E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৮ সংখ্যা / ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১ পৌষ, ১৪২৮

সিপিআই(এম) উত্তর দিনাজপুর জেলা ২৩তম সম্মেলন

বিশ্বনাথ সিনহা


সিপিআই(এম) উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্মেলন উপলক্ষে রায়গঞ্জের মোহনবাটিতে বর্ণাঢ্য মিছিল।

কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। সার থেকে কীটনাশক - দাম বেড়েই চলেছে। চাষআবাদে সংকট। আক্রান্ত শিক্ষা, শিক্ষান্তে কাজ নেই। বেকার আরও বেকার হচ্ছে। কৃষক-শ্রমিক অভাবের তাড়নায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথকেই বেছে নিচ্ছেন। দেশ ও রাজ্যের এমনই এক সংকটের আবহে লালঝান্ডার লড়াই তীব্র হচ্ছে। বর্তমান সংকট পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ এবং আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে আগামীর দিশা দেখাবে সিপিআই(এম)-র সম্মেলন। রাজ্যের বৃহত্তর অংশের বিশেষত শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষের জীবন জীবিকার সংকট মোচনে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বানই ধ্বনিত হলো সিপিআই(এম) উত্তর দিনাজপুর জেলা ২৩তম সম্মেলনে। ১১ ও ১২ ডিসেম্বর রায়গঞ্জের ছন্দম মঞ্চে সিপিআই(এম) উত্তর দিনাজপুর জেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

পার্টির নেতা প্রয়াত কমরেড অশোক সিং ও কমরেড আলমগীর সরকারের নামাঙ্কিত নগর এবং পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর প্রাক্তন সদস্য প্রয়াত নেতা কমরেড দুলাল সরকার ও কমরেড হবিবুর রহমান নামাঙ্কিত মঞ্চে (ছন্দম প্রেক্ষাগৃহে) জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

পার্টির জেলা ২৩তম সম্মেলন সফল করতে গোটা জেলা সেজে উঠেছিল। উত্তর দিনাজপুরের প্রান্তিক এলাকা চোপড়ার চাবাগান শ্রমিক থেকে শুরু করে করণদিঘিতে বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে সম্মেলনের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর শীতের সকালে সম্মেলনের সূচনায় রায়গঞ্জ শিলিগুড়ি মোড় থেকে এক বর্ণাঢ্য মিছিলের সূচনা করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। হাজার হাজার লালঝান্ডার মিছিল এসে শেষ হয় বিবিডি মোড়ে সম্মেলনের জন্য গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির অফিসের সামনে। শত শহিদের রক্তে রাঙা লাল পতাকা উত্তোলন করেন সাবেক পশ্চিম দিনাজপুর জেলার প্রবীণ নেতা দিলীপ নারায়ণ ঘোষ। ওইদিন দুপুরে সম্মেলন উদ্বোধন করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর নেতা পলাশ দাস। শোকপ্রস্তাব, গণফ্রন্টের রিপোর্ট, রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন পেশ করে বক্তব্য রাখেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক অপূর্ব পাল।

শীত মরশুমের শুরুতেই সম্মেলনে লড়াই-সংগ্রামের বার্তা আরেক উৎসবের মেজাজ এনে দিয়েছিল জেলার সর্বত্র। চোপড়া, ইসলামপুর, কালিয়াগঞ্জ, ইটাহার, গোয়ালপোখর, ডালখোলা করণদিঘী, কানকি ৩১ নং ও ৩৪ নং জাতীয় সড়কের পাশে সহ জেলার প্রায় সমস্ত রাস্তার দু’ধার লাল পতাকা, ফেস্টুনে সেজে উঠেছিল। একমাস ধরে জেলার বিভিন্নপ্রান্তে প্রচার ছিল তুঙ্গে। রায়গঞ্জ শহর জুড়ে সম্মেলনের নিবিড় প্রচারে শামিল হন পার্টিকর্মীরা। প্রচারে বিভিন্ন আঙ্গিকে জেলার শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছিলেন বর্ণময় ইতিহাস, মঞ্চ সজ্জায় তুলে ধরা হয়েছিল লোকসংস্কৃতির ধারাকে।

জেলা সম্মেলন উদ্বোধন করে পলাশ দাস বলেন, মতাদর্শ রাজনীতি সংগ্রাম সংগঠন - এই চারটি স্তম্ভের উপর নির্ভর করে কেন্দ্রের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন ও রাজ্যের স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই গড়ে তুলতে হবে।এ লড়াই দু-এক দিনের লড়াই নয়। লড়াই হবে প্রতিদিনের। তিনি বলেন, ইয়োরোপের বহু দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এমনকী এদেশেও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো শক্তিশালী হয়েছে। এইরকম পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে বামপন্থীদের কাজ করে যেতে হচ্ছে। আর দক্ষিণপন্থী দলগুলো তীব্র আর্থিক সংকটের বোঝা জনগণের মধ্যে নানা অছিলায় চাপিয়ে দিচ্ছে। কখনো ধর্মের নামে, কখনো পরিচিতিসত্তার নামে। আবার ভাষার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজনের রাজনীতি করে মানুষের প্রতিবাদের ভাষাকেও তারা স্তব্ধ করে দিচ্ছে। অথচ বুথে বুথে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এখনো মানুষ আমাদের ভালোবাসেন। মানুষ সিপিআই(এম)-কে বিশ্বাস করেন। আর যদি তাই না হতো, তবে অতিমারীর কালে এবং আমফানের সময়ে এত মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন না। লালঝান্ডার প্রতি যদি আস্থা না রাখতেন, তবে রেড ভলান্টিয়ারদের পক্ষে এতবড়ো মানবিক কাজ করা কখনোই সম্ভব হতো না।

সম্মেলনে খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক অপূর্ব পাল। তিনি বলেন, শ্রেণি ও গণআন্দোলনের বিকাশে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করতে হবে। এলাকার বুথ স্তর পর্যন্ত গরিব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। খসড়া প্রতিবেদনের উপর আলোচনায় ৪১ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, লালঝান্ডাকে কোণঠাসা করতে শক্রপক্ষ মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের দায়িত্ব পার্টিকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বামপন্থীদের ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করার আহ্বান জানান । তিনি বলেন, বামপন্থীদের বাইরেও এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সাম্প্রদায়িক শক্তি, বিভেদকামী শক্তি, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লাগাতার কথা বলছেন। সেই সমস্ত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর মানুষের জোট গড়ার ডাক দেওয়া হয়েছিল বিগত পার্টি কংগ্রেসে। তাই মানুষের কাছে পার্টিকর্মীদের আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতেই হবে। সামনে যতই প্রতিবন্ধকতা দেখা দিক না কেন, নতুন নতুন অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে বৃত্ত বড়ো করতেই হবে। রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন সর্বসম্মতিতে সম্মেলনে গৃহীত হয়।

সম্মেলনে ২৪৬ জন প্রতিনিধি এবং ৬২ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসেবে যেমন ৮৩ বছরের প্রবীণ দিলীপ নারায়ণ ঘোষ উপস্থিত ছিলেন, তেমনি ২৩ বছরের রূপক কুণ্ডুও সম্মেলনে অংশ নেন।

সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে ৩৯ জনের জেলা কমিটি গঠিত হয়েছে। সম্মেলন কক্ষে নবনির্বাচিত জেলা কমিটির প্রথম সভা থেকে পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য আনোয়ারুল হক সর্বসম্মতিক্রমে জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।