E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান দ্রুত রূপায়ণের দাবিতে চলছে দীর্ঘ লড়াই

মেঘনাদ ভূঞ্যা


প্রায় প্রতিবছর বন্যায় ভাসে ঘাটাল ও তার সংলগ্ন এলাকা।

ঘাটাল সেচ নিকাশি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের (ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান) দ্রুত রূপায়ণের দাবিতে গত ৮ ডিসেম্বর মহকুমা সেচদপ্তর অভিযান সংগঠিত হলো ঘাটালে। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে পথ অবরোধ। শামিল হয় অসংখ্য মানুষ। ‘‘ঘাটাল সেচ নিকাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও রূপনারায়ণ বাঁচাও’’ কমিটির আহ্বানে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কৃষক আন্দোলনের জেলা ও প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। প্রসঙ্গত, প্রাদেশিক কৃষক সভার সহযোগিতায় সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মিলিত হন ঘাটালে। সভা থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ, ঘাটাল মহকুমা রেললাইন নির্মাণের দাবির পাশাপাশি এই চারটি জেলার নদীর নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলে বন্যা, নদী ভাঙন এবং ভূমিক্ষয় রোধের দাবিতে গড়ে তোলা হবে তীব্র আন্দোলন।

দীর্ঘ লড়াই

দেশের স্বাধীনতার পর থেকেই কৃষক সভার নেতৃত্বে ঘাটালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হন বামপন্থী সাংসদ নিকুঞ্জ চৌধুরী। তিনি ঘাটাল বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবিতে সংসদে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন এবং প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৯ সালে মান সিংহের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই কমিটি সরেজমিনে এলাকা পরিদর্শন করে। শিলাবতী বেসিন প্রকল্প তৈরি করে। কিন্তু রূপায়ণের পূর্বেই প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। ক্রমশ তীব্র হতে থাকে বিক্ষোভ-আন্দোলন।

তীব্র গণ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৮ সালে শতাব্দীর সবচেয়ে বিধ্বংসী বন্যা মোকাবিলায় বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৭৯ সালে তৈরি হয় ‘‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’’ প্রকল্প। নীতিগতভাবে প্রকল্পটির স্বীকৃতি দেয় ভারতের পরিকল্পনা কমিশন। দুটি পর্যায়ে ভাগ করে জমা দেয় গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনের কাছে। কমিশন কিছু পরামর্শ দেয়। সেই অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে সমীক্ষা করে সংশোধিত মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প জমা দেয় বামফ্রন্ট সরকার। ষষ্ঠ পরিকল্পনায় খরচের একটি অংশ ধরা হয়। ৬ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা হয়। প্রাথমিকভাবে ৩২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। ১৯৮২ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন রাজ্যের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অজ্ঞাত রাজনৈতিক কারণে প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেনি কেন্দ্রীয় সরকার।

২০০৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার একটি সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠায়। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পকে সময়োপযোগী করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ওয়াপকস (WAPCOS) সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়। ২০০৯ সালে সময়োপযোগী প্রকল্পটি গঙ্গা বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হয়। পুনরায় কিছু বিষয়ে উত্তর চেয়ে পাঠায় কমিশন। ইতিমধ্যে ২০১১ সালে রাজ্য সরকার পরিবর্তন হয়। বর্তমান রাজ্য সরকার তাই আইআইটি-র বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে কিছু সংশোধন করে উত্তরগুলি পাঠায়। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের টেকনিক্যাল কমিটি এবং গঙ্গা বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রকল্পটির ছাড়পত্র দিয়েছে বলে ২০১৪ সালের জুন মাসে রাজ্যের সেচমন্ত্রী বিধানসভায় ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই প্রকল্পের জন্য কোন সরকার কত টাকা দেবে সেই নিয়ে চলছে দড়ি টানাটানি। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনজীবিকার নিদারুণ সমস্যা নিয়ে ছিনিমিনি করছে দুই সরকার।

প্রকল্পের এলাকা

শিলাবতী এবং কংসাবতী নদী সহ অনেকগুলি উপনদী ঘিরে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের এলাকা। আয়তন প্রায় ১৬৫৯ বর্গকিলোমিটার। পশ্চিম ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ১২টি ব্লক এবং ৬টি পৌরসভা প্রকল্পের এলাকার অন্তর্ভুক্ত। শিলাবতী ও কংসাবতী নদীর উৎসমুখ পুরুলিয়া জেলার মালভূমি এলাকা, বাঁকুড়া জেলা হয়ে এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। কংসাবতী জলধারা প্রকল্পের অধীনে বাঁকুড়া জেলার সুপুরে শিলাবতী নদীর উপর একটি ব্যারেজ করা হয়েছে। এই নদীর মূল উপনদীগুলি হলো জয়পান্ডা, চম্পা, পুরন্দর, পারাং, দোনাই, তমাল ও কুবাই নদীর মিলিত স্রোত বুড়িগাঙ প্রভৃতি। বর্ষার সময়ে এগুলি হয়ে ওঠে খরস্রোতা। এই সমস্ত এলাকার বিশাল জলরাশি এসে পড়ে শিলাবতীতে। দ্বারকেশ্বর নদীর উপনদী ঝুমি ঘাটালের উত্তর প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বলরামপুরে টুঙিঘাটে পুনরায় মিলিত হয়েছে দ্বারকেশ্বরের সাথে। মোহনায় (হুগলি জেলার বন্দরের কাছে) শিলাবতী দ্বারকেশ্বরের সাথে মিশে তৈরি করেছে রূপনারায়ণ নদ।

বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরে কংসাবতী ও তার উপনদী কুমারীর উপর প্রধানত সেচের জন্য নির্মাণ হয়েছে একটি বাঁধ। জলাধারটি কিছুটা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যও ব্যবহার হয়। কংসাবতী সেচ প্রকল্পের অধীনে আরও তিনটি ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও কার্যকর হয়নি। পশ্চিম মেদিনীপুরে ডেবরার কাপাশটিকরিতে কংসাবতী ভাগ হয়ে তৈরি হয়েছে নিউ কাঁসাই এবং ওল্ড কাঁসাই। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার উপর দিয়ে ময়নার ঢেউভাঙাতে কেলেঘাই নদীর সাথে নিউ কাঁসাই মিলিত হয়ে তৈরি করেছে হলদি নদী। ওল্ড কাঁসাই-এর শাখা নদী পলাশপাই দাসপুর-১ ব্লকে তেমাথানি থেকে তৈরি হয়ে মিলিত হয়েছে রূপনারায়ণ নদে। অন্য শাখা নদী দুর্বাচাটি (ভসরাখাল) পুনরায় ওল্ড কাঁসাই-এর সাথে মিশে শিবরাতে মিলিত হয়েছে রূপনারায়ণ নদের সাথে। এই অববাহিকা অঞ্চল উর্বর মাটির এলাকা। উৎপাদন হয় - ধান, আলু, ফুল সহ প্রচুর পরিমাণে সবজি। আলু, ফুল, সবজি রপ্তানি হয় দেশের অন্যান্য রাজ্যে। প্রায় প্রতি বছর বিধ্বংসী বন্যার কবলে পড়ে এই এলাকা। নষ্ট হয় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ঘটে জীবনহানির ঘটনা।

সীমাহীন দুর্নীতি

শিলাবতী ও কংসাবতী নদীর উচ্চ গতির এলাকায় জলাধার নির্মাণ, এই দুটি নদী এবং উপনদীগুলি সহ অনেকগুলি খাল সংস্কার ছিল ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের সাথে। তবে সংশোধিত প্রকল্পের নকশা প্রকাশ করেনি সরকার। প্রশাসনের কাছে দরবার করেও পাওয়া যায়নি তথ্য। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় প্রকল্পটির জন্য ধরা হয়েছে ১২৬০ কোটি টাকা। সম্প্রতি তেমাথানিঘাট থেকে কুলটিকরি পর্যন্ত পলাশপাই খাল এবং শ্রীবরা পর্যন্ত দুর্বাচাটি (ওল্ড কাঁসাই) সংস্কার হয়েছে। খরচ ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৭৩ কোটি এবং ৮২ কোটি টাকা। এছাড়া চন্দেশ্বর গোমরাই খাল সংস্কারের খরচ দেখানো হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কাজে বিস্তর অনিয়ম এবং কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে মানুষের অভিযোগ। নদী তীরের যে পরিমাণ জায়গা ছেড়ে এবং যে আয়তনে সংস্কারের কথা ছিল তা হয়নি। ফলে অসংখ্য জায়গায় ধসে গেছে নদীবাঁধ।

রূপনারায়ণ নদ সংস্কার চাই

‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ রূপায়ণ হলেও বন্যামুক্ত হওয়া কঠিন হবে যদি রূপনারায়ণ নদ সংস্কার না হয়। কারণ ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ প্রকল্প এলাকার বিশাল জলরাশি বেশিরভাগ এবং দ্বারকেশ্বর ও মুণ্ডেশ্বরী‍‌ নদীর জল এসে পড়েছে রূপনারায়ণ নদে। বহু বছর ধরে সংস্কার না হওয়ার কারণে পলিমাটি জমে নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বন্যা কবলিত হয়ে প‍‌ড়েছে হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। মাটি ধসে নদী গর্ভে চলে গেছে বহু গ্রাম। বিপদের মুখে কোলাঘাট, তমলুক সহ বহু জনপদ। সেজন্য দরকার রূপনারায়ণ খনন করে নাব্যতা বৃদ্ধি।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের রূপায়ণের দাবিতে সিপিআই(এম)’র ডাকে সেচ দপ্তর অভিযান।

আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিপূর্বে হাওড়া জেলা কৃষক সভার উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলিকে যুক্ত করে গণ কনভেনশনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ‘রূপনারায়ণ বাঁচাও কমিটি’। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় অনুরূপ কনভেনশনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ‘ঘাটাল সেচ নিকাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও রূপনারায়ণ বাঁচাও কমিটি’। প্রাদেশিক কৃষক কমিটির নেতৃত্বে এই দুটি কমিটির সাথে সমন্বয় রেখে গ্রহণ করা হয়েছে আন্দোলনের বহুবিধ কর্মসূচি। দাবি উঠেছে, দ্রুত কার্যকর করতে হবে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের কাজ। বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে। প্রকল্পের কাজের এলাকায় বহু বছর ধরে বসবাসকারী মানুষদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে ক্ষতিপূরণ সহ পুনর্বাসনের কাজ। দক্ষ সংস্থাকে দিয়ে কাজ করাতে হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে। বন্ধ করতে হবে দুর্নীতি ও বেনিয়ম। নদীর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে ভূমিক্ষয় রোধ, বৃক্ষরোপণ সহ গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। রূপনারায়ণ নদ সংস্কারের জন্য বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে সমীক্ষা সহ প্রকল্প তৈরি করতে হবে রাজ্য সরকারকে। রূপায়ণ করতে হবে দ্রুত।

এক সময়ে‌ চীনের দুঃখ প্রায় ৫ হাজার ৪৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হোয়াং হো নদীকে চীনের আশীর্বাদে পরিণত করেছে সে দেশের সরকার। আমাদের দেশে সরকারের উদাসীনতায় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে নিম্ন অববাহিকার এই বিস্তীর্ণ এলাকা। দলমত নির্বিশেষে মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে দাবি মেনে নিতে।