৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে রুখে দাঁড়িয়ে বর্তমান অবস্থার মোকাবিলায় পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে
সিপিআই(এম) পুরুলিয়া জেলা সম্মেলনে বিমান বসু
পুরুলিয়া জেলা সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখছেন বিমান বসু।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ জেলার সার্বিক উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলনকে তীব্র করার আহ্বান জানিয়ে শেষ হয়েছে সিপিআই(এম) পুরুলিয়া জেলা ২১তম সম্মেলন। সম্মেলনে বিমান বসু বলেছেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে রুখে দাঁড়াতে না পারলে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। এজন্য পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। গত ১১ ও ১২ ডিসেম্বর পুরুলিয়া শহরের (কমরেড শক্তি বাউরি নগরে) রবীন্দ্র ভবনে (কমরেড অনাদি মাহাতো মঞ্চ) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিক্রমে ৬০ জনের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সম্মেলন মঞ্চ থেকে ৫৭ জন নির্বাচিত হয়েছেন। ৩ জনকে পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নবনির্বাচিত জেলা কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে প্রদীপ রায় সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া জেলা কমিটিতে ৪জন স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এই সম্মেলনে ৪৭ জন মহিলা প্রতিনিধি সহ মোট ২৯৫ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধিদের বয়ঃজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন দুধনাথ সিং (৭৭) এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন ভক্তরঞ্জন মাহাতো (২১)।
প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা রয়েছে, ১১ জন রাজনৈতিক কারণে কারাবাস করেছেন এবং ১৬ জনকে আত্মগোপনে থেকে কাজ করতে হয়েছে।
সম্মেলনে পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু। শহিদবেদিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নেতৃবৃন্দ সহ সম্মেলনের প্রতিনিধিরা।
পার্টির পুরুলিয়া জেলা ২১তম সম্মেলন উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়েই ফ্যাসিবাদ কায়েম করার চেষ্টা চলছে ভারতে। এই শক্তি সমাজের সমস্ত অংশকে কুক্ষিগত করছে। এরই অঙ্গ হিসেবে বামপন্থীদের অপ্রাসঙ্গিক করে দেবার প্রক্রিয়া চলছে। এরই পাশাপাশি তৃণমূল এবং বিজেপি-কে সামনে এনে মেহনতি অংশের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেছেন, মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন - এই চারটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে কেন্দ্র ও রাজ্যের স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। সামনে যতই চ্যালেঞ্জ আসুক তাকে মোকাবিলা করেই লাল ঝান্ডার লড়াইকে এগিয়ে যেতে হবে। শ্রেণি আন্দোলন ও গণআন্দোলনের বিকাশে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করতে হবে। নানাভাবে মানুষের উপর আক্রমণ চলছে। এলাকার গরিব মানুষের সমস্যাগুলি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, গ্রামের দাবির সঙ্গে জেলা, রাজ্য ও সারা দেশের আন্দোলনকে যুক্ত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন পার্টিতে মতাদর্শগত চর্চার বৃদ্ধি। তীক্ষ্ণ করতে হবে বিপ্লবী চেতনাকে।
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, মানুষের জীবনে সংকট তীব্র হচ্ছে। মানুষ এর প্রতিবাদ করছেন। রুখে দাঁড়াতে চাইছেন। এই সংকট মোকাবিলা করার ক্ষমতা পুঁজিবাদের নেই। তাই তারা মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলনকে ভাঙতে বিভেদ পন্থার আশ্রয় নিচ্ছে। দেশে দেশে শাসকরাও কোথাও ধর্মের নামে, কোথাও বর্ণ ও জাতের নামে বিভেদ তৈরির মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের ঐতিহাসিক লড়াই শাসককে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। শ্রমিকরাও দেশজুড়ে লড়াই চালাচ্ছে। আগামী ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষকরা।
সম্মেলন পরিচালনা করেন নিখিল মুখার্জি, দীননাথ লোধা, সাম্যপ্যারী মাহাতো, রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম ও মহম্মদ ইব্রাহিমকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।
সম্মেলনে খসড়া প্রতিবেদন উত্থাপন করেন বিদায়ী সম্পাদক প্রদীপ রায়। তিনি বলেন, এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা তৃণমূলের রাজ্য সরকার এবং প্রায় সাত বছর ধরে চলা কেন্দ্রের বিজেপি সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সহ নাগরিক অধিকার পদদলিত করছে। অতিমারী পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণির আক্রমণ আরও বেশি তীব্র হয়েছে গরিব, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের ওপর। মানুষকে সাথে নিয়েই এই সন্ত্রাসকে জয় করতে হবে। মোকাবিলা করতে হবে মেরুকরণ, বিভাজনের রাজনীতি ও মেকি জনবাদকে। মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে লক্ষাধিক পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনযন্ত্রণার কথা। রাজ্যে বিপুল অংশের আদিবাসী ও তফশিলিরাও বিপন্ন। তাঁদের জীবন জীবিকার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও উঠে এসেছে আলোচনায়। এছাড়াও আলোচনার উঠে এসেছে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জেলায় শিল্পায়নের যে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর আর বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকী বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে তৈরি হওয়া শিল্পের অনেকগুলিই বন্ধ হয়ে গেছে। জেলায় শিল্পের এই বন্ধ্যা দশায় কাজের জন্য ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন জেলার লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক। কেন্দ্রের নীতির কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কোলিয়ারি, অথচ পুয়াপুর ও ভাঙাজোড় প্রকল্প হাতে নিয়েও তার রূপায়ণ হয়নি। দামোদরের দক্ষিণ প্রান্তে পুরুলিয়া জেলায় উন্নত মানের কয়লার নতুন ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে না। এছাড়াও রক ফসফেট, লাইম স্টোন, ডলোমাইট, চীনামাটি, উন্নতমানের গ্রানাইট, ফেলস্পার ইত্যাদি প্রচুর খনিজ পদার্থভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে এই জেলায়। এছাড়া দেশের লাক্ষা শিল্পের সিংহভাগই রয়েছে পুরুলিয়া জেলায়। বনজ সম্পদভিত্তিক শিল্প, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের ডাউনস্ট্রিমের শিল্প, পর্যটন শিল্প, ইস্পাত, পিগ আয়রন সহ ভারি শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে এই জেলায়। এরই পাশাপাশি ড্যাম ও ক্যানেলগুলি সংস্কারের মাধ্যমে সেচ সেবিত এলাকা বৃদ্ধি করা, এক ফসলি জমিকে দো ফসলি জমিতে পরিণত করা সম্ভব। ঝালদায় বিড়ি শ্রমিকদের হাসপাতাল তৈরি হয়ে পড়ে থাকলেও তা চালু হচ্ছে না।
এই সমস্ত বিষয় নিয়ে জেলাজুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি আগামী ৫ জানুয়ারি জেলা শাসকের দপ্তর অভিযান সফল করার অঙ্গীকার করেন প্রতিনিধিরা।
জেলার ৪২টি এরিয়া কমিটি ও ৬টি গণফ্রন্টের মোট ৪৮ জন প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নেন।
সম্মেলনের শেষদিনে বক্তব্য রাখেন বিমান বসু। তিনি বলেন, জোতদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই পুরুলিয়া জেলায় শক্তিশালী হয়েছে পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির উপর হামলা আক্রমণ নতুন নয়। তাকে প্রতিহত করেই বেড়ে উঠেছে পার্টি। সিপিআই(এম) শক্তিশালী না হলে বামফ্রন্টের ঐক্যকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। জনগণের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। আর এ কাজে দিশা দেখাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ।
তিনি বলেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা সকলেই তখন ছিলেন যুব বয়সি। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশই হচ্ছে ৪৩ বছরের নিচে। তাই পার্টিকে শক্তিশালী করতে হলে পার্টিতে তরুণ কর্মীদের সংখ্যা বাড়াতেই হবে।
এছাড়াও সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র। তিনি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের পার্টি। তাদের বাদ দিয়ে কমিউনিস্টদের অন্য কোনো স্বার্থ নেই। তাই যাদের জন্য পার্টি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনও পার্টিকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে কোন্ ইস্যুতে মানুষ সাড়া দেবে তা খুঁজে বার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিজেপি-তৃণমূলকে হারাতে পারে একমাত্র লাল ঝান্ডাই। এটা মানুষ বুঝতে পারছে, তাঁরা আমাদের কাছে আসতে চাইছে। কিন্তু জড়তা কাটিয়ে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না বা তাঁদের হাত ধরতে পারছি না। এ কাজ আমাদের পারতেই হবে।
সিপিআই(এম) পুরুলিয়া জেলা ২১তম সম্মেলন থেকে চাহিদামতো কাজ ও ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা, কৃষকের ফসলের সহায়ক মূল্যের আইন তৈরি, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, পেট্রোপণ্য সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, নারীর সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষা করা, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শ্রমকোড এবং জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহারের দাবিতে এবং ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করার দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়।