৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮
শ্রেণি আন্দোলনকে মজবুত করে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে
পার্টির বীরভূম জেলা সম্মেলনে সূর্য মিশ্রের আহ্বান
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সিপিআই(এম) বীরভূম জেলা ২৩তম সম্মেলনে শ্রেণি আন্দোলনকে মজবুত করে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। তিনি বলেছেন, দিল্লির কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে একেবারে নিচুতলা থেকে হাল না ছাড়া দুর্বার আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। প্রতিটি বুথস্তর থেকে জেলা স্তর পর্যন্ত সমস্ত গণফ্রন্টের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করে আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই সম্মেলন ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর সিউড়ির রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন উপলক্ষে সিউড়ি শহর নামাঙ্কিত হয়েছিল প্রয়াত জেলা সম্পাদক কমরেড মনসা হাঁসদার নামে। সম্মেলন মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছিল প্রয়াত কমরেড সুহাস সরকার, কমরেড জীতেন মিত্র, কমরেড আবদুল গফ্ফর, কমরেড রামকানাই মণ্ডল এবং কমরেড দেবীশ্বর পাউরিয়ার স্মরণে।
এই সম্মেলন থেকে ৪০ জন সদস্য ও ২ জন আমন্ত্রিত সদস্যকে নিয়ে নতুন জেলা কমিটি গঠিত হয়েছে। সম্মেলন মঞ্চে নতুন জেলা কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে গৌতম ঘোষ সর্বসম্মতিক্রমে জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্মেলনে ২৪২ জন প্রতিনিধি ও ১৫ জন দর্শক যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা ছিল ৩৫, তফশিলি জাতিভুক্ত ৬৮ জন। আদিবাসী ১৯ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত প্রতিনিধি ছিলেন ৬৪ জন। এই সম্মেলন থেকে পার্টির আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের জন্য ৮ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
সিপিআই(এম) বীরভূম জেলা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে সিউড়ি শহরের রেডক্রশ থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলে অংশ নেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম, আভাস রায়চৌধুরী, রাজ্য কমিটির সদস্য গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি, শ্যামলী প্রধান, ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক গৌতম ঘোষসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং সম্মেলনের প্রতিনিধিরা। মিছিল রবীন্দ্র সদনে এসে পৌঁছানোর পর সম্মেলনের রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সূর্য মিশ্র। শহিদবেদিতে মাল্যদানের পর শুরু হয় সম্মেলনের কাজ।
ভরত পাল, দুকড়ি রাজবংশী, পল্টু কোড়া, মহম্মদ কামালউদ্দিন ও কবিতা রায়কে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করে।
সম্মেলন উদ্বোধন করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায়চৌধুরী। কোভিড পরিস্থিতিতেও আম্বানিদের মতো পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি এবং বেকারির ও দারিদ্র্য কীভাবে বেড়েছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্পদের লুট হচ্ছে। বৈষম্য বাড়ছে দেশজুড়ে। আমাদের রাজ্যের মানুষের অবস্থাও এ থেকে আলাদা নয়। রোজগার না থাকায় বেকাররা দুর্দশায়, মজুরি হ্রাসে শ্রমিকরা সংকটে, ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকেরা আত্মহত্যা করছেন। বীরভূম জেলাতেই দেউচা-পাঁচামি দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে প্রকৃতি এবং এলাকার মানুষকে বিপদে ফেলে লুটের বন্দোবস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, লুট আর গরিব বিরোধী কাজে বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলের কোনো ফারাক নেই। তৃণমূল এখানে গরিব বিরোধী শ্রমকোড আর কৃষি আইন প্রয়োগ করেছে। কেবলমাত্র বামপন্থীরাই লুটের রাজনীতি বন্ধ করে বিকল্পের পথ দেখাতে পারে। পুঁজির শোষণ যতদিন চলবে, ততদিন কমিউনিস্ট পার্টিকে কেউ খতম করতে পারবে না।
সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন জেলার ভারপ্রাপ্ত বিদায়ী সম্পাদক গৌতম ঘোষ। সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় প্রতিনিধিরা বলেন, ত্রুটি ও ঘাটতি সত্ত্বেও পার্টিকর্মীরা মানুষের প্রতিবাদকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করছেন পার্টিকর্মীরা। এরপর জবাবি ভাষণ শেষে খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদনটি সম্মেলনে গৃহীত হয়। কিন্তু সমস্যা হলো সঙ্গে সঙ্গে শাসকদলের দুষ্কৃতী বাহিনী ও পুলিশের আক্রমণও নেমে আসছে। শ্রম আর পুঁজির দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত, সেটা ব্যবহার করেই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি।
সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে সূর্য মিশ্র বলেছেন, ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নতুন সঙ্গী ও বন্ধুদের জড়ো করতে হবে। বামপন্থী আন্দোলনকে কোণঠাসা করে আইসোলেশনে পাঠানোটা শাসকদলের ইচ্ছে। আমরা সেই ফাঁদে পা দেব না। সংযুক্ত কিষান মোর্চার আন্দোলন আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে।
তিনি আসন্ন ব্যাঙ্ক ধর্মঘট, ইস্পাত শিল্পে ধর্মঘট, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা দু’দিনের ধর্মঘট (২৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি) সফল করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কেবল সেখানকার শ্রমিক-কর্মচারীদের বিষয় নয়। সেগুলো জনগণের সম্পত্তি, জনগণকেই তা রক্ষা করতে হবে - তার জন্য ধর্মঘট সফল করতে হবে।
সম্মেলনে দেউচা-পাঁচামিতে প্রকল্পের নামে পরিবেশ প্রকৃতি ও জনজীবন ধ্বংসের চেষ্টার বিরুদ্ধে সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে কয়েকটি প্রস্তুত গৃহীত হয়েছে।
এই সম্মেলনে পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদী ধর্মের নামে মানুষের মনে আবেশ তৈরি করে কৃষি সমস্যা, বেকার সমস্যা, দুর্নীতি সব কিছু থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। তিনি বলেন, আয়াতুল্লা খোমেইনি ইরানে ক্ষমতা দখল করেই তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখানেও হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় বসেই একইভাবে জেএনইউ থেকে শুরু করে বিশ্বভারতী সর্বত্র আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। বামপন্থী সত্তা নিয়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করার কোনও পরিসর বিজেপি’র মতো তৃণমূলও এরাজ্যে রাখতে চায় না, সব গণতান্ত্রিক অধিকার এরা ধ্বংস করছে। অথচ তৃণমূল বনাম বিজেপি’র লড়াই দেখানোর জন্য অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি করা হচ্ছে মিডিয়াকে ব্যবহার করে।
পার্টিতে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের বেশি করে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, মহামারীর দুর্যোগের সময়ে রেড ভলান্টিয়াররা যেভাবে কাজ করেছে, সাময়িক বামপন্থাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা দৃষ্টান্তযোগ্য।
এছাড়াও সম্মেলনে অভিনন্দনসূচক বক্তব্য রাখেন রামচন্দ্র ডোম।