাচ্ছে। কৃষিমন্ত্রকের সচিব সঞ্জয় আগরওয়ালের স্বাক্ষরিত ওই চিঠি নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতারা। সেখানেই ঠিক হয় আন্দোলন স্থগিত রেখে গ্রামে ফিরে যাবেন কৃষকরা। তবে এটা উল্লেখ্য যে, যুক্ত মোর্চা আন্দোলন অবসানের কথা বলেনি, স্থগিতের কথা বলেছে।

টিকরি সীমান্তে হান্নান মোল্লা, ইন্দরজিৎসহ এআইকেএস নেতৃবৃন্দ।

সংযুক্ত কৃষক মোর্চা এই জয়কে শহিদ ৭১৫ জনের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছে এবং আন্দোলনের সাফল্যের জন্য দেশের সমস্ত কৃষক এবং তাদের সমর্থকদের অভিনন্দন জানিয়েছে। এই জয়ের পিছনে আসল চাবিকাঠি ছিল কৃষক ঐক্য, শান্তি ও ধৈর্য। কোনো অবস্থাতেই তার যেন কোনো ক্ষতি না হয় তা দেখার ব্যাপারে সমষ্টিগতভাবে সচেতন থাকবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছে কৃষক মোর্চা। শ্রমিক, ছাত্র, যুব সহ যে সমস্ত প্রগতিশীল সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন, জাতীয় সড়কের ধারে বিভিন্ন দোকান ও সাধারণ মানুষ যারা বিভিন্নভাবে কৃষক আন্দোলনকে সাহায্য-সমর্থন করেছে তাদের সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছে সংযুক্ত কৃষক মোর্চা। মোর্চার সব নেতাই একটা ব্যাপারে একমত যে, সংযুক্ত কৃষক মোর্চা ভারতে এক নতুন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই মোর্চাকে অটুট রাখতে হবে। তারা কৃষক আন্দোলনের জয়কে চমকপ্রদ ও ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িত করে জানিয়েছে, সমস্ত কৃষকের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করার আইনি অধিকারের যুদ্ধ জারি থাকবে। ভারত সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে কীনা তার দিকে নজর রাখবে। আগামী কর্মপন্থা ঠিক করতে ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি দিল্লিতে বৈঠকে বসবে সংযুক্ত মোর্চা। কৃষক আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক জয়ে সংযুক্ত কৃষক মোর্চা, বিভিন্ন কৃষক ও খেতমজুর সংগঠন সহ সমগ্র কৃষক সমাজকে অভিনন্দন জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো।

কেন্দ্রীয় সরকার যে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছে তা হলোঃ ফার্মাস প্রোডিউস, ট্রেড অ্যান্ড কর্মাস (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০; ফার্মাস (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যন্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিউরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিস অ্যাক্ট ২০২০ এবং এসেন্সিয়াল কমোডিটি (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২০। ২০২০ সালের জুন মাসে এই তিনটি আইন অর্ডিন্যান্স করা হয়। পরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে আইন পাশ করা হয়।

এই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার ছাড়া কৃষক আন্দোলনের অন্যান্য ছ’দফা দাবির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল, ফসলের এমএসপি’র আইনি নিশ্চিতিকরণ। সংযুক্ত কৃষক মোর্চাকে দেওয়া চিঠিতে এপ্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বলেছেঃ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী একটি কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে। সেই কমিটিতে কেন্দ্র, রাজ্য সরকার, কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এবং কৃষিবিজ্ঞানীরা থাকবেন। দেশের কৃষকরা কীভাবে এমএসপি পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে তা দেখাই কাজ হবে এই কমিটির। এখন চালু এমএসপি ব্যবস্থা জারি থাকবে। বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল বাতিল ছিল আরেকটি প্রধান দাবি। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ বিল এখনই পেশ করা হবে না। অন্যান্য অংশীদার এবং সংযুক্ত কৃষক মোর্চার সঙ্গে আলোচনার পরেই সংসদে এই বিল পেশ হবে। কৃষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংক্রান্ত যেসব মামলা রয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি ছিল কৃষক আন্দোলনের। চিঠিতে বলা হয়েছে, সব রাজ্যেই অনতিবিলম্বে এই মামলা প্রত্যাহার করা হবে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা সরকার কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা তোলার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। পাঞ্জাব সরকারও মামলা প্রত্যাহারে সম্মতি জানিয়েছে। কেন্দ্রশাসিত রাজ্যেও এই মামলা তুলে নেওয়া হবে। শহিদ কৃষকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ সরকার এব্যাপারে নীতিগত সম্মতি জানিয়েছে। পাঞ্জাব সরকার আগেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল। শস্যের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো নিয়ে আইনের ১৪ ও ১৫ ধারা প্রত্যাহার করে ফৌজদারি অপরাধ থেকে কৃষকদের অব্যাহতি দেবার যে দাবি কৃষক আন্দোলনের ছিল তাও মেনে নেওয়া হলো বলে কেন্দ্রীয় সরকারের ওই চিঠিতে জানানো হয়েছে। কৃষক আন্দোলনের আরেকটি দাবি ছিল, লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যায় অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির পদত্যাগ। এই দাবিতেই ১৫ ডিসেম্বর লোকসভা উত্তাল হয়। বিরোধীরা এই নিয়ে সংসদে আলোচনার দাবি জানায় তারা নোটিশও জমা দেন। অধ্যক্ষ তা খারিজ করে দেন। এর প্রতিবাদে বিরোধীরা সংসদের বাইরে সভা করেন।

শিলিগুড়িতে জেলা বামফ্রন্টের ডাকে বিজয় মিছিলে হান্নান মোল্লাসহ নেতৃবৃন্দ।

কৃষক আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক জয়ের বিজয়োৎসব সারা দেশেই বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালিত হয়েছে। কৃষক, খেতমজুররা যেমন এতে শামিল হয়েছিলেন, একইভাবে ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিক সহ গণআন্দোলনের সমস্ত অংশই মিছিল-মিটিং-সভার মধ্যদিয়ে আন্দোলনরত কৃষক-খেতমজুর সমাজকে অভিনন্দন জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও প্রায় প্রতিটি জেলায় গ্রাম-শহরে এই বিজয়োৎসবকে সামনে রেখে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলগুলির উদ্যোগে মিছিল সংগঠিত হয়েছে। শিলিগুড়িতে ৭ ডিসেম্বর দার্জিলিং জেলা বামফ্রন্টের উদ্যোগে সুবিশাল মিছিল হয়। ওই মিছিলে হান্নান মোল্লা অংশ নেন। ১০ ডিসেম্বর সিপিআই(এম) বীরভূম জেলা সম্মেলনের সূচনায় সিউড়িতে এক মিছিলে কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক জয়কে অভিনন্দন জানানো হয়। ওই মিছিলে রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।