৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮
ঠিকা শ্রমিক-কর্মচারীদের রাজ্য কনভেনশন থেকে গঠিত হলো ঠিকা শ্রমিকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল কন্ট্রাক্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন
কনভেনশনে বক্তব্য রাখছেন পশ্চিম বর্ধমানের প্রতিনিধি। মঞ্চে নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নয়াউদারনীতি সংকুচিত করেছে স্থায়ী চাকরির পরিসরকে। শোষণকে আরও তীব্র করতে স্থায়ী পদ সহ অন্যত্র নিয়োগ বাড়ছে অস্থায়ী শ্রমিকদের। এই চুক্তিভিত্তিক, ঠিকা শ্রমিকদের সমকাজে সমবেতন থেকে বঞ্চিত করে লঙ্ঘন করা হচ্ছে তাদের সামাজিক সুরক্ষা সহ যাবতীয় অধিকার। তাই অধিকার অর্জনের জন্য খণ্ড খণ্ড লড়াই নয়, চাই ঐক্যবদ্ধ পাল্টা লড়াই। এই প্রয়োজন থেকেই ১০ ডিসেম্বর কলকাতার শ্রমিক ভবনে ঠিকা শ্রমিকদের রাজ্য কনভেনশন থেকে গঠিত হলো সমস্ত চুক্তিভিত্তিক এবং অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল কন্ট্রাক্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন। ন্যূনতম মজুরির দাবিকে সামনে রেখে, অন্যান্য সাধারণ দাবি দাওয়া আদায়ের আন্দোলনের লক্ষ্যে এই সংগঠন কাজ করবে। কনভেনশন থেকে ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি ডাকা সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানানো হয়।
এদিনের কনভেনশনে সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয় সুভাষ মুখার্জি, গুরুদাস ব্যানার্জি, দেবাশিস দত্তগুপ্ত, বিনয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী এবং নীলমনি রায়কে নিয়ে। কনভেনশনের উদ্বোধন করেন সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু।
কনভেনশনে রাজ্য সিআইটিইউ’র সভাপতি সুভাষ মুখার্জি বলেন, দাবি দাওয়া আদায়ের প্রশ্নে স্থায়ী এবং অস্থায়ী শ্রমিকদের সংগঠিতভাবে লড়াই জরুরি। শ্রমিকরা সংগঠিত হলে মালিকরা ভয় পাবে এবং দাবি আদায়ের লড়াইকে দিশা দেওয়া যাবে। তাই ঠিকা শ্রমিকদের একটি সংগঠনের ছাতার তলায় আসা জরুরি।
কনভেনশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে অনাদি সাহু বলেন, দেশের অর্থনীতিতে যে গভীর সংকট নেমে এসেছে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমস্ত আর্থিক বোঝা চাপানো হচ্ছে স্থায়ী সহ অস্থায়ী, ঠিকা এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রমজীবীদের ওপর। অতিমারী পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে গরিব মানুষের ওপর আরও তীব্র হয়েছে শোষণ। বাড়ছে ছাঁটাই, কর্মচ্যুত হচ্ছেন আরও বেশি সংখ্যক মানুষ। কেন্দ্রের নয়া শ্রমআইনের অজুহাতে শ্রমিকশ্রেণির ওপর আরও বেলাগাম আক্রমণ নামিয়ে আনছে এ দেশের বুর্জোয়া শাসকরা।
এ প্রসঙ্গে তিনি কেন্দ্রের নয়া শ্রমআইন বাতিল সহ অন্যান্য দাবিতে দেশব্যাপী আগামী ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অস্থায়ী শ্রমিকদের নামতে হবে আরও সংগঠিত-ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে।
অনাদি সাহু বলেন, সমকাজে সমবেতন, অস্থায়ী শ্রমিককে স্থায়ীকরণ সহ অন্যান্য সামাজিক সুযোগ সুবিধা আদায় করতে হবে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। একদিকে কেন্দ্র শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সুযোগ করে দিচ্ছে কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ানোর, অন্যদিকে এই রাজ্যেও তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর কর্পোরেট, ঠিকাদার সংস্থা একটা বন্ধু সরকার পেয়েছে। এরাজ্যে কোনো নতুন শিল্প না থাকায় চাকরি ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ বন্ধ। সরকারি চাকরিতেও বন্ধ নিয়োগ। শিক্ষিত যুবকরা কাজের জন্য বাধ্য হচ্ছে ভিন রাজ্যে যেতে। অন্য দিকে বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যাও। তাই শ্রমিকশ্রেণিকেই বাধ্য করতে হবে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে অস্থায়ী শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুবিধা, নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করতে।
কনভেনশনে বক্তা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী।
সিআইটিইউ নেতা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী জানান, নয়াউদারনীতির ফলে স্থায়ী চাকরির পরিসর সংকুচিত হয়ে আসছে। সর্বত্রই চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে। তাদের ছাঁটাই করে দেওয়া হয় যখন তখন, মরজিমাফিক। তাদের কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই।
তিনি বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়ছে শিক্ষকতার পেশায়, পুলিশের চাকরিতেও। ঠিকা শ্রমিকরা যেকোনো শিল্পেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। কৃষক আন্দোলনের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই পরিস্থিতিতে ঠিকা শ্রমিকদের আরও সংগঠিত হতে হবে।
কনভেনশনে রাজ্যের ঠিকা শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মোট ১৩ জন বক্তা বক্তব্য রাখেন। শ্রম কোড বাতিল, বেসরকারিকরণের বিরোধিতা সহ মূল্যবৃদ্ধি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা এবং তার ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রসঙ্গ সমূহ উঠে আসে আলোচনায়।
বক্তাদের আলোচনায় আরও উঠে আসে কিভাবে তৃণমূলের নেতারা শ্রমিক সংগঠনের নামে মালিক এবং ম্যানেজমেন্টের তাঁবেদারি করছে, কিভাবে তৃণমূল-ঠিকাদার-মালিকপক্ষের অশুভ আঁতাত তোলাবাজির মাধ্যমে লুঠ করছে অস্থায়ী শ্রমিকের হকের মজুরি, কিভাবে শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাওয়া টাকাও কাজ খাওয়ার হুমকি দিয়ে ঠিকাদাররা তাদের দিতে বাধ্য করছে। উঠে এসেছে প্রতিরোধের ঘটনাও। আশার কথা, এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিআইটিইউ অনুমোদিত ট্রেড ইউনিয়ন এবং বামপন্থীদের প্রতিরোধের ভূমিকায় তৃণমূলের ইউনিয়ন ছাড়ছেন শ্রমিকরা, ভয় ভীতি উপেক্ষা করে তাঁরা আসছেন সিআইটিইউ’র পতাকা তলে।
এদিন আগামী কর্মসূচির ভিত্তিতে আসন্ন ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানানো হয়। এর পাশাপাশি আসন্ন কর্মসূচির উল্লেখ করা হয় সভায়। সিআইটিইউ’র পক্ষ থেকে ১০ জানুয়ারি জেলাভিত্তিক ঠিকা শ্রমিকদের কনভেনশন সংগঠিত করার এবং ১০ ফেব্রুয়ারি রাজ্য পর্যায়ে ব্যাপক জমায়েতের ডাক দেওয়া হয়েছে।
কনভেনশন থেকে ঠিকা শ্রমিকদের রাজ্য পর্যায়ের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল কন্ট্রাক্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন গঠিত হয়। তিরিশ সদস্য বিশিষ্ট এই সংগঠনে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন দেবাঞ্জন চক্রবর্তী।
কনভেনশনের দাবিসমূহ -
● শ্রমিক কর্মচারী স্বার্থবিরোধী চারটি শ্রম কোড বাতিল করতে হবে।
● ন্যূনতম মজুরি ২৬,০০০ টাকা ঘোষণা সাপেক্ষে কেন্দ্র/রাজ্য সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি দক্ষতা অনুযায়ী দিতে হবে।
● স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ করতে হবে।
● স্থায়ীকরণ সাপেক্ষে সমকাজে সমবেতন এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাদি (প্রভিডেন্ড ফান্ড, ইএসআই, গ্র্যাচুইটি, ছুটি ইত্যাদি) দিতে হবে।
● প্রতিটি ঠিকা শ্রমিককে নিয়োগ পত্র এবং সচিত্র পরিচয় পত্র দিতে হবে।
● প্রতিটি শ্রমিককে ন্যূনতম তিন হাজার টাকা পেনশন দিতে হবে।
● ছাঁটাই কর্মীদের কাজে পুনর্বহাল করতে হবে (যেখানে প্রযোজ্য)।